আম্বানি, আদানিকে ছাড়িয়ে ভারতের শেষ নিজামই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি!
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের কথা বললে সবার আগে মাথায় আসে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, বিল গেটসদের নাম। উপমহাদেশের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় আসে মুকেশ আম্বানি, আদানি, বিড়লা, টাটাদের নাম। মুকেশ আম্বানির স্ত্রী নিতা আম্বানির পান করা এক বোতল পানির দামই অর্ধকোটি টাকা!
তবে তাদের কেউই ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির স্বীকৃতি পাননি।
ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন একজন রাজা। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণের কাছে হালে পানি পাবেন না বর্তমানের বহু ধনকুবের।
এই টাকার কুমিরের নাম, নবাব মীর ওসমান আলি খান, ব্রিটিশ ভারতের হায়দরাবাদের শেষ নিজাম।
মীর ওসমান আলি খানের জন্ম ১৮৮৬ সালের ৬ এপ্রিল। তিনি সিংহাসনে বসেন ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট, ২৫ বছর বয়সে। ১৯৪৮ সালে ভারতের অংশ করে নেওয়া হয় হায়দ্রাবাদকে। তার আগপর্যন্ত দু-দফায় হায়দ্রাবাদ শাসন করেছেন তিনি।
এক হিসাব বলছে, তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনীদের একজন। ১৯৩৭ সালে টাইম ম্যাগাজিন ওসমান আলি খানকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী হিসেবে উল্লেখ করে তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী শাসক
নিজামদের সম্পদের প্রধান উৎস ছিল গোলকুণ্ডার হীরের খনিগুলো। আঠারো শতকে বিশ্ববাজারে হীরার একমাত্র সরবরাহকারী ছিল হায়দ্রাবাদ সাম্রাজ্য।
হায়দ্রাবাদ ছিল ব্রিটিশরাজের অধীনস্থ সর্ববৃহৎ দেশীয় রাজ্য। অনন্য 'নিজাম' উপাধির অধিকারী ছিলেন মীর ওসমান আলি খান। হায়দ্রাবাদের আয়তন ছিল প্রায় সোয়া ২ লাখ বর্গকিলোমিটার—অর্থাৎ আজকের যুক্তরাজ্যের প্রায় সমান।
আর বর্তমান অর্থমূল্যে ওসমান আলি খানের রত্নসমূহের মূল্য হবে ১৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। ওসমান আলি খানি ১৮৫ ক্যারটের হীরা জ্যাকব ডায়মন্ড ব্যবহার করতেন। এই হীরা তিনি পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতেন!
নিজের সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন নিজাম। ১৯৪০-এর দশকের গোড়ার দিকে তার মোট সম্পদের অর্থমূল্য ছিল ২ বিলিয়ন ডলার—আজকের হিসাবে যা ২৩৬ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় ১ মার্কিন ডলার সমান ৩.৩ রুপি ধরে ভূসম্পত্তি ও অন্যান্য সম্পদ মিলে নিজামের মোট সম্পদের অর্থমূল্য ছিল ৬৬০ কোটি রুপি। সে হিসেবে ওই সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ১ শতাংশের সমান সম্পদের মালিক ছিলেন নিজাম।
নিজামের ব্যক্তিগত সম্পদের অর্থমূল্য ছিল প্রায় ১৫০.৪ মিলিয়ন ডলারের। ২০১৯ সালের হিসাবে যা ২৯৩৩৫৩৭৭৩৩ মার্কিন ডলার।
ভারত সরকার আজও হায়দ্রাবাদের নিজামদের রত্ন প্রদর্শন করে। নিজামের রত্নভান্ডারে মোট ১৮৩টি রত্ন আছে। তার মধ্যে ২ হাজার ক্যারেট (০.৪০ কেজি) ওজনের পান্না আর অনেকগুলো মুক্তা ছিল।
সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে রত্নপাথর, পাগড়ির অলঙ্কার, নেকলেস ও দুল, বেল্ট ও বাকল, কানের দুল, আর্মব্যান্ড, চুড়ি ও ব্রেসলেট, অ্যাঙ্কলেট, কাফলিঙ্ক ও বোতাম, ঘড়ির চেইন ও রিং, পায়ের আংটি ও নাকের আংটি।
১৯৪৭ সালে নিজাম রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে একটি টায়রা ও নেকলেসসহ হীরার গয়না উপহার দিয়েছিলেন। উপহার পাওয়া ব্রোচ ও নেকলেস রানি এখনও পরেন। নেকলেসটি হায়দ্রাবাদের নিজামের নেকলেস নামে পরিচিত।
হীরক-হৃদয়
