৭ এপ্রিল: দুই বঙ্গসন্তানের প্রথম উত্তর মেরু অভিযান—৯০ ডিগ্রী উত্তরে!
প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় পৃথিবীর দুর্গম সব স্থানে দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের সাড়া জাগানো ভ্রমণকাহিনী নিয়ে সংকলিত মনোমুগ্ধকর এক বই আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে স্থান পায়, এতদিন পরে সেই চমৎকার বইটির নাম আর খেয়াল নেই, কিন্তু প্রথম অধ্যায়টির নাম মনে হলে এখনো মনের অজান্তেই শিহরণ বোধ করি 'দুধের মত দেশের খোঁজে'। গ্রীনল্যান্ড আর তার উত্তরে হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত দুধসাদা প্রান্তর নিয়ে মনকাড়া বর্ণনা, আর সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে চির রহস্যে মোড়া, শত শত বছর ধরে অ্যাডভেঞ্চার পিপাসুদের আকর্ষণ ভৌগোলিক উত্তর মেরু। সেই প্রথম সুমেরু, আর্কটিক তুন্দ্রা, সেখানকার প্রাণিজগৎ আর অধিবাসীদের সাথে পরিচয়।
আরো অনেক পরে, কলেজে পড়ার সময় একদিন হঠাৎ দেখি বসার ঘরে বরফ, পেঙ্গুইন আর সীলদের ছবি নিয়ে ছাপানো দারুণ এক ক্যালেন্ডার। বাহ ! কোনো বিদেশী কোম্পানির বুঝি? না, এতো আমাদের দেশি কোম্পানি- জি কিউ গ্রুপ।
চমকের উপর আরো চমক, ছবির ফটোগ্রাফারও আমাদের দেশী- ইনাম আল হক! সম্ভবত প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অ্যান্টার্কটিকা ঘুরে এসেছেন। যাচ্চলে, গেল তো স্বপ্নটা ভেঙ্গে! সেই কবে থেকে দিবারাত্রি স্বপ্ন দেখছি- অ্যান্টার্কটিকা যাব, সুমেরু-কুমেরুতে পা রাখব, উঠব এভারেস্টের চূঁড়োয়, সবই করব প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে (বাচ্চাবেলার রহস্যে আকুল হওয়া আর বুকে কাঁপন তোলা সোনালী স্বপ্নগুলো যেমন হয় আর কি!) যাক গে, কি আর করা! তবে দারুণ খুশীও হলাম এই খবরে, ঘরকুনো বাঙ্গালীর অপবাদ খানিকটা হলেও তো ঘুচল। আনন্দ আরো দ্বিগুণ হল যখন জানলাম এই ইনাম আল হক দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত 'হারিয়ে যাচ্ছে পাখি' কলামের ফটোগ্রাফার। চারপাশের চেনা-অচেনা পাখির কি দারুণ ছবিই না তুলেন উনি! পাখি দেখা আমার একেবারে ছোট্টবেলার শখ, ওনার তোলা ছবি দেখেই কত পাখি চিনতে শিখেছি।
কলেজে পড়া অবস্থাতেই ক'জন বন্ধু মিলে সেই সব খবরের কাগজের কাটিং এক করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে 'পাখির জন্য ভালবাসা' শিরোনামে এক ছোট প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম। এইচএসসির পর ঢাকা আসলাম টোফেল করতে আর যেহেতু মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাই তাই দেশের বাইরে যেতে হবে এমন একটা লক্ষ্য কাজ করছিল মাথায়। এভাবেই পরিচয় মহাকাল মিলন ভাই আর বাংলাদেশ অ্যাসট্রোনমিকাল এসোসিয়েশনের সাথে। এলিফ্যান্ট রোডের অফিসে জমত দারুণ সব আড্ডা, এমনই এক পাঠচক্রে দেখা চিরতরুণ ইনাম ভাইয়ের সাথে।
