টাইপিস্টের জীবন: ‘১৬ বছর পর এবার শীতে একটা গরম কাপড় কিনতে পেরেছি’
সিরাজুদ্দিন সুজার (ছদ্মনাম) বয়স ৫৪। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ঢাকায় পড়তে এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী কলেজে। পড়ার পাশাপাশি টাইপরাইটারে (ম্যানুয়াল) লিখতেন রায়সাহেব বাজারে জজ কোর্টের পাশে ডিসি অফিস চত্বরে। সেটা ১৯৮৭ সাল। পড়েন আর পড়ার খরচ চালান। বাবা মারা গেছেন সেই ১৯৮১ সালে। শেষে এইচএসসির পর পড়াশোনায় ইস্তফা দিলেন। ইংরেজি টাইপরাইটার কিনেছিলেন ৬ হাজার টাকা দিয়ে। বাড়ির জমি বিক্রি করে জোগাড় করেছিলেন সে টাকা। টাইপরাইটারের নাম ছিল অপটিমা মুনির। ডিসি সাহেবের কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র জোগাড় করে তবেই একটি ডেস্ক নিয়ে বসা যায় ডিসি অফিস চত্বরে। প্রস্থে সাড়ে ৩ ফুট হবে সুজার ডেস্কটি। ওপরে ছাউনি দিয়ে খোপের ভেতর থাকত টাইপরাইটার। এখন আছে একটি কম্পিউটার মনিটর। খোপের ভেতর আরো আছে একটি চিরুনি, একটি টুপি, ছোট্ট আয়না আর চাবির গোছা। ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করেন সুজা। ব্যাকব্রাশ করা চুল, পায়ে পরিষ্কার শ্যু, কালো প্যান্টের ওপর একটি জ্যাকেট পরেছিলেন।
বলছিলেন, 'তখন ৮৫ জন টাইপিস্ট ছিল এখানে। দলিল, হলফনামা, চুক্তিনামা, দরখাস্ত, দানপত্র ইত্যাদি কাজের সবই আমরা করতাম। এক পাতা করতে ৫-৭ টাকা নিতাম। চুক্তিপত্র করতে ২৫ বা ৩০ টাকায় চুক্তি করে নিতাম পাতা বুঝে। দিনে ৩৫০-৪০০ টাকা ইনকাম ছিল।'
২০০৬ সালে টাইপরাইটারটি একজনকে দিয়ে দেন সুজা। লোকটি ২০০ টাকা সেধেছিল কিন্তু সুজা নিতে রাজি হননি। একরামের (উপকার বা সহযোগিতা) উদ্দেশ্যে দিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর আবারও গিয়েছিলেন বাড়ি। এবার গরু বিক্রি করে ৩৪ হাজার টাকা নিয়ে আসেন। প্রিন্টারসহ কম্পিউটার সেট কিনেছিলেন সেই টাকা দিয়ে।
সুজা বিয়ে করেছিলেন ছিয়ানব্বই সালে। স্ত্রীর সঙ্গে মাকেও নিয়ে আসেন ঢাকায়। কোনাপাড়ায় বাসা ভাড়া নেন ১১০০ টাকায়। তারপর ছেলে ও মেয়ে হয়। ছেলে পড়ে কম্পিউটার সায়েন্সে আর মেয়ে এসএসসি দেবে।
সুজা বলেন, 'এখন বাসা ভাড়া পড়ে প্রায় ১৩ হাজার টাকা। ইনকাম কমে গেছে অনেক। কিন্তু চলে যায়। ছেলে আর মেয়ে টিউশনি করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়ে নেয়। আজকেই যেমন মেয়ে টিকা দিতে যাওয়ার সময় বলল, বাবা কয়টি টাকা হবে। আমি অল্প কিছু দিতে পারলাম কিন্তু সে তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। ছেলে-মেয়ে দুজনেই ভালো হয়েছে। কোনো আবদার, বায়না করে না। বাসার বাইরেও বেশি থাকে না। খাবার-দাবারও আমাদের সাধারণ। যখন যা পায় তা-ই আনন্দের সঙ্গে খায়। আমার নিজের সারাদিনে শত টাকার বেশি কোনো খরচ নেই। ষোলো বছর পর এবারই একটা শীতের পোশাক কিনেছি।'
সুজা জানান, বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের বছর প্রতিষ্ঠা হয় টাইপরাইটার সমিতি। নব্বইয়ের দশকেও মোটামুটি ইনকাম ছিল টাইপরাইটারদের। এরপর ২০০০ সাল থেকে কম্পিউটার সহজলভ্য হয়ে যায়। সুজাকেও জীবিকার উপায় বদলে ফেলতে হয়। এখন এখানে টাইপিস্ট আছেন ১০০ জন, কিন্তু টাইপরাইটার টাইপিস্ট আছেন মাত্র ৭-৮ জন। বাকি সবাই কাজ করেন কম্পিউটারে।
