ইউসুফ কনফেকশনারি: টানা পরোটা, ফ্যান্সি রুটি, ইচ্ছেমতো মেশান চানাচুর...
কাজের সূত্রে মাসে চার-পাঁচবার সেলিম মিয়াকে ঢাকা জর্জ কোর্ট আসতে হয়। কোর্ট থেকে ফেরার পথে প্রায়দিন ক্ষুধায় তার পেট চো চো করতে থাকে। তিনি একদিন রায়সাহেব বাজারের জনসন রোড দিয়ে যাওয়ার পথে বিশাল আকারের এক রুটি দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। দোকানের ওপরে চোখ পড়তেই দেখেন বড় করে লেখা ইউসুফ কনফেকশনারি। তিনি বলেন, "আমি এখানে প্রথমবার রুটি খাওয়ার পর আমার কাছে এতো ভালো লেগেছিল যে, আমি আমার পরিবারের জন্য বড় আকারের একটা ফ্যান্সি রুটি কিনেও নিয়ে যাই"। সেখান থেকে সেলিম মিয়া এখনো 'ইউসুফের' একজন নিয়মিত ক্রেতা।
দোকানে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে কাঁচের তাকে সাজিয়ে রাখা হরেক রকমের ফাস্টফুড আইটেম। রাস্তার পাশে তাদের ছোট্ট দোকানে এতোরকম খাবারের আইমেট দেখে একরকম বিস্মিত হয়েছিলাম। লক্ষ্য করলাম কিছু কিছু খাবারের আকার ও ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যা অন্যান্য বেকারির থেকে আলাদা। তার সাথে আপনার চোখে পড়বেই, দোকানের দেয়ালে বড় করে টানিয়ে রাখা ৭০-৮০ বয়সের একজন বৃদ্ধের ছবি। ইনিই মোহাম্মদ ইউসুফ, যার হাত ধরে একদিন ইউসুফ বেকারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষটিকে এই সময়ের কেউ তেমনভাবে না চিনলেও তার প্রতিষ্ঠিত বেকারিকে অনেকেই একনামে চিনে ফেলে।
দোকানীদের দাবি বেকারির খাবারের অনেক কিছুই প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরে বাজারে এসেছে। কেক, রুটি, বিস্কুটের জন্য ইউসুফ এখনও ক্রেতাদের পছন্দের তালিকার প্রথম সারিতে থাকে। সূচনাকাল থেকে ৯০ বছর পরে এসেও ইউসুফের জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ আমলে শুরুটা যেভাবে
ইউসুফ বেকারির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৩২ সাল, যখন অবিভক্ত ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনামল চলছিল। ইউসুফ বেকারির কর্ণধার মোহাম্মদ ইউসুফ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। সেই আমলে পুরান ঢাকায় তার পরিবারের একাধিক ব্যবসা ছিল। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ইউসুফ ছিলেন সবার বড়। তাই ছোটবেলায় ব্যাট-বল হাতে নেওয়ার বদলে বাবার সাথে ধরতে হয়েছিল পরিবারের হাল। ব্যবসায়ী ইউসুফের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ব্যবসা সামলানোতে তিনি ছিলেন বেশ পারদর্শী।
ইংরেজ শাসনামলে পুরান ঢাকার রায়েরবাজার, বংশালরোড, কোর্ট-কাচারি ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে প্রশাসনিক দপ্তর ও ব্যবসায়িক কাজের জন্য মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। ঐ সময়ে মোহাম্মদ ইউসুফ অন্য ব্যবসার পাশাপাশি ছোট পরিসরে বেকারির খাবার বিক্রি শুরু করেন। কয়েক বছর পরে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইউসুফ নিজের নামে একটি বেকারির দোকান দিয়ে বসেন। সেই থেকে তিন পুরুষ ধরে চলে আসছে তাদের বেকারির ব্যবসা।
প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ এখন বেঁচে নেই কিন্তু সেই একই জায়গায় ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইউসুফ বেকারি। তার সেই ছোট পরিসরের ব্যবসা এখন ঢাকার মধ্যে কয়েক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। মোহাম্মদ ইউসুফ মারা যান ১৯৯০ সালে। তারপর থেকে তার ১১ জন ছেলে মিলে বেকারি ব্যবসার হাল ধরে, ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকে। কিন্তু ভাইদের মধ্যে সম্পর্কে চির ধরতে শুরু করলে একে একে সবাই ব্যবসার দায়িত্ব ভাগ করে নিজেদের মতো আলাদা হয়ে যায়। ব্যবসা, দোকান ভাগাভাগি করে আলাদা করে ফেলা হলেও, এখনো ইউসুফের সব দোকানের খাবার তৈরি হয় একটি কারখানাতেই। জজকোর্টের পেছনে বেকারির কারখানাটি অবস্থিত। এখান থেকেই ইউসুফ কনফেকশনারির সব শাখায় খাবার সরবরাহ হয়।