প্রথমেই অভিযোগ করলাম প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অ্যান্টার্কটিকা যাবার স্বপ্নটা ভেস্তে দেওয়ার জন্য, উনি তো হেসেই খুন। বললেন, অ্যান্টার্কটিকয় এতো মানুষ গিয়েছে যে এখন আর দেশের পক্ষে প্রথম এটা কোন আবেদনই রাখে না, আর আমি গেছি তো কি হয়েছে, আপনি যাবেন আপনার জন্য, নিজের উপভোগের জন্য। তাইতো! সহজ, সরল ব্যাখ্যায় আশেপাশের চিরচেনা পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে দেন ইনাম ভাই। পাখি দেখা আর ভ্রমণের তীব্র নেশায় সখ্য ক্রমশই বাড়তে থাকে ইনাম ভাইসহ বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সবার সাথে। সোনালী উতল সময়ের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেওয়া আবেগময়ী দিনগুলোতে আমরা গিয়েছি সুনামগঞ্জের হাওরে, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জের যমুনার কাদা থিকথিকে চরে (যেখানে কেবল জলচর পাখিদের পায়ের ছাপ, মানুষের পদচিহ্ন প্রথম এঁকে দিই আমরাই), রাজশাহীতে পদ্মার পলিদ্বীপে, নিঝুম দ্বীপ, ভোলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে, ফরিদপুর, মাদারীপুরের জনবিরল বিলগুলোতে, পরবর্তীতে শীত-গ্রীষ্মের স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় নিশীথ সূর্যের নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডে। আর পৃথিবীর শীর্ষবিন্দু উত্তর মেরুতে, সেই কাহিনীই বলব আপনাদের আজ।
গত কয়েক বছর ধরে লেখাপড়ার কারণে আছি হাজার হ্রদের দেশ ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ড বিশ্বের উত্তরতম দেশগুলোর একটি সেই সাথে শীতলতমগুলোরও। ২০০৫ সালের গ্রীষ্মে ইনাম ভাই যখন নিছকই ভ্রমণ আর পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য ফিনল্যান্ডে এলেন, দুজন মিলে গ্রীষ্মের অবারিত সূর্যের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন বন, হ্রদ আর দুর্গম সব জলাভূমি ঘুরতে ঘুরতে মনে হল এত উত্তরেই যখন আছি, ঠাণ্ডার সাথে মোটামুটি একটা সখ্য হয়েই গেছে বিশ্বের সর্ব উত্তরে একবার ঝুঁকি নিয়ে ঘুরেই আসি না কেন। সর্ব উত্তর মানে ৯০ ডিগ্রি উত্তর, রহস্যের আঁকর, চিরদুর্গম সুমেরু!!
পরিকল্পনা হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার উত্তর মেরু যাব, এই প্রতিশ্রুতি নিয়েই ইনাম ভাই দেশে ফিরলেন। কিন্তু কাজে নামতেই বোঝা গেল ভবি এত সহজেই ভোলবার নয়, উত্তর মেরু যাওয়া স্বাভাবিক কারণেই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গুটিকয়েক কোম্পানি প্রতি বছর এপ্রিলে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে যায়, আর সেই খরচটাও আকাশছোঁয়া। কেবল মেরুতে দুদণ্ড দাঁড়াবার জন্য বারো থেকে পনের হাজার ইউরো, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা, তার উপর বিমানের টিকিট, ঠাণ্ডার পোশাক, বিশেষ জুতোসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ তো আছেই! মরার উপর খাড়ার ঘার মত ২০০৭ সালেই রাশিয়ান হেলিকপ্টার কোম্পানিগুলো খরচ অনেক বাড়িয়ে দিল, প্রায় দ্বিগুণ! ফলশ্রুতিতে খরচ একলাফে দাঁড়ালো প্রায় ২০ হাজার ইউরোতে।
উত্তর মেরু যাবার সম্ভাবনা যখন সুদূর পরাহত তখনই খোঁজ মিলল নর্থ পোল ম্যারাথনের। এই প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর ধরে বিশ্বের সর্ব উত্তরে শীতলতম ম্যারাথনের আয়োজন করে থাকে যা বিশ্বে সবচেয়ে কঠিন ও ব্যয়বহুল ম্যারাথনও!