হিতৈষী শাসক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন নিজাম ওরফে মীর ওসমান আলি খান। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও উন্নয়নে উদার হাতে দান করতেন তিনি।
৩৭ বছরের শাসনকালে নিজাম বিদ্যুৎ আনেন; নির্মাণ করেন রেলওয়ে, সড়ক ও বিমানবন্দর।
তিনি 'আধুনিক হায়দ্রাবাদের স্থপতি' হিসেবে পরিচিত। হায়দ্রাবাদ শহরের তিনি অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছেন। এসবের মধ্যে আছে ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি, ওসমানিয়া জেনারেল হসপিটাল, স্টেট ব্যাংক অভ হাায়দ্রাবাদ, বেগমপেট এয়ারপোর্ট, হায়দ্রাবাদ হাই কোর্ট। বড় আকারের বন্যার সময় শহর রক্ষার জন্য তার আমলে ওসমান সাগর ও হিমায়াত সাগর নামের দুটি জলাধার তৈরি হয়।
মানবদরদি হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল নিজামের। বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থ দান করেছেন তিনি।
এছাড়াও উদ্ভট সব অভ্যাসের জন্য নামডাক ছিল মীর ওসমান আলি খানের। নিজের মোজা তিনি নিজেই বুনতেন। তাছাড়া সিগারেট ধার নিতেন অতিথিদের কাছ থেকে।
সিংহাসন হারানোর পরও তিনি জনসেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৫১ সালে তিনি নিজাম অর্থোপেডিক হাসপাতাল (বর্তমান নিজাম'স ইন্সটিটিউট অভ মেডিকেল কলেজ—নিমস) নির্মাণ শুরু করেন। ওই হাসপাতাল তিনি মাত্র ১ রুপির বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য ভারত সরকারের কাছে ইজারা দেন। এছাড়া ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে জমি পুনর্বিতরণের জন্য ভিনোভা ভাবের ভূদান আন্দোলনেও নিজস্ব সম্পদ থেকে ১৪ হাজার একর জমি দান করেন তিনি।
নতুন দেশ ও পুরোনো রাজ্যের মৃত্যু
নিজাম প্রথমে ভারতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তিনি তার রাজ্যকে নবগঠিত ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে চাননি। কিন্তু ততদিনে তেলেঙ্গানা আন্দোলন ও রাজাকার নামে পরিচিত মৌলবাদী মিলিশিয়ার উত্থানের কারণে তিনি খর্বশক্তি হয়ে পড়েছেন।
১৯৪৮ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ রাজ্য আক্রমণ করে। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন নিজাম। হায়দ্রাবাদকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি হায়দ্রাবাদ রাজ্যের রাজপ্রমুখ ছিলেন। পরে রাজ্যটিকে ভাগ করে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৪৯ সন্তানের পিতা ছিলেন তিনি।
মৃত্যুর আগপর্যন্ত নিজাম রাজা কোঠি প্রাসাদেই থাকেন।
মীর ওসমান আলি খান মারা যান ১৯৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান। নিজামের শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে মসজিদ-ই জুদিতে তার মায়ের কবরে সমাধিস্থ করা হয়।
১৯৬৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নিজামকে কবর দেওয়া হয়। ওই দিনটিতে ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। তার সম্মানে সরকারি দপ্তরগুলো বন্ধ রাখা হয়। রাজ্যজুড়ে সমস্ত সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
নিজাম মিউজিয়ামের নথিতে বলা হয়েছে, মীর ওসমান আলি খানের মৃত্যুর দিন শহরের রাস্তা ও ফুটপাত ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোতে ছেয়ে গিয়েছিল। নিজামের মৃত্যুশোকে অসংখ্য নারী নিজেদের হাতে চুড়ি ভেঙেছিলেন। তেলেঙ্গানার নারীরা সাধারণত কোনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে ভারতীয় রীতি অনুসারে এ কাজ করেন।
নিজামের শবযাত্রায় ওই সময় ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়।
নিজামকে শেষ দেখা দেখার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রেন, বাস ও গরুর গাড়িতে চেপে সব ধর্মের লাখ লাখ মানুষ হায়দ্রাবাদে আসে। আনুমানিক ১০ লাখ মানুষ এসেছিল তার শেষযাত্রায়।