শরদিন্দু আর সুরভী: টেলস অব আ বং গার্ল
জনপ্রিয় পোশাক ব্র্যান্ড 'শরদিন্দু'র কর্ণধার তিনি। তবে সফল উদ্যোক্তা, নকশাকার, সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার- সবকিছু মিলেই সংজ্ঞায়িত করা যায় হাবিবা আক্তার সুরভীকে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় আছেন, অথচ সুরভীকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন! ফ্যাশন ভ্লগিং দিয়ে হোক বা নিজ ব্র্যান্ডের মাধ্যমে- হাবিবা সুরভীর নাম নেটিজেনদের চোখে পড়বেই!
মনেপ্রাণে বাঙালি সুরভী নিজের চলনবলন থেকে শুরু করে নকশা করা পোশাকেও ফুটিয়ে তোলেন বাঙালিয়ানাকে। ২০১৬ সাল থেকে নিজের ক্ষুদ্র উদ্যোগকে তিলে তিলে বড় করে তুলেছেন তিনি, 'শরদিন্দু'কে পৌঁছে দিয়েছেন গ্রাহকের দোরগোড়ায়।
কাজের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি ও সম্মাননা স্বরূপ কিছুদিন আগেই ফ্যাশন ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন 'দ্য মার্ভেল অব টুমরো' অ্যাওয়ার্ড।
শরদিন্দুর শুরু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন সুরভী। গাজীপুর থেকে এসে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। আরও অনেক শিক্ষার্থীর মতো তিনিও হাতখরচ মেটাতে শুরু করেন টিউশনি। দ্বিতীয় বর্ষের শেষদিকে এসে খেয়াল করলেন, নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর আর টিউশনি থাকছে না।
কিন্তু এভাবে আয়ের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চাননি তিনি। সুরভী চেয়েছিলেন তার আয়ের উৎস অনিশ্চিত থাকবে না; আয়ের সিদ্ধান্ত তিনি নিজেরটা নিজেই নেবেন। নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আয়ের উৎসে পরিণত করবেন, এই চিন্তা আসে তার মনে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তার পণ্য কি হবে?
যেহেতু চারুকলার শিক্ষার্থী, তাই শিল্প-চিত্রকর্ম ও নকশা সংক্রান্ত কিছু বিষয় ইতোমধ্যেই তার জানা ছিল। চারুকলায় সিনিয়র শিক্ষার্থীরা নানা ওয়ার্কশপে যেতেন এবং টাইডাইয়ের কাজ করতেন। কিন্তু সুরভীর কাছে সেসব ওয়ার্কশপে ভর্তি হবার মতো টাকা ছিল না। তাই তিনি নিজেই ইউটিউব দেখে টাইডাই শিখে নেন। টাইডাই নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করে সেগুলোর ছবি ফেসবুকে দেওয়ার পর দেখা গেল বন্ধুবান্ধবরা বেশ প্রশংসা করছে। এতে উদ্দীপ্ত হয়ে 'শরদিন্দু' নামের একটি পেজ খুলে ফেলেন তিনি। সেটি ২০১৬ সালের কথা।
শরদিন্দু অর্থ 'শরতের চাঁদ'; শরতের চাঁদকে ধরা হয় সবচেয়ে সুন্দর হিসেবে। তখন থেকেই সুরভী চেয়েছেন, তার নকশা করা পোশাক যারা পরবেন তাদের যেন শরতের চাঁদের মতোই সুন্দর লাগে। সে ভাবনা থেকেই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ।
ইউল্যাবের এক বান্ধবীর কাছে টাইডাইয়ের একটি শাড়ি বিক্রি করেন সুরভী, সেটিই ছিল শরদিন্দুর পেইজ থেকে বিক্রি হওয়া প্রথম পণ্য। এরপর আস্তে আস্তে পেইজের অর্ডার বাড়তে থাকে তার।
পেশাই যখন নেশা
হাবিবা সুরভী বরাবর বলে এসেছেন, ব্যবসা করতেই হবে এমন চিন্তা নিয়ে তিনি ব্যবসায় নামেননি। পোশাকে নানা রং-নকশার এক্সপেরিমেন্ট, টাইডাই-ব্লক ও শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে কাজ চালিয়ে গেছেন। সেই সাথে ছিল কঠোর পরিশ্রম ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা।