সুজা ২০১৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন। হাতের আঙুল কমজোর হয়ে পড়েছে। তাই নিজে টাইপ কম করেন—তবে যেহেতু অনেকদিন ধরে জজ কোর্ট আর ডিসি অফিসের ধারে আছেন, তাই কাজকর্ম প্রায় সবই আয়ত্তে। ডিকটেশন দিয়ে এখন নতুন টাইপিস্টদের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেন। তখন টাকা ভাগাভাগি হয়ে যায়।
সুজা আরো জানালেন, দেশের অনেক মন্ত্রী, এমপি তিনি দেখেছেন। সাবেক এক মন্ত্রীর ঘটনা বললেন। তিনি পেশায় উকিল। ভালো উকিল নন বলে লোকে তাকে বটতলার উকিল বলত। একবার নলি (গরুর পায়ের হাড়) খাওয়া নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
সুজা বলেন, 'এখন বাসা ভাড়া পড়ে প্রায় ১৩ হাজার টাকা। ইনকাম কমে গেছে অনেক। কিন্তু চলে যায়। ছেলে আর মেয়ে টিউশনি করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়ে নেয়। আজকেই যেমন মেয়ে টিকা দিতে যাওয়ার সময় বলল, বাবা কয়টি টাকা হবে। আমি অল্প কিছু দিতে পারলাম কিন্তু সে তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। ছেলে-মেয়ে দুজনেই ভালো হয়েছে। কোনো আবদার, বায়না করে না। বাসার বাইরেও বেশি থাকে না। খাবার-দাবারও আমাদের সাধারণ। যখন যা পায় তা-ই আনন্দের সঙ্গে খায়। আমার নিজের সারাদিনে শত টাকার বেশি কোনো খরচ নেই। ষোলো বছর পর এবারই একটা শীতের পোশাক কিনেছি।'
সুজা বলছিলেন, 'টাকার খুব আগ্রহ নেই। চলতে পারলেই হয়। আর ছেলে-মেয়ে দুটি মানুষ হলেই হবে। চা-পান বা অন্য কোনো বাড়তি খরচ নেই আমার। ঘুরতে ভালো লাগে। বান্দরবান, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি গেছি। তবে বেশিরভাগই অন্য কারুর সহকারী হয়ে। পাহাড় বেশি ভালো লাগে। মাছ ধরার শখ আছে। নিজের হুইল নেই, কিন্তু যাদের আছে তাদের সঙ্গী হয়ে যাই। গতকালই (৫ ফেব্রুয়ারি) বাড়ি থেকে এসেছি। এক আত্মীয়ের বড় ঘের আছে। বলেছিলেন, মাছ ধরব, তুমি এসো। একটা বোয়াল পাওয়া গেছে, আমার কোমরসমান উঁচু হবে।'
রমনা পার্ক লেকে মাছ ধরে খুব মজা পেতেন সুজা। তার ধর্মীয় বই পড়ার শখ আছে। বেহেশতী জেওর, নেয়ামুল কুরআন, সাহাবাদের জীবনী, বোখারি শরীফ পড়তে ভালো লাগে তার। ওয়াজ (ধর্ম বিষয়ক আলোচনা) শুনতে ভালো লাগে। তবে যারা উঁচু গলায় চিৎকার করে বা অঙ্গভঙ্গি করে ওয়াজ করেন, তাদের পছন্দ করেন না সুজা। বলেন, 'আমাদের ধর্মে এত উত্তেজনা নেই। আমি ন্যাচারাল জিনিসপত্র পছন্দ করি।'
মহসিন করতেন সুপারির ব্যবসা
সুজার পাশেই বসেন মো. মহসিন। বয়স বাষট্টি। ২০০০ সালে টাইপরাইটারে হাতেখড়ি তার। আগে করতেন সুপারির ব্যবসা। ব্যবসায় একবার খুব লস খান, তারপর চলে আসেন ঢাকার ডিসি অফিসে। ছোট ভাই তার আগে থেকেই টাইপরাইটার চালাত। সেইসঙ্গে এলএলবিও পড়ত। ব্যবসায় লোকসানের কথা জেনে ভাই বললেন, 'চলে আসেন। আমার শীঘ্রই পড়া শেষ হয়ে যাবে। প্র্যাকটিস শুরু করব।'