ম্যারাথন হয় বেস ক্যাম্প বার্নেও তে যা সুমেরু বিন্দু থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। ম্যারাথনের পরে তারা প্রতিযোগীদের হেলিকপ্টারে করে মেরুতে নিয়ে যাবে! নর্থ পোল ম্যারাথনের খরচ ছিল জনপ্রতি ৯৩০০ ইউরো (বর্তমানে ১২,০০০ ইউরো), যা টাকার অঙ্কে অনেক বড় হলেও অন্যান্য অনেক কোম্পানির তুলনায় ছিল বেশ খানিকটা কম। কিন্তু মূল শর্ত ছিল ম্যারাথনের ৪২,১৯৫ কিমি (২৬,২ মাইল) অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। ইনাম ভাই আর আমি তো একপায়ে খাড়া। ম্যারাথন করতে যতই কষ্ট হোক অবশ্যই করব (জীবনের প্রথম ম্যারাথন, তাও বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন), তাতেও যদি সুমেরু যেতে পারি, কেন নয়? যদিও সেই খরচটুকুর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে (পুরোটাই নিজেদের পকেট থেকে, তাও আমার বড় ভাই তানভির অপু আমাদের দুইজনের মেরু অভিযানের প্রায় সমস্ত পোশাক স্পন্সর করেছিল)।
অবশেষে ২০০৭-এর ২ এপ্রিল নরওয়ের রাজধানী অসলোতে শুরু হল আমাদের মেরু অভিযান, ইনাম ভাই একদিন আগেই ঢাকা থেকে চলে এসেছিলেন, আমি আসলাম হেলসিংকি থেকে। সেই দিনই রওনা দিলাম আমাদের গ্রহের সর্ব উত্তরের জনবসতি স্পিটসবের্গেনের উদ্দেশ্যে। ৭৮ ডিগ্রী ল্যাটিচিউডে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বের বুকে এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। প্রায় আয়ারল্যান্ডের সমআয়তনের এই পর্বত আর হিমবাহময় ভূখণ্ডে মানব সন্তানের সংখ্যা মাত্র হাজারখানেক হলেও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং বিরল স্থলচর শ্বাপদ শ্বেত ভালুকের সংখ্যা প্রায় চার হাজার ! এখান থেকে আমাদের গন্তব্য ক্যাম্প বার্নেও যা ৮৯ ডিগ্রী উত্তরে অবস্থিত। যাবার একমাত্র ঊপায় ছিল সোভিয়েত আমলের তৈরি আন্তনোভ বিমান যা ভাসমান বরফপিণ্ডে অবতরণ ও সেখান থেকে উড়তে সক্ষম।
সুমেরুকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা মরুভূমি, চমকে উঠবার মতই কথা। উত্তর মহাসাগরে ভাসমান এই বিশাল বরফ প্রান্তর যা হয়ত স্থান বিশেষে মিটারখানিকও পুরু নয়, নিচেই বহমান প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হিমশীতল উত্তর মহাসাগর, এখানে মরুভূমি! বিশেষ করে জলের অভাব যেখানে একেবারেই নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল একটাই রং দৃশ্যমান– সাদা ! মাইলের পর মাইল বরফের স্তুপ, বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি, আদিগন্ত ছোঁয়া সেই তেপান্তর কেবলই সাদা। আর গ্রীষ্মসূর্যের আবির্ভাবে সেই কিরণ আর বরফের সম্মিলিত ছটায় সানগ্লাস ছাড়া চোখ খোলায় এক বিষম দায়। ভুলটা ভাঙ্গালেন ইনাম ভাই, জানালেন মরুভূমি মানে যে জলের অভাব তা তো নয় বরং প্রাণের অভাব, প্রাণ না থাকলেই মরুভূমি। এমনকি মহাসাগরের মাঝেও মরুভূমি আছে! কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সারাদিন সূর্যের নিচে থেকে হাড়ে হাড়ে বুঝলাম কোন জীবনের চিহ্ন নেই একেবারেই। কোন প্রাণী, পাখি, কীট-পতঙ্গ, এমনকি একটা ঘাস, কিছুই না ! মনের অজান্তেই ভিতর থেকে শিউরে উঠি, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, প্লেন ক্রাশ বা অন্য কিছু, সাক্ষাৎ মৃত্যু। এরচেয়ে ভয়াবহ সাহারা বা আটাকামা মরুভূমিতে আটকা পড়াও অনেক ভাল, সেখানে অন্তত ক্ষুদে পোকামাকড় থাকে, সেই সাথে হয়ত উটের কাফেলা, মরূদ্যান, নিদেনপক্ষে ক্যাকটাস, আর এখানে প্রাণ জিনিসটাই অনুপস্থিত।