শরদিন্দুর প্রতিষ্ঠাতা হাবিবা আক্তার সুরভী বলেন, "শাড়ির কাজ রীতিমত আমার রুটিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। দেখা যেত, প্রতি বৃহস্পতিবার ২টার ক্লাস শেষে আমি চলে যেতাম পুরান ঢাকার ইসলামপুরে। সেখান থেকে কাপড় আর রং কিনে ভার্সিটির ৫টার বাসে উঠে গাজীপুরে আমার বাসায় যেতাম। বাসায় কাপড় রঙ করে শুকিয়ে আবার রোববার সকালের বাসে ভার্সিটিতে এসে নামতাম।
প্রতি সপ্তাহেই দেখা যেত, আমার ১৫-২০টা শাড়ির অর্ডার থাকত, যা আসলে একজন মানুষের পক্ষে বেশ চাপের ছিল। তবে আমি সেই কাজটা অনেক আনন্দ নিয়ে করতাম। একেকটা শাড়ির কাজ শেষে দেখতাম কী সুন্দর টেক্সচার এসেছে, আর মানুষ সেগুলো পছন্দ করছে।"
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন সুরভী। টাইডাইয়ের কাজে রঙয়ের গন্ধ ছড়ায়, ফ্লোরেও রঙ লেগে যায়। হলে সকলের কমন বাথরুম থাকায় সেখানে টাইডাইয়ের কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া অর্ডারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সব কাপড় হলে রাখাও যাচ্ছিল না।
পেইজ থেকে মোটামুটি আয় শুরু হতেই সুরভী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন আলাদা বাসায় ওঠার। একদিন হলের কাউকে কিছু না জানিয়েই উঠে পড়েন হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্টে চিলেকোঠার একটি ভাড়াবাসায়।
নতুন বাসায় ওঠার পর সুরভীর কাজের গতি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কারণ তখন ইচ্ছেমতো স্বচ্ছন্দ্যে কাজ চালিয়ে নিতে পারতেন। এমনও দিন গেছে, একদিনে ৭০-৮০টি ওড়নায় টাইডাই করেছেন তিনি। পরে পোশাকে নতুনত্ব আনতে টাইডাইয়ের পাশাপাশি উডব্লক এবং স্ক্রিনপ্রিন্টের নকশা যোগ করেন সুরভী।
ফিফটি-ফিফটি পার্টনারশিপ
বর্তমানে ৩ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ ফ্যাশন ব্র্যান্ড শরদিন্দুর ফেসবুক পেইজটিতে লাইক দিয়ে যুক্ত আছেন।
এখন যেভাবে দেশে অনলাইন ব্যবসার প্রসার ঘটেছে, ২০১৬-২০১৭ সালের দিকে দৃশ্যপট এমন ছিল না। সুরভীর ভাষ্যে, "ডেলিভারি বা কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দুয়েকদিনের মধ্যেই টাকা দিয়ে দেয়; কিন্তু তখন এতো সহজ ছিল না। কখনো কখনো সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পেমেন্টের দেখা মিলত না। হয়তো পাওনা ২০ হাজার টাকা, কিন্তু তারা সরবরাহ করতো ৫ হাজার টাকা!"
এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন তানবীর হোসেন রিফাত। রিফাত ও সুরভী একটি প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন, সেখানেই দু'জনের পরিচয়। রিফাতের পড়াশোনা ছিল আইন বিষয়ে, পাশাপশি অন্য একটি নামী প্রতিষ্ঠানে আলোকচিত্রী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
কুরিয়ার এজেন্সিতে সুরভীর আটকা টাকার সুরাহায় সাহায্য করেন রিফাত।
একদিন রিফাত তার ক্যামেরায় সুরভীর নকশা করা কিছু পোশাকের ছবি তুলে দেন। সুরভী অবাক হয়ে দেখলেন, মোবাইল ফোনের চেয়ে ডিএসএলআর ক্যামেরায় তোলা ছবি আপলোড দিতেই এক লাফে সুরভীর পেইজে গ্রাহকের সাড়া বেড়ে গেছে চার-পাঁচ গুণ!