ইউসুফ কনফেকশনারির সব শাখায় একইরকম খাবার পাওয়া যায়। দোকান মালিকদের কেউ চাইলেই নিজের দোকানের জন্য আলাদা খাবার বানাতে পারবে না। এইদিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি এখনো ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই একযোগে কাজ করে যাচ্ছে বলা যায়। এর মূল কারণ হিসেবে মোহাম্মদ ইউসুফের নাতনি ও জনসন রোডের শাখার বর্তমান সত্ত্বাধিকারী ইশরাত জাহান বলেন, "শুরু থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠান কিছু নিয়ম মেনে কাজ করে আসছে। তারমধ্য একটা হচ্ছে খাবারের মান ও বিশেষত্ব টিকিয়ে রাখতে আমরা সব শাখায় একই খাবার বিক্রি করে থাকি। আপনি আমাদের পুরান ঢাকার দোকানে যে খাবারগুলো পাবেন, ধানমন্ডি ও অন্যান্য শাখাতেও সে খাবারগুলো পাবেন। জায়গা ও সেখানে থাকা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ ও দামে কিছুটা তারতম্য হতে পারে। কিন্তু একই কারখানাতেউ সব শাখার জন্য খাবার তৈরি করা হয় বিধায়, কোনো নির্দিষ্ট শাখার খাবার আইটেমে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা কম"।
কী কী পাবেন
বিস্কুট, রুটি, কেক থেকে শুরু নানা রকমের স্ন্যাকস আইটেম পাওয়া যায়। বিস্কুটের মধ্যে আছে চকলেট চাম, নিমকি বিস্কুট, সল্টেজ বিস্কুটসহ আরও কয়েকরকম পদের বিস্কুট। মিষ্টি ও নোনতা দুই রকম স্বাদের বিস্কুটই পাওয়া যায় এখানে । এছাড়াও রয়েছে ডিনার স্টিক নামের লম্বা লম্বা একধরনের বিস্কুট, এর প্রতিটি প্যাকেটের মূল্য ৫৫-৬০ টাকা। ভিন্ন ভিন্ন বিস্কুটের জন্য দামটাও ভিন্ন। এখানে প্রতি কেজি বিস্কুটের দাম পরবে সর্বনিম্ন ২৮০-৩২০ টাকা পর্যন্ত। দাম খুব বেশি না হলেও মানের দিক দিয়ে ইউসুফ নিজেদের সেরা বলে দাবি করে।
আগে ইউসুফে শুধু বেকারি আইটেমই পাওয়া যেত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা অন্যান্য খাবার সংযোজন করতে থাকে। সেখান থেকেই 'ইউসুফ বেকারি' হয়ে যায় 'ইউসুফ কনফেকশনারি'।
খাবারের মধ্যে পরোটা ও রুটির জন্য ইউসুফের বেশ নাম-ডাক আছে। এখানে টানা পরোটা নামের এক ধরনের পরোটা পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে চিকেন পরোটা যার মূল্য ৫০ টাকা।
ফ্যান্সি রুটি নামের একধরনের বিশাল আকৃতির রুটি বানানো হয় শুধুমাত্র শবে বরাতের জন্য। এই রুটি শুধু আকারেই বড় তা নয়, বাহারি রকম ডিজাইন দেওয়া হয় এই রুটিতে। কখনো মাছের আকৃতি, কখনো বা পাতা, ফুলের আকৃতি দেওয়া হয়। কেউ চাইলে নিজেদের পছন্দমতো ডিজাইনের রুটি বানিয়ে নিতে পারেন। একেকটি ফ্যান্সি রুটির ওজন ২-৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এতো ওজনের একটা রুটির আকার কেমন হতে পারে তা কল্পনা করেই বোঝা যাচ্ছে। পরিবারের সবার জন্য একটা রুটিই যথেষ্ট বলা যেতে পারে। এখনো শবে-বরাতে ইউসুফ তাদের অনেক বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী রুটি হালুয়ার আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও রোজার মাসব্যাপী ইউসুফে বেকারির আইটেমের পাশাপাশি জালি কাবাব, সুতা কাবাব, হালিম, কাটলেট, জিলাপি, নান রুটি ও গ্রিল পাওয়া যায়।
কেকের মধ্যে পাওয়া যায় ফ্রুটস কেক, প্লেইন কেক, জ্যামরোল, চেরি কেক। এছাড়াও মাখনের তৈরি জন্মদিনের কেক পাওয়া যায়, প্রতি পাউন্ড কেকের মূল্য ৪০০-৫০০ টাকা। স্ন্যাকস আইটেমের মধ্যে পাওয়া যায় কাপ পেটিস, রোল পেটিস, মাটন পেটিস ও চিজ ফিংগার-এর ভেতরটা চিজে ভরপুর আর বাইরের দিকটা পেচিয়ে পেচিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। মুকরুম নামের বিশেষ এক ধরনের হাওয়াই মিষ্টি পাওয়া যায় যার প্রতি প্যাকেটের মূল্য ৩০ টাকা।
