ভারতীয় অভিনেতা 'ভুলে যাওয়ার অধিকার' এর জন্য লড়াই করছেন!
একটি অপরাধের জন্য ঠিক কতদিন শাস্তি পাওয়া উচিত কোনো মানুষের? পাঠক নিশ্চয়ই উত্তর দিবেন, তা অপরাধের মাত্রা বুঝে নির্ধারিত হবে। কিন্তু ভারতীয় অভিনেতা আশুতোষ কৌশিক বছরের পর বছর ধরে মামলা লড়ছেন যেন সাধারণ মানুষ তার অপরাধের কথা ভুলে যায়!
অভিনেতার দাবি, প্রায় এক দশক আগে এক অপরাধের জন্য যে শাস্তি পেয়েছিলেন তা তার জীবনকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার আশুতোষের এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা দিল্লী হাইকোর্টে। কিন্তু তার আগে জানা দরকার, কি ছিল তার অপরাধ? আর কিভাবেই বা তিনি মানুষের নিজের এই ইতিহাস মুছে দিবেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'রাইট টু বি ফরগটেন' বা কোনোকিছু ঘটনা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাওয়ার অধিকার একজন নাগরিকের আছে। এ আইন অনুযায়ী, ইন্টারনেট থেকে নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে ছড়িয়ে পড়া তথ্য বা কন্টেন্ট অপসারণ করা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে এটি খুব সাধারণ আইন হলেও, ভারতে এটি নতুন।
কি হয়েছিল আশুতোষের সাথে?
২০০৭ সালে রিয়েলিটি শো এমটিভি রোডিজের পঞ্চম সিজনে বিজয়ী হয়ে এবং বছরখানেক বাদে বিগ বস নামক আরেকটি রিয়েলিটি শো-এর মাধ্যমে জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন আশুতোষ কৌশিক।
আশুতোষের দাবি, টিভি পর্দায় এই বিজয় তাকে দেশজুড়ে ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি এনে দিয়েছিল। কিন্তু তার এক বছর পর মাতাল হয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়েন এই অভিনেতা।
ভারতীয় আদালত তাকে ২৫০০ রুপি জরিমানা করে এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স এক বছরের জন্য বাতিল করা হয়। এছাড়া, একদিনের জন্য আদালতেও থাকতে বলা হয় তাকে।
যেহেতু আশুতোষ ইতোমধ্যেই একজন তারকা বনে গিয়েছিলেন, তাই তার এই অপরাধের কথা দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনা সংক্রান্ত নানা ছবি ও তথ্য ইন্টারনেট জগতে ছড়িয়ে পড়ে; অভিনেতার নাম সার্চ দিলে এখনো সেসব তথ্যাদি পাওয়া যায়।
মুম্বাই থেকে ফোনে আশুতোষ বলেন, "তখন আমার বয়স ছিল ২৭ বছর। আমি জীবনে যা যা চেয়েছি সবকিছু ছিল আমার। কিন্তু ওই ঘটনা আমার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার বাবা ছিল না এবং আমাকে সঠিক নির্দেশনা দেওয়া মতো কেউ ছিল না। আমি অনভিজ্ঞ ছিলাম, ওইদিন আমি ভুল করেছি এবং ভুলের শাস্তিও পেয়েছি। কিন্তু এখন আমার বয়স ৪২, আজও আমাকে ওই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে।"
আশুতোষ জানান, ওই ঘটনার পর থেকে সমাজের মানুষ তাকে চরম নিন্দা করতে থাকে। তিনি মিডিয়াতে তার কাজ থেকে বঞ্চিত হন, তাকে দেখে প্রতিবেশিরা অদ্ভুত চোখে তাকান এবং বিয়ে করতে গিয়েও বেশ কয়েকবার প্রত্যাখাত হয়েছেন তিনি।
অবশেষে ২০২০ সালে পেশার ব্যাংকার, অর্পিতার সাথে বিয়ে হয় আশুতোষের। অর্পিতা জানান, আশুতোষের মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর ভিডিও ইন্টারনেটে দেখেছেন তার বাবা-মা। তাই শুরু থেকেই তারা এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না।
অর্পিতা বলেন, "বিয়েকে কেন্দ্র করে আমার বড় ভাই আজও আমার সাথে কথা বলেন না। আমি জানি সবাই জীবনে কিছু ভুল করে, কিন্তু আমার স্বামী সারা জীবন কেন সেই ভুলের মাশুল দিবে?"