অন্যদিকে রিফাত বুঝতে পারলেন, পেমেন্ট আদায়, পোশাকের ছবি তোলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুরভীকে সাহায্য করতে পারছেন তিনি; তাই প্রস্তাবটা তার পক্ষ থেকেই আসে, "ব্যবসাটা দু'জনে মিলে করলে কেমন হয়!" সুরভীও এতে সম্মতি জানালে আধাআধি অংশীদারিত্বে শরদিন্দুকে নিয়ে পথচলা শুরু হয় দু'জনার। এর আগে শরদিন্দুকে মূলত চিনতো সুরভীর পরিচিতজনেরা, তখন থেকে সেই চেনা গন্ডির বাইরেও যাত্রা শুরু করলো ব্র্যান্ডটি।
কাপড়টাই ক্যানভাস
শুরুর দিকে দড়িতে বা দরজায় আনস্টিচ (সেলাইবিহীন) পোশাক ঝুলিয়ে রেখে তার ছবি তুলতেন সুরভী ও রিফাত। কারণ মাপমতো জামা বানিয়ে মডেল হয়ে ক্রেতাদের কাছে পোশাককে তুলে ধরার সক্ষমতা ছিল না তাদের। হঠাৎ একদিন সুরভীর মাথায় আসে, নিজেই নিজের জামা সেলাই করলে কেমন হয়? তখনই ইসলামপুর থেকে কিনে আনেন একটি সেলাই মেশিন, এরপর সেলাইয়ের কাজও তিনি ইউটিউব দেখে শিখে ফেলেন!
এভাবে ছয় মাস নিজেই নিজের জামা সেলাই করেছেন সুরভী। সে সময় ছবি তুলতে ঢাকার আশেপাশে, যেমন-সোনারগাঁও বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামা নিয়ে চলে যেতেন দুজনে। পথে কোনো রেস্টুরেন্টে বা পাবলিক টয়লেটে গিয়ে পোশাক বদলে নিতেন সুরভী।
সেই সময়ের বাজে একটি অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করলেন সুরভী। একবার ৫০০ গজ কাপড়ে স্ক্রিনপ্রিন্ট করতে দিয়েছিলেন একটি কারখানায়। কিন্তু মডেল হিসেবে পরার জন্য নিজের পোশাকটি ফটোশ্যুটের আগের দিন ধুতে গিয়ে সুরভী দেখেন জামা থেকে প্রচুর রঙ উঠছে। কারখানা থেকে কাপড়ে নিম্নমানের রঙ ব্যবহার করায় সেবার মোটামুটি বড় অংকের লোকসান হয়েছিল তাদের। সুরভী ও রিফাত নিজেদের পকেট থেকে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেন তখন। ব্যবসায়ের শুরুর দিকে এমন অভিজ্ঞতা শরদিন্দুর জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
পরিবারের কাছ কেমন সহায়তা পান জানতে চাইলে সুরভী বলেন, "সন্তানকে নিয়ে চিন্তা তো সব মা-বাবাই করে থাকে। তবে আমার মা-বাবা কখনোই প্রবলেম্যাটিক গার্ডিয়ান ছিলেন না। তারা কখনো কিছু নিয়ে গোঁড়ামি করেন নি। হ্যাঁ, যখন প্রথম প্রথম টাইডাই করতে দেখেন, তখন কিছুটা চিন্তিত ছিলেন আমার ভবিষ্যত নিয়ে। কিন্তু যখন দেখলেন আমি ঢাকায় নিজে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারছি, জামার নকশা এঁকে ফেসবুকে দিচ্ছি, সেগুলো ক্রেতারা পছন্দ করছে; তখন কিন্তু তারাই সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন।"
সুরভী ও রিফাত ব্যবসার সাথে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেদের যে, বলতে গেলে তারা 'দুইজনে মিলে একটাই' জীবনযাপন করছিলেন। সুরভীর স্নাতক শেষ হওয়ার পর তাই পরিবারের পরামর্শেই বিয়েটা সেরে নেন তারা।