মহসিনের ভাই এখন সুপ্রিম কোর্টের উকিল। ভাইয়ের কাছেই তালিম নিয়ে টাইপরাইটার ধরেছেন মহসিন। তার একমাত্র ছেলে কোর্ট চত্বরেই কম্পিউটার চালান। মহসিন কথা শুরুই করেছিলেন এই বলে যে, 'এটা বিলুপ্তপ্রায় পেশা। আজকে সারাদিনে (৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা) এক টাকাও ইনকাম হয়নি। কোনো কোনোদিন দেড়-দুইশ টাকা হয়। আবার পর পর কয়েকদিনই নীল (শূন্য) যায়।'
ছেলে আর বাবা দুইজন মিলে কলতাবাজারে বাসা ভাড়া করে থাকেন। নিজেরাই রান্না করে খান। দুপুরের খাবার সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। ওইদিন খাচ্ছিলেন কচু আর ডাঁটার তরকারি দিয়ে ভাত। তার ডেস্কে চুনের কৌটা আর সর্দি-কাশির কফ সিরাপ। তিনিও একটা দুর্ঘটনায় ২০১৩ সালে ডান পা হারান। এখন কাঠের পা লাগিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটেন। বলছিলেন, 'ফরম পূরণ করে আমাদের ভালো ইনকাম ছিল কিন্তু অনলাইনে এখন সব ফরমই পাওয়া যায়। কমেই গেছে কাজ-বাজ, আমাদের প্রতিযোগিতা শক্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে। কম্পিউটারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা যায়?'
আর কোনো কাজ জানা নেই
জন্ম থেকেই পা বাঁকা মতিন সাধুর (ছদ্মনাম)। ছোটখাটো, মোটাসোটা মানুষ। ছেলে আছে একটি। ছেলেটার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। আর সে কিনা বসে আছে ফেনীতে গিয়ে খালার বাড়ি। তাই মতিন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফোনে বলছেন, 'ওরে তাড়াতাড়ি পাঠা। তাড়াতাড়ি।'
মতিনের একটিই ছেলে। আগেরদিন সাড়ে ৫টায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। রাত নয়টায় বলেছিল, ফেনী যাচ্ছি। অথচ সে কোনো গরম কাপড় নিয়ে যায়নি। স্যারেরা (প্রাইভেট যারা পড়ায়) বাড়ি এসে ঘুরে গেছে। দুই স্যারের পেছনে মতিনের খরচ হয় হাজার দশেক টাকা। ঢাকায় মতিন আসেন নোয়াখালীর চাটখিল থেকে ১৯৯২ সালে। জাপানি একটি অপটিমা টাইপ রাইটার কেনেন ৮ হাজার টাকায় (সেকেন্ডহ্যান্ড)। ৬-৭ মিনিটে একটি পাতা টাইপ করে ফেলতে পারেন। এখনো টাইপ রাইটার নিয়েই আছেন।
মতিন বলেন, 'আর কোনো কাজ জানি না। কাজ কম সত্যি, কিন্তু চলে যায়। লক্ষ্মীবাজার বাসা ভাড়া করে থাকি। লোকে বিশ্বাস করে কাজ দিয়ে যায়, কারুর কাজ কখনো নষ্ট করিনি, কাউকে বোকাও বানাইনি। চলে যায়, আল্লাহ ভালোই রাখছেন।'
টাইপরাইটার খারাপ হলে কোথায় ঠিক করাতে নিয়ে যান? জানতে চাইলাম মতিনের কাছে। বললেন, 'টুকটাক কাজ নিজেরাই পারি। মেকার আছে কয়েকজন, তবে আগের মতো নাইও।'
জাকির কেবল ছোটাছুটি করেন
জজ কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন ভবন পেরিয়ে হাতের ডানে অন্নপূর্ণা হোটেল। হোটেলের উল্টোদিকে মো. জাকির নাম লেখা একটা টেবিল আর একটা টুল। টেবিলের ওপর কিছু নেই, নিচেও নেই কিছু। কাউকে বসতেও দেখা যায় না বেশি। দুপুরের বেশ পরে মাফলারে গলা ও মাথা ঢাকা চিকন-চাকন একজনকে পেলাম। জাকির প্রথমে কিছু বলতে চাইছিলেন না। বলছিলেন, 'ভাই, আমি ব্যস্ত, দেখেন না ফুরসত পাই না কোনো।'
পরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জানতে চাইলাম, কবে এখানে কাজ করা শুরু করলেন?
