অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনিরই কি আসলে 'ঢাকাই পনির'?
ধরুন, আপনি পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়কের ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন। গলির মোড়ে তবে প্রায়ই চোখে পড়বে ছোট একটি টেবিলের উপরে সাদা গোলাকার বস্তু নিয়ে বিক্রেতা বসে আছেন। বাঁশের গোলাকার ঝুড়ির মধ্যে পলিথিন দিয়ে মুড়ে রাখা সাদা রঙের এই বস্তুই পনির। হাতে নিলে পনিরের মাঝ বরাবর ছোট ছোট ছিদ্র দেখতে পাওয়া যাবে। পনিরে লবণের মিশ্রণের জন্য এই ছিদ্রগুলো করা।
পুরান ঢাকার মেহমানদারিতে যেসব খাবার দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে তার মধ্যে পনির অন্যতম। নাস্তা হিসাবে পনিরের স্লাইস, পনিরযুক্ত বাকরখানির স্বাদ যে অতুলনীয়- তা খাওয়া মাত্রই ব্যক্তি স্বীকার করবেন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতে পনিরের সমুচাও জনপ্রিয়। লোকশ্রুতি আছে যে, ঢাকায় তৎকালীন নবাব পরিবারের মাধ্যমে পনির খাদ্য হিসাবে নাম লেখায়। তবে, কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় পনির এবং পনিরের তৈরী খাদ্যসমূহ দীর্ঘকাল ধরেই জনপ্রিয় ছিল।
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার নাম এক্ষেত্রে সবার প্রথমে উঠে আসবে। এখানকার পনির মোগল শাসকদের কাছে যেমন প্রিয় ছিল, তেমনি প্রিয় বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের। ঢাকার নবাবেরা পনিরকে জনপ্রিয় করেছিলেন। বর্তমানে রাজধানী জুড়ে 'পুরান ঢাকার পনির' বেশ চাহিদাসম্পন্ন। তবে, আদৌ কি ঢাকাতে 'ঢাকাই পনির' উৎপন্ন হয়? নাকি এটি শুধুই নামসর্বস্ব!
ঢাকার চানখাঁরপুল বাজারে প্রবেশ করতেই পনিরের পসরা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানকার স্থানীয় একটি বেকারিতে বসে বাকরখানি খাচ্ছিলাম। তারাই বললেন পনিরযুক্ত বাকরখানি একবার চেখে দেখতে।কয়েকটা পনিরের বাকরখানি খেয়ে, পনির সম্পর্কে জানতে চাইলাম। দোকানের মালিক বললেন, তারা এসব পনির নিজেরা তৈরি করেন না। এখানে পনির তৈরির একটি কারখানা রয়েছে। নিমতলীর সেই কারখানাতে সরেজমিনে গিয়ে যা জানতে পারি- তাতে যেন বিখ্যাত 'ঢাকাই পনিরের' আসল রহস্য উন্মোচিত হলো।
স্থানীয়দের কাছে জানতে পারি, নিমতলীর কারখানাটি পনিরের একটি 'গোডাউন' মাত্র। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন খুব ভোরে সেখানে পনির নিয়ে আসা হয়। এখান থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হকারদের মাধ্যমে পনির পৌঁছে দেয়া হয়। অনেকে পাইকারি হিসাবে কিনে নেন। তবে, সাত রওজার মোড়ে একজনের খোঁজ পাওয়া গেল যিনি নিজেই পনির তৈরী করে নিয়ে আসেন।
ঢাকাতে পনিরের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে মো. ফিরোজ আলমের সাথে কথা বলি। বিগত ১৫ বছর তিনি পনির ব্যবসার সাথে জড়িত। ব্যবসার স্মৃতি নিয়ে বেশ খোলাখুলিই আলোচনা করলেন। তার কাছ থেকে ধারণা পেলাম কিভাবে কিশোরগঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী খাবার ঢাকার নবাবী খাবারের সাথে একই টেবিলে চলে এলো!