বিয়ের পর ২০১৯ সালে প্রথম ধানমন্ডির হ্যাপী আর্কেডে শরদিন্দুর আউটলেট খোলেন সুরভী-রিফাত। অনলাইন পোশাকের ব্যবসায় অনেক ক্রেতাই কাপড়ের মান নিয়ে সন্দিহান থাকেন। মূলত তাদের সুবিধার্থেই আউটলেট খোলার উদ্যোগ নেন তারা। বড় ধরনের ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে জেনেও তারা শেষ পর্যন্ত দোকানটি ভাড়া নেন; মনে মনে নিজেদের বুঝিয়েছিলেন, আউটলেট থেকে প্রফিট 'শূন্য' ধরে নিয়ে ব্যবসা চালাবেন।
কিন্তু তাদের বিস্মিত করে দিয়ে দোকানের উদ্বোধনী দিনেই শরদিন্দু পরবর্তী পাঁচ মাসের দোকান ভাড়ার টাকা উঠিয়ে আনে। এ ঘটনায় সুরভীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুণ। এরপর একে একে ঢাকার উত্তরা, বসুন্ধরা সিটি, নিউমার্কেট এবং সর্বশেষ বেইলি রোডে শরদিন্দুর আউটলেট খোলা হয়। শীঘ্রই সিলেটেও আউটলেট খুলতে যাচ্ছেন তারা। এর পাশাপাশি সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য শরদিন্দুর আলাদা হেড অফিস তো রয়েছেই, আরও রয়েছে একটি কারখানা। এইচআর টিম, একাউন্টস, টেক টিম, কাস্টমার কেয়ার টিম, কারিগর- সব মিলিয়ে শরদিন্দুতে এখন কাজ করছেন ১০০ জনের মতো।
পোশাকের নকশার ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন সুরভী। পুঁথি, পুতুল, টেরাকোটা, পুরাণের নানা গল্প, মন্ত্র, এমনকি স্বাধীনতার সময়কার সংবাদপত্রের থিমেও সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি এনেছে শরদিন্দু। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মসলিনের শাড়ি ও থ্রিপিস। এর বাইরে তাদের ভ্যান গগ, হ্যারি পটার, ফ্রেন্ডস সিরিজ ইত্যাদি থিমের শাল, জ্যাকেট, ব্লেজার অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সুরভীর কাছে কাপড়ই তার ক্যানভাস। বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চান তিনি। বলেন, "আমাদের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান আছে, যা নিয়ে এখনকার প্রজন্ম খুব কম জানে। ধরা যাক, একজন টিনএজার গ্রামবাংলার পুঁথি সম্পর্কে একেবারেই জানে না। সে যদি দেখে পোশাকে পুঁথির দুটো লাইন আছে, ও কিন্তু আগ্রহী হবে। সে তখন ঠিকই গুগলে সার্চ দিয়ে জানতে চাইবে আমি যা পরে আছি, সেটি আসলে কী!"
ব্যবসায়ে প্রফিট ধরে রাখার ক্ষেত্রে সুরভী-রিফাত জুটিকে বেশ সফল বলা যায়। সুরভী জানালেন, শরদিন্দুর যাত্রা শুরুর পর থেকে কখনো তাদের হতাশাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। প্রফিট ছিল বলেই ব্যবসাটাকে এতদূর নিয়ে আসতে পেরেছেন তারা।
এর জন্য শরদিন্দুর ক্রেতাদের ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না সুরভী। তার ভাষ্যে, "শরদিন্দু এমন একটি বিশ্বস্ত ক্রেতাগোষ্ঠী পেয়েছে যারা এই ব্র্যান্ডকে ভালোবাসে, স্নেহ করে। আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার ক্রেতাদের। তাদের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ।"
সুরভী- টেলস অব আ বং গার্ল
উদ্যোক্তা পরিচয় ছাড়াও সুরভীর এখন বড় পরিচয়, তিনি একজন জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম ভ্লগার ও ইনফ্লুয়েন্সার। আছে ইউটিউব চ্যানেল, যেখানে তিনি নিজেকে 'সুরভী- টেলস অব আ বং গার্ল' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আসলে ব্যবসায়ের ধারাবাহিকতায় ক্রেতাদের উপকৃত করার চিন্তা থেকেই মূলত ভ্লগিং শুরু করেন সুরভী। নিজ ব্র্যান্ডের পোশাকগুলো বিভিন্ন উপলক্ষ্যে কিভাবে স্টাইলিং করা যায়, তা ভিডিও কন্টেন্ট ও ছবির মাধ্যমে দেখাতে শুরু করেন তিনি।
