অফিসে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের ক্যারিয়ারকে বিপন্ন করছে!
প্রযুক্তি নির্ভরতা আধুনিক যুগেরই বৈশিষ্ট্য। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষণে ক্ষণে তার বিচরণ। বর্তমানে পরিষেবা ব্যবস্থাও নির্ভরশীল প্রযুক্তিগত অবদানের ওপর। আজকাল কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে নিজেদের চেয়েও বেশি আস্থা রাখছি আমরা। তবে এনিয়ে মাঝেমধ্যেই বিড়ম্বনাও ঘটছে। কর্মীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনসহ শ্রম শোষণের অভিযোগও উঠছে। ক্ষেত্রবিশেষে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারাও।
যুক্তরাজ্য জুড়ে সাড়া ফেলেছে এমনই এক ঘটনার তদন্ত। আসলে ডাক বিভাগের সফটওয়্যার ভুল করে শত শত ব্রিটিশ নাগরিককে চুরির অভিযোগে চিহ্নিত করে। এনিয়ে অভিযুক্তরা হয়রানির শিকারও হন। পরে তদন্তে জানা গেছে ত্রুটির ঘটনা।
এনিয়ে করা এক মামলায় বিচারক বলেছেন, "ডাক বিভাগ সফটওয়্যারটি কখনো ভুল করতে পারে না বলে দাবি করেছিল। তাদের যুক্তি ২১ শতকে বসে পৃথিবী সমতল দাবি করারই নামান্তর।"
কেবল ডাক বিভাগের মতো পরিষেবা নয়, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, কারখানা—সর্বত্র আজ জয়জয়কার যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার। আর তাতেই আস্থা রাখছেন পরিচালক থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী—সবাই। কম্পিউটারের ওপর অতি-আস্থার এই ঝুঁকিতে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান।
একবিংশ শতকের খোলনলচে বদলে দিচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি। তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। বাজারে নিত্যনতুন এমন অনেক পণ্যই আসছে যা এআই চালিত। প্রস্তুতকারকেরা দাবি করছেন, এআই- এর মাধ্যমে পণ্যগুলি কোনো সংস্থার মানব কর্মীকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দান থেকে শুরু করে সঠিক পরামর্শও দেবে। নজর রাখবে পারফরম্যান্সে। এমনকি তাদের কাজেকর্মের মূল্যায়নও করবে। এভাবে আমরা যন্ত্রের হাতে কর্মীর ক্যারিয়ারের উন্নতি/অবনতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিচ্ছি।
তথাকথিত এই 'অ্যালগরিদমিক ম্যানেজমেন্ট' ফরমায়েশি কাজের প্ল্যাটফর্মগুলো ছাড়িয়ে এখন বড় বড় সরবরাহ ও পরিবহন (লজিস্টিক) কোম্পানির গুদাম পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। মহামারির সময়ে অনলাইনে ঘরে থেকেই অফিসের কাজের চাহিদা তৈরি হওয়ায় তা অন্যান্য খাতেও ব্যবহার হচ্ছে।
অফিসের কাজে সাহায্য করতে বাজারে আসা এমন ৫৫০টি পণ্য (সফটওয়্যার, অ্যাপ ও অন্যান্য টুলস) তালিকা তৈরি করে করেছে কর্মী সংগঠক প্ল্যাটফর্ম- কোওয়ার্কার ডটঅর্গ। এরমধ্যে ৩০ শতাংশই এসেছে ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। বাকিগুলো ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল- এ সময়ে ডেভেলপ করা হয়।
কোওয়ার্কার ডটঅর্গ এসব পণ্যকে বলছে 'লিটল টেক'। এমন সম্বোধন দেওয়ার কারণ গুরুত্বপূর্ণ অফিস টুলস প্রদানকারী বেশিরভাগ ডেভেলপার ফার্ম বৃহৎ প্রযুক্তি জায়ান্টদের মতোন সবসময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে না। তবুও কিন্তু তারা মানুষের কর্মজীবনকে প্রভাবিত করতে খুব একটা পিছিয়ে নেই।
কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দেওয়া, কর্মজীবনে উন্নতিতে সহায়তা করা- এমন নানাবিধ যুক্তিতে তারা পণ্য বাজারজাত করছে।