জাকির: ১৯৮৮ সালে।
এর মধ্যে ফোন এলো, বললেন, হ্যাঁ, মেসেজ আইছে। ১২ হাজার টাকা। ৮ ফর্দ, দেড় টাকা, খরচার টাকা পাঠাইলেন না ইত্যাদি কিছু কথা বললেন। সব বুঝলাম না।
তারপর জানতে চাইলাম, বাড়ি কোথায়?
জাকির: বরিশাল।
কেউ ছিল আপনার আগে এখানে?
জাকির: আমার ভাই ছিল। তিনি আইনজীবীর সহকারী ছিলেন।
জাকির প্রথম টাইপরাইটার কিনেছিলেন ১০ হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশ ট্রেডার্স থেকে। জাপানি মেশিন ছিল; বাংলা, অপটিমা মুনির। তার বয়স ৫২। এসএসসি পাস করার পরই চলে এসেছিলেন। ঢাকায় এসে ভাইয়ের সঙ্গে কেরানীগঞ্জে ছিলেন।
'তখন ভাড়া কম ছিল, লোক বেশি ছিল না, আইনজীবী ছিল কম, তবে ক্রাইম ছিল বেশি। মানে লোক ছিল কম, তবে কাজ ছিল বেশি। টাইপরাইটার কেনার টাকা ভাইয়েরা দিয়েছিলেন। দিনে তখন দুই-তিনশ টাকা ইনকাম ছিল। পাতা ছিল ৫ টাকা। ৫ টাকার দাম ছিল তখন। আরজিগুলা পাতা হিসাবেই হইত। চুক্তিপত্র মানে আপসনামা, হলফনামা জাতীয় কাজ ২০-৩০ টাকা চুক্তিতে করতাম। আগে মানুষ কাজ নিয়ে আসত, তেমন তেমন করে দিতাম। এখন তো কাজ করতে করতে সব জেনে গেছি। এখন ডিকটেশন দিয়ে জুনিয়রদের দিয়ে কাজ করাই। এখন তো টাইপরাইটার বিলীন হয়ে গেছে। নদীর যেমন পাড় ভাঙে, তেমন বিলীন হয়ে গেছে। কত মানুষ (টাইপরাইটার টাইপিস্ট) দেখছি। এক-দুইশ মানুষ তো মারাই গেছে। গফুর মল্লিক, মো. হোসেন, শামসুল হক, কাজী লিটন সাহেবের মতো মানুষ পাইছি, অনেক কিছু শিখছি,' বলছিলেন মো. জাকির।
আপনি টাইপরাইটারের কাজ ছাড়লেন কবে?
জাকির: ২০০৮ সালে। এখন বয়সও হয়ে গেছে। কম্পিউটারে বসে থাকতে ভালো লাগে না। আমার কাছে লোকে কাজ নিয়ে আসে। আমি করায়া দেই। আমার চাকরি হইছিল সদর পোস্ট অফিসে, পাবলিক সার্ভিস কমিশনে। আমি করি নাই। চাকরি আমার ভালো লাগে না।
আপনি তো অনেক লোক দেখেছেন?