সুরভী চেয়েছিলেন, তার নিজের চেহারাই হবে পোশাকের কপিরাইট। তিনি বলেন, "যখন মানুষ আমার গায়ে আমার ব্র্যান্ডের পোশাক দেখবে, তাদের মাথায় এটা ঢুকে যাবে যে এই জামাটা শরদিন্দুর। অন্য কেউ এই নকশা চুরি করলে আমার ক্রেতারাই সেখানে গিয়ে তাদের ধরবে।"
"একেকটা পোশাকের পেছনে আমার অনেক পরিকল্পনা থাকে। যিনি নিজের পয়সা খরচ করে পোশাকটি কিনছেন, তার কাছে যেন আইডিয়া থাকে যে, আমার এই একটিমাত্র পোশাকই তিনি অনেকভাবে পরতে পারবেন।"
সুরভীর এসব ভিডিও লুফে নিয়েছে ক্রেতা আর তার অনুসারীরা। একটি শাড়ি বা শাল চার/পাঁচ রকম স্টাইলে পরা, পোশাকের সাথে ম্যাচিং গয়না-ব্যাগ-জুতার স্টাইলিং, ভ্রমণের গল্প ইত্যাদি তার কন্টেন্টের বিষয়বস্তু। ইনস্টাগ্রামে বর্তমানে তার অনুসারীর সংখ্যা দেড় লাখের কাছাকাছি।
কিভাবে কন্টেন্টের আইডিয়া পান সে প্রশ্নে সুরভী জানান, "এটা নিয়ে আমি প্রচুর ব্রেইনস্টর্মিং করি। এখনো আমার ট্যাবে ১০-১২টা ভিডিওর আইডিয়া লেখা আছে। মেকআপ, পোশাক, ইন্টেরিয়র-নানা কিছুর আইডিয়া সন্নিবেশ করি। আমি আসলে এ বিষয়গুলো উপভোগ করি। উপভোগ করতে করতেই আমার ভ্লগার বনে যাওয়া!"
'প্রডাক্ট প্রমোশনের' ক্ষেত্রে অবশ্য ইনফ্লুয়েন্সার সুরভী কিছু নীতির অনুসরণ করেন; আগের চাইতে হয়েছেন সাবধানীও। গুণগত মান, বাজারে চাহিদা সবকিছু বিবেচনা শেষেই কোনো একটি পণ্যের প্রচারে উদ্যোগী হন।
সুরভী বলেন, "কেউ যদি আমার সাথে প্রডাক্টের প্রমোশনের জন্য চুক্তি করে, আমি চেষ্টা করি সে আমাকে যে টাকা দিলো, তার সমপরিমাণ লাভ যেন সে আমার মাধ্যমে তুলে আনতে পারে। কিন্তু ট্রেন্ডের বাইরে চলে গেছে, অনেক পুরনো বা নিম্নমানের কোনোকিছু আমি প্রমোট করি না।"
পেশা হিসেবে দিনদিন ব্লগিং বা ভ্লগিং আকৃষ্ট করছে তরুণদের। সুরভীর মতে, "পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্লগারদের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। এখানে ক্যারিয়ার আছে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোরও লাভ থাকে। একটা বিজ্ঞাপন দিতে যে টাকা লাগে, তার তিন ভাগের এক ভাগ টাকায় ব্লগাররা তাদের পণ্যের প্রচার করে দেয়।"
এ পেশায় আসতে ইচ্ছুকদের উদ্দেশ্যে সুরভীর মত হলো, আগ্রহ না থাকলে জোর করে কিছু হওয়া যাবে না। যে যেটা পছন্দ করে, তা নিয়েই তার কন্টেন্ট হবে। তিনি বলেন, "যেমন ধরুন, কেউ যদি খেতে পছন্দ করে তাহলে তার ফুড ব্লগার হওয়া উচিত; এমন না যে ফুড ব্লগার হবো বলেই আমি খাবো।"
আনন্দ যাপন
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বাদে বাকি সব দক্ষতাই ইন্টারনেট বা ইউটিউব দেখে অর্জন করেছেন সুরভী। জানতে চাই, নানামুখী কাজের সঙ্গে জড়িত থেকেও ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে কিভাবে ভারসাম্য রক্ষা করেন সুরভী!