যেমন মহামারিকালে অনেক অফিসই অর্ধেক জনবলে পরিচালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজকর্মের বিধি মেনে চলছে তারা। কোনো কর্মী কোভিড আক্রান্ত কিনা অনেক সময় তা গায়ের তাপমাত্রার ওঠানামা থেকে জানা যায়। এজন্য এসেছে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র। কর্মীরা নিজেদের মধ্যে অন্তত দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করছেন কিনা- তা মনিটরে এসেছে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা।
আবার বাড়ি থেকে কাজ করা কর্মীদের পারদর্শিতা ও কোম্পানির তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অন্যান্য কিছু পণ্য।
রিমোটডেস্ক নামের একটি সফটওয়্যার যেমন কোম্পানি ম্যানেজারদের সার্বক্ষণিক ওয়েবক্যাম নজরদারির সাহায্যে ঘরে থেকে কাজ করা কর্মীর পরিচয় ও তাদের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিতের সুযোগ দিচ্ছে। পণ্যটির ব্যাপারে দাবি করা হচ্ছে, "এটি রিমোট এজেন্টের সন্দেহজনক আচরণ বা গতিবিধি শনাক্ত করতে পারে"। যেমন কোম্পানির নীতি অনুসারে যদি কাজের সময় খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়- তাহলে কর্মীর পানাহারকে কাজের শর্ত ভঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করবে এই সফটওয়্যার।
অ্যাপরিস রিটেইল নামের আরেকটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, "এই সফটওয়্যার মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে খুচরা পণ্য বিক্রয় কর্মীর কাজ থেকে বিচ্যুতিকে শনাক্ত করতে পারে।"
ভেরেনসিক্স নামের আরেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে দাবি করা হচ্ছে, "এটি কোনো কোম্পানির সম্ভাব্য ও বর্তমান কর্মীদের স্বয়ংক্রিয় ইন্টারভিউ নেওয়ার মাধ্যমে তাদের প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরবে, যা ভালো বা মন্দ দুইই হতে পারে।"
কর্ম পরিবেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন ব্যবহারকে "উচ্চ ঝুঁকি" হিসেবে চিহ্নিত করতে একটি বিধিমালা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এর আওতায় সফটওয়্যারের বাড়াবাড়ি ঠেকাতে মানবিক হস্তক্ষেপ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের পরিষেবায় যুক্ত কর্মীরাই এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রযুক্তিপণ্যের বাড়াবাড়ি হস্তক্ষেপের শিকার। ইতোমধ্যেই তাদের অনেকে ইইউ 'জেনারেল ডেটা প্রটেকশন আইন"- এর আওতায় কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করছেন। যেমন অ্যাপভিত্তিক রাইড সার্ভিস কোম্পানির রয়েছে চালকদের পারফরম্যান্স অনুযায়ী- গ্রাহকদের রেটিং দেওয়ার ব্যবস্থা। ভালো রেটিংসের ওপর নির্ভর করে কোম্পানি থেকে গাড়ি চালকের কমিশন আয়ের তারতম্য। গেল বছর আমস্টারডামের একটি আদালত ওলা ক্যাবসকে তাদের রেটিং ব্যবস্থা চালকদের জন্য উন্মুক্ত করার নির্দেশ দেন। এর ফলে চালকেরা গ্রাহকের দেওয়া অন্যায্য স্কোরের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।
ইংলিশ চ্যানেলের ওপাড়ের দেশ যুক্তরাজ্য অবশ্য হাঁটছে উল্টোপথে। কিছু ব্রিটিশ রাজনীতিক চান- মানবিক হস্তক্ষেপ দূর করে যান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বৃদ্ধির আইন। কতটুকু মানবিক অংশগ্রহণ রাখা যায় তার সীমা নির্ধারণে গেল বছর ব্রিটিশ সরকার একটি টাস্ক ফোর্সও গঠন করে।
এমন পদক্ষেপ হতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক। একথা সত্য, আধুনিক বিশ্বে পরিষেবা কাঠামো অত্যন্ত জটিল ও সুবিশাল। কিন্তু, তাই বলে সম্পূর্ণভাবে যন্ত্রের সিদ্ধান্তে নির্ভর করলে বাড়বে সফটওয়্যার ত্রুটিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বিপন্ন হবে কর্মস্থলের নিরাপত্তা। নীতি-নির্ধারকদের বোঝা উচিৎ যান্ত্রিক বিশ্লেষণের হাতে মানবিক অনুভূতিকে বিচারের ভার ছেড়ে দেওয়াও উচিৎ নয়। এতে শ্রম শোষণের ঘটনাই বাড়বে বহুগুণে।
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস