শাহজাহান, নাদির শাহ, দুলিপ সিং থেকে রানি ভিক্টোরিয়া... এরপর কোহিনূর উঠছে কার মাথায়?
ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিতর্কিত রত্নপাথর হলো কোহিনূর হীরা। এর জন্মস্থান ভারতে। ধারণা করা হয়, প্রায় হাজার বছর আগে এই হীরা পাওয়া গিয়েছিল পলল খনির বালি ছেঁকে। তবে পরে একসময় এটি পাড়ি জমায় বিলেতে।
শিখদের শেষ শাসক, মহারাজা দুলিপ সিং ১৮৪৯ সালে হীরাটি উপহার দিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়াকে। অবশ্য বলা হয়ে থাকে, মন থেকে ব্রিটিশদের এই উপহার দেননি তিনি। দিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে, ১৮৪৫-৪৬ সালে সংঘটিত 'অ্যাংলো-শিখ' যুদ্ধের 'ক্ষতিপূরণ হিসেবে'।
ব্রিটেনে নিয়ে গিয়ে কোহিনূর হীরা বসানো হয় ব্রিটিশ রাজমুকুটে। কোহিনূরসহ সেই প্ল্যাটিনামের তৈরি মুকুটে ঠাঁই পায় মোট ২,৮০০টি হীরা। ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেকের জন্য বানানো হয় ওই মুকুটটি। তখন মুকুটটি পরেন কুইন মাদার এলিজাবেথ।
২০১৬ সালে কোহিনূর হীরাকে কেন্দ্র করে আইনি লড়াইয়ে জড়ায় যুক্তরাজ্য ও ভারত। কেননা ভারত ফেরত চেয়েছিল তাদের ইতিহাসের পরম ধনটিকে।
এখন আবার সংবাদের শিরোনামে কোহিনূর হীরা। রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সিংহাসনে রাজ্যাভিষেক রানির জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রিন্স চার্লসের। সে সময়ে ব্রিটিশ রাজমুকুটের অধিকারী হবেন প্রিন্স চার্লসের স্ত্রী, ডাচেস অফ কর্নওয়াল ক্যামিলা। সেই সঙ্গে কোহিনূর হীরারও মালকিন বনে যাবেন তিনি।
নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব, ঠিক কবে কোহিনূর নামের এই অনিন্দ্য সুন্দর হীরাটি আবিষ্কৃত হয়। তবে স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম লিখিত রেকর্ডে এর প্রবেশ ঘটে সপ্তদশ শতকে।
মোগল সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দ্যুতিময় রত্নের একটি ছিল কোহিনূর হীরা। অন্যটি ছিল লালরঙা তৈমুর রুবি। ১৭৩৯ সালে যখন পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন, তিনি সিংহাসনটি গুঁড়িয়ে দেন। লুট করে নেন কোহিনূরসহ সিংহাসনের সব রত্নপাথর।
উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কোহিনূর আবারও ভারতে ফেরে। শিখ শাসক রনজিৎ সিংয়ের হাতে আসে কোহিনূর। কিন্তু সেই সময়ে ব্রিটিশরাও দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠে কোহিনূরের ব্যাপারে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মতামত কলামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি আহ্বান জানানো হতে থাকে, তারা যেন যেকোনো মূল্যে হীরাটি নিজেদের করে নেয়।
এই মনস্কামনা পূরণে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি ব্রিটিশদের। রনজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর চার বছরের মধ্যে চারজন শাসকের মধ্যে হাতবদল হয় হীরাটি। শেষমেশ লাহোর চুক্তির ভিত্তিতে সর্বশেষ শিখ শাসক মহারাজা দুলিপ সিং কোহিনূর দিয়ে দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। লর্ড ডালহৌসি ১৮৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেন হীরাটি। এই আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন করার জন্য তারা দুলিপকে নিয়ে যান লন্ডনে।
১৮৫১ সালে গ্রেট এক্সিবিশনের অংশ হিসেবে কোহিনূর প্রদর্শিত হয়। হাজার হাজার মানুষ এসে প্রশংসার বৃষ্টিতে ভেজায় কোহিনূরকে, ঠিক যেমনটা আজকের দিনে দর্শনার্থীদের করতে দেখা যায় টাওয়ার অব লন্ডনে গিয়ে। অনেকে অবশ্য কোহিনূরের আকৃতি দেখে নাক সিঁটকায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরার তালিকায় ১০৫ দশমিক ৬ ক্যারেটের কোহিনূরের অবস্থান ৯০তম!
চারিদিক থেকে সমালোচনার তীর ধেয়ে আসতে থাকলে, প্রিন্স আলবার্ট হীরাটিকে নতুন করে কাটিয়ে পালিশ করার ব্যবস্থা করেন। এরপর রানি ভিক্টোরিয়া এটিকে ব্রোচ হিসেবে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার উত্তরাধিকারের স্ত্রী, রানি আলেকজান্দ্রা আবার সেটিকে মুকুটে বসান। তারপর থেকে তিনজন কোহিনূর বসানো হীরাটি পরেছেন। ২০০২ সালে কুইন মেরির শেষকৃত্যের সময় তার কফিনের উপর রাখা হয়েছিল মুকুটটি।
প্রতিবারই করোনেশন ক্রাউন হিসেবে নতুন কারও মাথায় ওঠানোর আগে মুকুটটির মাপ ও নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে ক্যামিলাও পূর্বসূরীদের পথেই হাঁটবেন নাকি গারার্ডের করা কুইন মাদারের নকশাটিকে বেছে নেবেন।
অবশ্য রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় ডিউক অব এডিনবরা মুকুটটি পরেননি। সম্ভবত এই কুসংস্কার থেকে যে, যে পুরুষই মুকুটটি পরেছেন, তার ভাগ্যে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে।
সূত্র: ট্যাটলার