আশুতোষের মতে, যখন আদালত কোনো শাস্তি দেয় তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে থাকে। তাই ডিজিটাল শাস্তির ব্যাপারেও তা নির্দিষ্ট সময় ধরে দেওয়া উচিত।
মামলার উৎপত্তি
অপরাধের ঘটনার ভিডিও, ছবি, আর্টিকেল বা তথ্যাদি সরিয়ে নেওয়ার জন্য একাধিক গণমাধ্যম, সংবাদের ওয়েবসাইট ও চ্যানেলের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন আশুতোষ; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং গুগলের কাছে চিঠি লিখেও কোনো সাড়া পাননি তিনি।
অভিনয় ক্যারিয়ারে জিলা গাজিয়াবাদ ও কিসমত লাভ প্যায়সা দিল্লি'র মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন আশুতোষ কৌশিক। আদালতে দেওয়া পিটিশনে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার বিষয়ে প্রকাশিত আর্টিকেলগুলো তাকে 'গভীর হতাশা' ও 'মানসিক যন্ত্রণা' দিয়েছে। তিনি আদালতের কাছে দাবি করেছেন, মিডিয়া ওয়াচডগ 'প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া' এবং গুগল যেন ওই কন্টেন্টগুলো বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে নেয়।
তবে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি সূত্রে জানা যায়, এ ধরনের মামলায় আশুতোষ একা নন; কন্টেন্ট মুছে দেওয়াকে অধিকার হিসেবে দাবি করে আরো কয়েক ডজন মামলা জমেছে ভারতের বিভিন্ন আদালতে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ইতোমধ্যে অপরাধের দায় থেকে মুক্ত কিংবা সাজাভোগ করা শেষ।
বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?
ভারত সরকার জানিয়েছে, পারসোনাল ডেটা প্রটেকশন বিল-এর কাজ এখনো চলমান এবং এর মধ্যেই 'রাইট টু বি ফরগটেন' এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
অন্যদিকে, গুগলের একজন মুখপাত্র বলেন, ইন্টারনেট ওয়েবে যা আছে, সার্চ প্রক্রিয়ায় তা ই প্রথমে চলে আসে। তাই কেউ কন্টেন্ট সরাতে চাইলে যেসব সাইট কন্টেন্টগুলো প্রকাশ করেছে, প্রথমে তাদেরকে আলাদাভাবে অনুরোধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, "আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে যত বেশি সম্ভব তথ্য দেওয়া। যেসব কন্টেন্ট আমাদের নীতির বাইরে যায় তা আমরা সরিয়ে দেই। কখনো কখনো দেশীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই কাজটি করা হয়।"
তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কে. রায় বলছেন, ভারতীয় নাগরিকদের জন্য এই 'নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া'র অধিকার পাওয়া সহজ হবে না। কারণ ইন্টারনেট গুগল, ও মাইক্রোসফট বিং মিলিয়ে একটি বিশাল ল্যান্ডস্কেপ। এছাড়াও আছে উইকিপিডিয়া, মিডিয়াম ও ফেসবুক-টুইটারের মতো অন্যান্য মধ্যবর্তী প্ল্যাটফর্ম এবং হাজার হাজার ব্লগ।
তিনি আরও জানান, কয়েক বছর আগে তিনি একজন নারীর সমস্যা নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে গুগলের সাথে কথা বলেছিলেন। ওই নারীকে এমন কিছু ব্যক্তির স্ত্রী বলা হচ্ছিলো যাদেরকে তিনি চেনেনই না। কিন্তু গুগল এ নিয়ে তেমন কোনো সাহায্য করতে পারেনি।
"গুগল কিছু ইউআরএল ব্লক করতে পারে, সার্চ ফ্রেজও ব্লক করতে পারে, যেমনটা তারা আইনানুগভাবে ইউরোপে করেছে। কিন্তু ভারতে ইন্টারনেট জায়ান্টরা এটা করতে ভয় পায় কারণ তারা জানে এই দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ভারতীয় জনগণ কতটা সংবেদনশীল", বলেন প্রশান্ত কে রায়।
আশুতোষ কৌশিকের আইনজীবি অক্ষত বাজপেয়ী বলেন, যদিও ভারতে এটি একটি আইনি শূন্যতা, কিন্তু আশুতোষের মামলা দিয়েই একটি নজির স্থাপন করতে পারে আদালত।
এদিকে উড়িষ্যা ও কর্ণাটকের উচ্চ আদালত 'রাইট টু বি ফরগটেন' আইনকে ব্যক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকারের আওতায় ফেলেছেন। ২০১৮ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকার একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
বাজপেয়ী আরও বলেন, "৫০ বছর পর যখন আশুতোষের নাতি-নাতনিরা তার দাদার সম্পর্কে গুগল করবে, তারা জানবে তিনি মিডিয়ায় খ্যাতি পেয়েছিলেন। একই সাথে তার অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার কথাও জানবে। যেহেতু তিনি সাজা ভোগ করেছেন, এখন তার নিজের গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকার আছে। আমি মনে করি আদালত ও সমাজের উচিত এ ইস্যুটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা। তবে খুব-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের সাথে এটিকে মিলানো যাবে না। আমি আশা করি, আদালত মাঝামাঝি একটি সমাধানে আসবেন।"
সূত্র: বিবিসি