জাকির: হ্যাঁ, দেখেছি। অনেক ম্যাজিস্ট্রেট, সচিবও আমার সঙ্গে কাজ করছে। আদম আলী সচিবও আমার টুলে বসে কাজ করছে। আমি তো চিনি না, আমার ভাই কইল, ইনি তো সচিব, রানিং সচিব, আমাদের উজিরপুরে বাড়ি। তারপর নায়ক সালমান শাহের বাবাও ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সালমান মারা যাওয়ার পর আমাকে দিয়ে অনেক কিছু লেখায়া নিছেন।
অনেক নেতা দেখেছেন? কেমন লাগে তাদের?
জাকির: নেতাদের আমার ভালো লাগে না। পুলিশের মাইর না খাইছে এমন নেতা কমই আছে। ভালো হইলে মাইর খাইব কেন?
আপনি এখন থাকেন কোথায়?
জাকির: ডেমরা। শামসুল হক খান স্কুলের কাছে থাকি। আমার ২ ছেলে ১ মেয়ে।
কখন বাসা থেকে বের হন?
জাকির: ঠিক সাড়ে সাতটায়। সেই আগে থেকেই। সকালে রুটি খেয়ে বের হই। দুপুরের ভাত নিয়ে আসি। বাসায় ফিরি আছরের আজান দেওয়ার পরপরই।
বাসায় ফিরে কি করেন?
জাকির: ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খবর নিই। ওদের লেখাপড়ার পিছনেই আমার ৯০ ভাগ টাকা খরচ হয়। বাড়ির বাজারও আমিই করি। শুক্র আর শনিবার বড় বাজার করি। আর প্রতিদিন যাওয়ার সময় শাক-সবজি নিয়ে যাই। আমার টাকা-পয়সারও বেশি লোভ নাই। সমান সমান চইলা যাইতে পারলেই হয়।
টেলিভিশন দেখেন?
জাকির: নাহ ঘরে টিভি নাই। যখন মেসে থাকতাম তখন টিভি দেখতাম। ছেলে-মেয়েরা আসার পর আর টিভি নিই নাই ঘরে।
কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে?
জাকির: মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে হজ্বে যাব।
টাইপরাইটারের টুকিটাকি
১৮৬৭ সালে প্রথম একটি পুরো কার্যকর টাইপ রাইটারের দেখা মেলে। এটি উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেওয়া হয় উইসকনসিনের ক্রিস্টোফার লেথাম সোলসকে। প্রথম বাণিজ্যিক টাইপরাইটার বাজারে আসে ১৮৭৩ সালে। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, ৫২ বার নানান অদল-বদলের পর আসে ১৮৬৭ সাল। ১৫৭৫ সালে যেমন ইতালীয় ছাপচিত্রী ফ্রানসেস্কো রাম্পাজেত্তো কাগজের ওপর ছাপ মেলার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তারপর ১৭১৪ সালে ব্রিটিশ হেনরি মিল টাইপরাইটারের মতো দেখতে একটি যন্ত্রের পেটেন্ট নিয়েছিলেন। ১৮০২ সালে আরেক ইতালীয় অগাস্টিনো ফান্তোনি অন্ধ বোনের লেখায় সুবিধা হবে ভেবে একটি বিশেষ রকম লেখনী যন্ত্র তৈরি করেছিলেন।
যাহোক, পৃথিবী-বিখ্যাত টাইপরাইটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ই রেমিংটন অ্যান্ড সন্স, আইবিএম, গোদরেজ, ইম্পেরিয়াল টাইপরাইটার কোম্পানি, অলিভার ইত্যাদি।
লেখালেখির জগতে টাইপরাইটার রাজত্ব ধরে রেখেছিল প্রায় ১০০ বছর। তারপর পার্সোনাল আর ডেস্কটপ কম্পিউটারের আগমনের ফলে রাজত্ব হারাতে থাকে টাইপরাইটার। বোস্টন গ্লোবের টাইপরাইটার রিপেয়ারম্যান জানান, একসময় হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডেও একটি করে টাইপরাইটার থাকত, এমনকি কফিন রাখার ঘরেও থাকত টাইপরাইটার।
২০১১ সালে মুম্বাইভিত্তিক টাইপরাইটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গোদরেজ তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালে ব্রাদার্স ইউকে ফ্যাক্টরি তাদের শেষ টাইপরাইটারটি তৈরি করে। বলা হয়ে থাকে, সেটিই ছিল লন্ডনের শেষ টাইপরাইটার। লন্ডন সায়েন্স মিউজিয়ামে সেটি শোভা পাচ্ছে এখন।