সুমেরুর যে জিনিসটাতে সবচেয়ে বেশী অভিভূত হয়েছি তা হল সেখানকার গ্রীষ্মের চিরসূর্য। বইয়ে তো সেই শিশুকাল থেকেই পড়ে আসছি আর্কটিকে সারা বছরের ছয় মাস দিন, ছয় মাস রাত। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয় সারা বছরে মাত্র একবার করে। প্রকৃতির সেই অসাধারণ খেয়াল এবার চাক্ষুষ দেখলাম, সে এক আমরণ স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সূর্য দিগন্তের বেশ উপরে, তবে মাঝ আকাশ থেকে অনেক নিচে, চারিদিকে ঝকঝকে আলো, একবারে বাংলাদেশের বৈশাখের সূর্য। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক, যদি না দুর্ঘটনাক্রমে কোন বেরসিক মেঘদল সূর্যদেবতাকে ঢাকার দুঃসাহসী প্রচেষ্টা না চালায়। আর সূর্য সে তো চতুর্দিকেই! হ্যাঁ! সময়ের সাথে সাথে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সবদিকেই সূর্য পরিভ্রমণ করছে, সে এক অবিশ্বাস্য ব্যপার, আর এমনটা আমরা দেখেছিলাম পুরো ৭২ ঘণ্টা, ৩টি দিন আঁধার নামের কোন কিছু অস্তিত্ব ছিল না আমাদের জগতে বা মানসে।
ক্যাম্প বার্নেও থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার সাথে সাথে এক অজানা রোমাঞ্চে মন দুলে উঠল। অবশেষে মনের কোণে আশৈশব লালিত স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে, আর ৩০ মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের গ্রহের সর্ব উত্তরের প্রান্তসীমায়। সারা পৃথিবীর সমস্ত ভ্রমণপিপাসু আর রোমাঞ্চপ্রিয়দের কয়েকশ বছর ধরে সমান রকম রহস্যের হাতছানি দিয়ে ডাকে উত্তর মেরু (জুলভার্ন তার বিশ্বখ্যাত কল্পনার ঝাঁপি খুলে ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসকে নিয়ে যান মেরু বিন্দুতে যেখানে ছিল এক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি)। মার্কিন ন্যাভাল কমান্ডার রবার্ট এডউইন পিয়েরি তার ইন্যুইট (এস্কিমো) সহযাত্রীদের নিয়ে সুমেরুতে পা রেখেছিলেন ১৯০৮ সালের ৬ এপ্রিল, সে তো প্রায় শতবর্ষ হতে চলল, তারপরও মেরুর প্রতি মানুষের সুতীব্র আকর্ষণ এখনো চরমভাবে বিদ্যমান। ম্যারাথনের পরে রাশিয়ান MI-৮ হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে আমাদের যাত্রা মেরু পানে, বিশ্বের সবপ্রান্ত থেকে আসা সহযাত্রীরা গাদাগাদি করে বসতেই কপ্টারের মোটর ঘোরা শুরু করল, এর মধ্যেই খোলা প্রান্তরের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় আমাদের অবস্থা ত্রিশঙ্কু (বাইরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলেও এই ফাঁকা তেপান্তরে তা অনুভূত হত মাইনাস ৬০-এর মত, তখন তাও ভরা গ্রীষ্ম, চিন্তা করুন পূর্ণ শীতে!!)। কপ্টারের ইঞ্জিন গরম হতে যে কয় মিনিট সময় লাগে তাতেই হাত-পায়ের আঙ্গুল জমে একেবারে বরফ হবার জোগাড়। সবাই সেই স্বল্প পরিসরেই হাত পা ঝাঁকিয়ে নানা রকম ম্যাসেজের মাধ্যমে রক্ত চলাচল অব্যাহত রাখতেই অস্থির, সে এক অবর্ণনীয় দুরাবস্থা। যাক সে কথা- ইঞ্জিন গরম হবার সাথে সাথেই কপ্টারের ভিতরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে এল।
বরফাচ্ছাদিত প্রান্তরের অল্প ওপর দিয়েই উড়তে থাকল হেলিকপ্টার। বিশাল সফেদ এই ক্যানভাসের উপর দিয়ে আধা ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে যখন আমাদের আধুনিক রথ থামল তখন পাইলট রুমের জিপিএস-এ বলছে আমাদের অবস্থান অক্ষাংশ ৮৯ ডিগ্রী ৫৯,৯৭৬ মিনিট, অর্থাৎ মেরু বিন্দু থেকে আমরা মাত্র কয়েক মিটার দূরে, কিন্তু এমনটা বেশীক্ষণ থাকবে না, এর বরফপ্রান্তর জলের ওপর ভাসমান বিধায় বরফস্তরটি সর্বদাই অবস্থান পরিবর্তনশীল, এখন যেখানে আসছে, হয়ত মিনিট পনের পরেই মেরুবিন্দু উপরের বরফখণ্ড সরে যাবে মিটার কয়েক ডানে বা বামে! একে