ইউসুফের কাপ পেটিস দেখলে প্রথমবারের মতো যে কেউ এটাকে কাপ কেক বা পেস্ট্রি ভেবে বসতে পারে। যানজট ঠেলে একদিন পুরান ঢাকার ইউসুফ বেকারিতে খেতে গিয়ে আমারো প্রথম দেখাতে এটাকে কেক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু দোকানী জানালো এটা তাদের সবচেয়ে বিক্রিত খাবার চিকেন পেটিস। তাই আগ্রহ আরেকটু বেড়ে গেল স্বাদ পরখ করে দেখার জন্য। খাওয়ার সময় প্রথমে তেমন কিছু মনে না হলেও এর স্বাদ আপনি বুঝতে পারবেন ভেতরের দিকে চিকেনে ভরা পুর মুখে দিয়ে। চিকেনের সাথে দুধের তৈরি ক্রিমি পেস্ট এর স্বাদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের প্রতিটি চিকেন পেটিসের মূল্য ৪০ টাকা।
ইউসুফের চানাচুরের কেন এতো জনপ্রিয়তা
বাজারে যে সব চানাচুর কিনতে পাওয়া যায় তার সবগুলোই থাকে আগে থেকে মিশ্রিত বা প্যাকেট করা। কিন্তু এখান থেকে চাইলে ক্রেতারা নিজেদের ইচ্ছেমতো চানাচুরের উপাদান মিশিয়ে করে নিতে পারবেন। আলাদা আলাদা বোতলে বাদাম, চানার ডাল, মুগের ডাল, চিড়া ভেজে রাখা হয় তারপর ক্রেতাদের ইচ্ছেমতো তারা বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে চানাচুরের প্যাকেট বানিয়ে দেন। এখানে প্রতি কেজি চানাচুরের মূল্য পরবে ২২০-২৮০ টাকা পর্যন্ত।
বর্তমানে যে কারখানায় বেকারির খাবার বানানো হয় সেখানে আর চানাচুর উৎপাদন করা হয়না। ইউসুফের থেকে চানাচুরের ব্যবসা আলাদা করে ফেলা হয় পাঁচ বছর আগে, খান চানাচুর নামে আরেকটি কারখানা করা হয়েছে। সেখান থেকে চানাচুর উৎপাদন করে ঢাকার বিভিন্ন দোকানগুলোতে সরবরাহ করা হয়।
কেমন যাচ্ছে ইউসুফের পথচলা
বর্তমানে ঢাকায় ইউসুফ কনফেকশনারির ১২টি শাখা আছে। ধানমণ্ডিতে ৩টি, পুরান ঢাকায় ৩টি ও গুলশান, রমনা এবং বাংলামোটরে রয়েছে ইউসুফের শাখা। ইউসুফের প্রধান ও সবচেয়ে পুরোনো শাখাটি পুরান ঢাকার জনসন রোডে অবস্থিত। বর্তমানে এই শাখাটি পরিচালনা করছেন মোহাম্মদ ইউসুফের ষষ্ঠ পুত্র মোঃ ইয়াকুবের ২ সন্তান। বাবা মারা যাওয়ার পর দুই ভাইবোন মিলে দাদার চালু করা সেই ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। মোঃ ইয়াকুবের ছেলে ইয়ামিন পড়াশোনার পাশাপাশি জনসন রোডের শাখাটি পরিচালনা করছে এবং এই কাজে তার বড় বোন ইশরাত সার্বিকভাবে তাকে সহায়তা করেন। ইউসুফ কনফেকশনারির অন্যান্য শাখাগুলো বর্তমানে মোহাম্মদ ইউসুফের বাকি ছেলেরা ও তাদের সন্তানরা পরিচালনা করছে।
ইয়ামিন জানান, "করোনার আগে আমাদের ব্যবসা ভালো চলতো। সামনেই আদালত, ডিসি অফিস ও দাপ্তরিক ভবনগুলো থেকে প্রচুর করপোরেট অর্ডার পাওয়া যেত। ডিসি অফিস থেকে কয়েকদিনের জন্য প্রতিদিন ৫০০ পিস রুটি, কেকের অর্ডার আসতো যা করোনার সময় থেকে বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর বাড্ডায় আমাদের আরেকটি কারখানা ছিল, কিন্তু করোনার সময় ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ফলে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। করোনার সময় আমাদের ফাস্টফুড খাবার বিক্রি বন্ধ ছিল, বর্তমানে আমরা আবার চালু করেছি। করোনার সময় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে এখনো আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে"।
ইউসুফের জনসন রোডের শাখাটি আগে অনলাইন ও ফুডপান্ডার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বর্তমানে তাদের এই সার্ভিসটি বন্ধ আছে। তাই আপনি খাবার কিনতে বা খেতে চাইলে আপনাকে তাদের দোকানেই যেতে হবে। করোনা তাদের ব্যবসাতে শুধু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা-ই নয়, আগের থেকে দোকানের জৌলুশও অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে তা বোঝা যাচ্ছিল। তবে দুই ভাইবোনের ইচ্ছে আছে তারা ভবিষ্যতে ইউসুফ নামে রেস্টুরেন্ট খুলবে, যেখানে বেকারি আইটেমের পাশাপাশি থাকবে দেশি-বিদেশি নানারকম খাবার।