ফিরোজ আলমের বাড়ি মানিকগঞ্জে। তবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কিশোরগঞ্জের পনির তৈরীর একটি কারখানাতে। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দেন। ততদিনে পনির তৈরীর আদ্যেপান্ত রপ্ত করে ফেলেছিলেন। ফলে ঢাকায় এসে নিজেই শুরু করেন পনিরের ব্যবসা।
ফিরোজ আলম বলেন, "ধবধবে সাদা আর নরম হয়ে থাকে অষ্টগ্রামের পনির। সেখানে লবণের আধিক্য থাকে না। অন্যদিকে ঢাকাই পনিরে লবণ ব্যবহৃত হয় তুলনামূলক বেশি। লবণের আধিক্যের জন্য এই পনির হাতে ধরলে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একই কারণে ঢাকাই পনির কিছুটা দানাদার আর ঈষৎ হলদে বর্ণের হয়ে থাকে। মূলত লবণের ব্যবহারই ঢাকাই পনিরকে অন্যান্য পনির থেকে আলাদা করেছে।"
জানতে পারলাম অষ্টগ্রামের সাদা পনিরই সারাদেশে বিখ্যাত। তবে অষ্টগ্রামের বাইরেও তৈরি হয় এ পনির। যেমন, চানখাঁরপুল বাজারে গলির ধারে যে পনির বিক্রি করা হচ্ছে তা মূলত দিনাজপুর থেকে আনা। বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন, শরীয়তপুর এবং পদ্মার কিছু চর অঞ্চল, মানিকগঞ্জের কিছু এলাকাতে পনির তৈরী করা হয়। ব্যবসায়ীরা সেগুলো সংগ্রহ করে ঢাকার বাজারে নিয়ে আসেন।
যে স্থানেই তৈরী হোক না কেন, পুরান ঢাকার বাইরে বিক্রি হলে তা হয়ে যায় অষ্টগ্রামের পনির। আর, পুরান ঢাকায় বিক্রি হলে তা চলে 'ঢাকাই পনির' নামে।
ঢাকায় বাণিজ্যিকভাবে পনির তৈরী না হবার প্রধান কারণ হিসাবে দুধের অপর্যাপ্ততা এবং দামের কথা উল্লেখ করেন ফিরোজ আলম। তার মতে ঢাকায় দুধের দাম বেশি, আবার সবসময় এত বেশি দুধ একসাথে পাওয়া মুশকিল। একইসাথে দুধের দাম এবং পর্যাপ্ত দুধের প্রাপ্যতার মাঝে সমন্বয় করা গেলে ঢাকাতেই বাণিজ্যিকভাবে পনির তৈরী করা সম্ভব হতো। এ কারণে ঢাকার বাইরে থেকে পনির তৈরী করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ফিরোজ আলম সপ্তাহেনপাঁচদিন কিশোরগঞ্জ থেকে কমপক্ষে ১০০ কেজি পনির তৈরী করে নিয়ে আসেন।
জানতে চাইলাম এগুলো সকলেই জানেন নাকি। ফিরোজ আলমের দাবি, "এগুলো প্রায় সবাই-ই জানেন। খুচরা হিসাবে বিক্রির সময় কেউ জানতে চাইলে আমরা বলে দিই এটি কোথা থেকে এসেছে। তবে, যখন বিভিন্ন বেকারিতে বিক্রি হয় তখন তা 'ঢাকাই পনির' হিসাবে পরিচিত হয়। একে বেচাবিক্রির একটি পদ্ধতি বলতে পারেন।"
পনিরের প্রস্তুতপ্রণালী
কিশোরগঞ্জে মহিষের দুধের প্রাচুর্যের কারণে আগে মহিষের দুধের পনিরই তৈরী হতো। তবে, এখন গরুর দুধের পনির বেশি মেলে। মহিষের দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত পনির সাধারণত ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ মাসে পাওয়া যায়। দুধের ছানার পানি ফেলে দিয়ে পনির তৈরি করা হয়। প্রথমে দুধটাকে ভালোভাবে ফোটাতে হবে। এরপর তাপ দেওয়া বন্ধ করে তাতে পরিমাণমতো ভিনেগার মিশিয়ে পুরো দুধকে ভালোভাবে নেড়ে ঢেকে রাখা হয়। দশ মিনিটের মধ্যে সমস্ত দুধ কেটে দুধের ছানা আর পানি আলাদা হয়ে যায়। এরপর পাতলা সুতি কাপড় দিয়ে ছানা ছেঁকে নিয়ে, পুটলি বানিয়ে কিছুক্ষণ রাখা হয়। ছানা থেকে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে গেলে তখন পুটলিটাকে একটা পাত্রের উপর রেখে ভারি কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয় ৫ ঘণ্টা। পানি সরে গিয়ে তৈরী হয়ে যায় পনির।
আর ঢাকাই পনির তৈরী করতে ফেটে যাওয়া দুধের ছানার অংশ ঝুড়িতে তুলে নিয়ে পানি ভালোভাবে ঝরিয়ে নিতে হয়। এরপর শক্ত অংশটি খুব ভালোভাবে কেটে গুঁড়ো করে দেওয়া হয়। এতে করে পনিরের মধ্যে দানাদার ভাব চলে আসে। গভীর ছিদ্র করে ঠেসে লবণ ভরে নিয়ে ঢেকে তার ওপরে ভারী ওজন চাপা দিয়ে রাখতে হবে।
ফিরোজ আলম জানান, ঢাকাই পনির তৈরী হতে একদিনেরও বেশি সময় প্রয়োজন হয়।
পনিরের দরদাম
পনির তৈরীর প্রধান উপাদান দুধ। বিভিন্ন পশুর দুধ থেকে পনির উৎপন্ন হতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত গরু এবং মহিষের দুধের পনির তৈরী করা হয়। অষ্টগ্রামের কিছু জায়গায় মহিষের দুধের পনির পাওয়া যায়। দিনাজপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জে গরুর দুধের পনির হয়ে থাকে। পনির উৎপন্নকারীরা পাইকারি দামে তথা সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা দরে দুধ কিনে থাকেন।
অষ্টগ্রামে ১ কেজি হয় পনির তৈরী করতে সাধারণত কমপক্ষে ১০ লিটার দুধ প্রয়োজন হয়। ব্যতিক্রমও আছে। যত বেশি দুধ, পনিরের মানও তত উন্নত হবে। ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে পনিরের সর্বনিম্ন দাম ৫৫০ টাকা। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই দাম ৬০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা পাইকারি হিসাবে ৫২০ টাকা দরে কিনে আনেন বলে জানা যায়। ছোট ছোট খন্ডেও পনির কিনতে পাওয়া যায়।
ফিরোজ আলম জানান, প্রতিদিন তিনি প্রায় ১৫ কেজি পনির বিক্রি করেন। মোটামুটি ৫৫০ টাকা দরে প্রায় আট হাজার টাকার পনির বিক্রি হয়। এই হিসাবে প্রতিদিন ১৫ কেজি পনির বিক্রি করে তার প্রায় ১৫০০ টাকা লাভ থাকে। অষ্টগ্রামের পনিরের বাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ফিরোজ আলম বলেন, "সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই ব্যবসাকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।"