সুরভীর কথায়, "ভারসাম্যের প্রশ্ন তখনই আসবে যখন চাপ অনুভব হবে। আমার জীবনে কোনো চাপই নেই। কারণ আমি জোর করে কিছুই করি না।"
অবসর সময়ে গাছ লাগাতে ও ছবি আঁকতে ভালোবাসেন সুরভী। সবুজ তার প্রিয় রঙের একটি। আর ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে। সুরভীর ইউটিউব আর ইনস্টাগ্রামে ঢুঁ মারলে চমৎকার কিছু ট্রাভেল ভ্লগ দেখা যাবে।
কাউকেই শতভাগ অনুসরণ করেন না সুরভী, নেই কোন 'আইডল'। তবে চেষ্টা করেন ইতিবাচকতা গ্রহণ করতে- সেটি হতে পারেন কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রিয় বই বা সিনেমা। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব সাধারণ থাকার। দামি কোন রেস্টুরেন্টে যাবার চেয়ে বন্ধুদের সাথে টিএসসির চায়ের আড্ডা তার কাছে অনেক বেশি উপভোগ্য।
এক কথায়, নিজেকে এই তরুণ উদ্যোক্তা দেখেন একজন 'হ্যাপি সো'ল' বা সুখী মানুষ হিসেবে যে নিজে যা করতে ভালোবাসে, সবসময় সেটাই করে।
ভবিষ্যত ভাবনায় শরদিন্দু
জীবনে যে কাজে আনন্দ পেয়েছেন শুধুমাত্র সেটিই করে গেছেন হাবিবা আক্তার সুরভী। তবে এখনই থামতে চান না তিনি। আত্মতুষ্টিতে ভুগে সামনে এগোবার পথ রুদ্ধ করে দেয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। বরং আজ গ্রাহকের হাতে যে পোশাক বা ফেব্রিকটি তুলে দিয়েছেন, আগামীতে সেটির মান যেন আরও উন্নত হয়, তারা যেন শতভাগ সন্তুষ্ট হন, সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন তিনি। শরদিন্দু নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনাতেও এই ভাবনার ছাপ মেলে।
"আমি আর রিফাত আসলে শরদিন্দুর সার্ভিস কোয়ালিটি একেবারে টপ নচ লেভেলে নিতে চাই, আমাদের ডেলিভারি সিস্টেমকে আরও ফাস্ট করতে চাই। আমাদের কোনো ক্রেতা যদি একটি পোশাক কেনেন, তাহলে ছয়মাস পরেও যেন সেই পোশাকটির ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দিতে পারি। কারো যদি ডেলিভারির পর আমাদের পোশাক পছন্দ না হয়, তাহলে সে যেন নিকটস্থ আউটলেটে গিয়ে তা বদলে আনতে পারে সে ব্যবস্থাও আমরা ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।"
শরদিন্দুর সহ-উদ্যোগ হিসেবে ইতোমধ্যেই 'রয়েল বেঙ্গল' নামে চামড়াজাত ব্যাগের আরেকটি ভেনচার চালু করেছেন তারা। পরিকল্পনায় রয়েছে 'অজন্তা ইলোরা'ও- এখানে বাংলাদেশের নানা প্রান্তের কুটির শিল্পজাত পণ্য তুলে ধরার ইচ্ছা আছে তার।
দেশের অনেক মেয়ে যে স্বাধীন-স্বাবলম্বী জীবনের স্বপ্ন দেখেন, সুরভী খুব অল্পসময়ের মধ্যেই সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
ব্যবসায়ে ইচ্ছুকদের উদ্দেশ্যে সুরভীর পরামর্শ, "ব্যবসা করতে হবে বলেই ব্যবসায়ে নামা যাবে না। আগে দেখতে হবে আমি কোন কাজটি করতে পছন্দ করি। তারপর ঠিক করতে হবে আমার পণ্য কি হবে- বাজারে চাহিদা আছে এমন একটি পণ্য বা দক্ষতাকেই নিজের 'ইউনিক প্রোডাক্ট' হিসেবে বেছে নিতে হবে।"
সুরভী বলেন, "এতগুলো বছরে আমার জীবনে অনেক ভালো-খারাপ সময় পার করেছি, কিন্তু কখনোই শরদিন্দুর জার্নি থামাইনি। আমার ইচ্ছাশক্তিই আমাকে এটা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।"
"প্রতিটি মানুষের আগে নিজেকে বোঝা উচিত। আমার অনেক বন্ধুকে দেখেছি যাদের ব্যাংকার, সাংবাদিক, শিল্পী বা ফটোগ্রাফার হওয়ার যোগ্যতা ছিল। কিন্তু হুজুগে পড়ে ব্যবসায়ে নেমে তার কোনোদিকেই উন্নতি হয়নি, কারণ সে চিন্তাভাবনা করে এই পথে নামেনি। যারা জয়ী হয় তাদেরকে তো সবাই চেনে, কিন্তু যারা হারিয়ে যায় তাদের কথা কে মনে রাখে?", এই বলে নিজের কথার ইতি টানেন হাবিবা আক্তার সুরভী।