বিখ্যাত সব ঘটনা
মার্ক টোয়েইন তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন দি অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার (১৮৭৬) তিনি টাইপরাইটারে লিখে ছাপাখানায় পাঠিয়েছিলেন। তবে কথাটি সত্যি নয়, আসলে টোয়েইন লাইফ অন দ্য মিসিসিপি বইটি টাইপরাইটারে লিখে ১৮৮৩ সালে ছাপাখানায় পাঠিয়েছিলেন।
১৮৯১ সালে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তার শার্লক হোমস সিরিজের 'আ কেস অভ আইডেন্টিটি' লিখেছিলেন টাইপরাইটারে। মার্কিন লেখক রে ব্র্যাডবেরি তার ফারেনহাইট ৪৫১ (১৯৫৩ সালে প্রকাশিত) বইটি লেখার জন্য একটি টাইপরাইটার ভাড়া নিয়েছিলেন।
আরেক মার্কিন লেখক হারলান এলিসন সারা জীবনই টাইপরাইটারে লিখে গেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, কম্পিউটার লেখালেখির জন্য ভালো নয়। আরো বলতেন, শিল্প সস্তা হওয়া ঠিক না।
হলিউডের টম হ্যাংকস অনেক রকম ম্যানুয়াল টাইপরাইটার ব্যবহার করেন এবং সংগ্রহে রাখেন। লেরয় অ্যান্ডারসন ১৯৫০ সালে অর্কেস্ট্রার জন্য 'দি টাইপরাইটার' নামে ছোট্ট একটি সংগীত রচনা করেন। সেটি এখনো অনেক রেডিও প্রোগ্রামে ব্যবহৃত হয়। ফরাসি চলচ্চিত্র পপুলেয়ার (২০১২) তৈরি হয়েছে একজন পারসোনাল সেক্রেটারিকে ঘিরে যে টাইপরাইটিং স্পিড কম্পিটিশনে জেতার জন্য মরিয়া। ১৯৫০ সালের প্রেক্ষাপটে তৈরি এ ছবি।
বিশেষ উল্লেখ
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে উদ্ভাবন করেন 'মুনীর অপটিমা' টাইপরাইটার। মুনীর-অপটিমা টাইপরাইটারে ব্যবহৃত বাংলা লেআউট থেকেই মুনীর কিবোর্ডের উৎপত্তি। পরে জার্মানির একটি টাইপরাইটার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ওই লেআউটটি টাইপরাইটারে ব্যবহৃত হয়। এই কাজে তাকে সহায়তা করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড।
ছাপাখানার বাইরে সেই প্রথম প্রযুক্তির সূত্রে বাংলা পেল নতুন গতি। স্বাধীনতার পর ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারেও যুক্ত হয় বাংলা। পরে আটের দশকে 'বিজয়' সফটওয়্যার ব্যবহার করে সম্ভব হয় কম্পিউটারেই বাংলা লেখা।
শেষ কিছু
জজ কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের একজন সিনিয়র উকিল বলছিলেন, 'সব আদালত ভবনেই আগে টাইপিস্ট ছিল। এখনো ঢাকার মতিঝিলের শ্রম আদালতে এক-দুইজন খুঁজে পাবেন। প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকেও পাবেন হয়তো। আর আমাদের এখানে তো দেখছেনই।
'আমাদের এখানে কিছু কাজ আছে যেগুলো টাইপরাইটারে করলেই সময় ও খরচ বাঁচে। যেমন ধরুন সমন, বিবাদীপক্ষে (জমি জমার ক্ষেত্রে বেশি হয়) আছে ৩০ জন। প্রত্যেককে একই নোটিস পাঠাতে হয়। তখন টাইপ মেশিনে পরপর কার্বন পেপার বসিয়ে নিলে অনেকগুলো নোটিশ একবারেই হয়ে যায়। ফৌজদারি মামলাতেও এমনটা হয়। যেমন ধরুন, মার্ডার কেসে, একসঙ্গে অনেক কয়জন আসামী, সকলকেই তখন একই চিঠি পাঠাতে হয়। তাই আশা করা যায়, টিমটিম করেও আরো কিছুদিন টিকে থাকবে টাইপরাইটার।'