একে মোহাবিষ্টের মত কপ্টার থেকে বের হয়ে চির বরফের রাজ্যে পদচিহ্ন একে দিলাম সবাই, নিশিতে পাওয়া মানুষের মত গেলাম আরো কয়েক মিটার উত্তরে, এই গ্রহে কেবল মাত্র দুইটি মেরু- সুমেরু ও কুমেরু, আর আমরা এখন সুমেরুতে!!! অবশেষে ২০০৭ সালের ৭ এপ্রিল, রবিবার, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬,১৫, গ্রিনিচ সময় দুপুর ১২,১৫তে আমরা দুই বঙ্গসন্তান আমাদের গন্তব্য ৯০ ডিগ্রী উত্তরে পৌঁছালাম, উড়ল সেখানে প্রথমবারের মত লাল-সবুজ পতাকা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশেই প্রায় জীবনের পুরোটা কাটিয়েছি আমি এবং ইনাম ভাই, নিরক্ষরেখার কাছেই অবস্থিত আমাদের দেশের উপর দিয়েই চলে গেছে কর্কটক্রান্তি, চিরসূর্যের দেশের মানুষ, আর আজ কোন অজানা দুর্দম আকর্ষণে হাজির হয়েছি এই বরফ রাজ্যে! এই অনন্য অনুভূতি, অসাধারণ অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই, তাই সে কল্পনার ভার পাঠকের উপরেই ন্যস্ত থাকল।
সহযাত্রীদের মাঝে ইতিমধ্যেই নানান ভঙ্গিমায় ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেছে, কে কার জাতীয় পতাকা নিয়ে কত বিচিত্র ভঙ্গিতে ছবি তুলতে পারে তার এক মজার প্রদর্শনী। এর মধ্যে সবাইকে টেক্কা দিল মালয়ী বন্ধু সিউ কং, ঐ প্রবল হাড় জমানো ঠাণ্ডার মাঝেই শরীরে এক চিলতে আণ্ডারওয়্যার রেখে সব কাপড় খুলে ফেলে মালয়েশিয়ার পতাকা নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে বলল- আমার স্ত্রীকে দেখাতে হবে কি না যে আমি এক শক্তিশালী পুরুষ! এর মধ্যে সবচেয়ে শোরগোলকারী আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মেক্সিকান রবার্ট হাতে ক্যামেরা তুলে দিয়ে বলল ঠিক মেরুতে চুমু খাচ্ছি এমন অবস্থার একটা ছবি তুলে দেও না Amigo ! এই মজার অনুরোধই বা ফেলি কি করে।
কয়েকজন আবার বোতলে করে মেরুর বরফ নিয়ে নিল, আজীবনের স্মারক হিসেবে দেশে নিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু সে বরফ তো যাত্রা পথেই গলে জল হয়ে যাবে, তখন! গম্ভীর মুখে তাদের জবাব- বাড়ি যেয়েই বোতল ফ্রিজে রেখে দিব, ব্যস জল জমে আবার বরফ!
তখন তাপমাত্রা মাইনাস ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মেরু প্রদেশের এই এক বিশেষত্ব এখানে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয় খুব দ্রুত, তা ও ভাল আমাদের কোন ব্লিজার্ডের (মেরু ঝড়) মুখোমুখি হতে হয়নি। ছবি তোলার পালা সাঙ্গ করে শেষবারের মত চাইলাম এই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের দিকে, সুমেরুর চিরসূর্য আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। সহযাত্রীদের দেখি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেরুটাকে উপভোগের চেষ্টায় মশগুল। দূর থেকে দেখি ক্যামেরা হাতে দৃঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন ইনাম ভাই, কাছে যেতেই আবেগভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন- ভাবতে পারেন এই জায়গাটি আমাদের এত দিন দেখা হয় নি, হয়ত এটা না দেখেই মারা যেতে পারতাম। অবশেষে পাইলটের তাড়া খেয়ে কপ্টারে চাপলাম সবাই, মোটর ঘোরা শুরু করল ধীরে ধীরে, অবিরাম গতিতে, আমরা প্রত্যেকেই শেষবারের মত জানালায় মুখ চেপে শেষ দৃষ্টি বোলালাম এই মোহময় কুহক ডাকা বরফ প্রান্তরে। এবং জানি শেষ পর্যন্ত একটাই চিন্তা কাজ করছিল সবার মনে, আবার ফিরে আসব জীবনের কোন প্রান্তে এই ভয়ংকর সুন্দর চিরবন্ধুর অথচ আকর্ষণী ৯০ ডিগ্রী উত্তরে। আবার সেই সাথে মনের গহনে উঁকি দিচ্ছে ৯০ ডিগ্রী দক্ষিণে যাবার সুতীব্র ইচ্ছাটাও !