টুকরো কাপড়, সুঁই-সুতো আর প্রকৃতির ভালোবাসায় 'খুঁত'
টুকরো কাপড় দিয়ে জোড়াতালি, সুতোর ফোঁড়, বাহারি ছাপা-নকশা আর প্রকৃতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখার প্রয়াস- এই চারে মিলে ফ্যাশন ব্র্যান্ড 'খুঁত'। বর্তমান প্রজন্মের নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষের কাছে খুঁতের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। কি এমন আছে খুঁতের পোশাকে? তার চেয়ে বরং প্রশ্ন করুন, কি নেই! একখানা সাদামাটা সুতি শাড়ি বা জামাকে ব্লকপ্রিন্ট, সুতার কাজ, জোড়াতালির নকশা, কখনোবা ভেজিটেবল ডাই, পুঁতি, আয়না, সুতোর ঝালর সবকিছু দিয়ে অনন্য করে তোলে খুঁত।
'আমরা সবকিছু নিখুঁত চাই, কিন্তু প্রকৃতির দিকে ও আশেপাশে তাকালে বোঝা যায় কোনোকিছুই নিখুঁত নয়'- এমন চিন্তা থেকে 'খুঁত' এর জন্ম। খুঁত থাকলেই খারাপ- পোশাকের মাধ্যমে সমাজের এই ধারণাকে বদলে দিতে চেয়েছেন ব্র্যান্ডের দুই প্রতিষ্ঠাতা উর্মিলা শুক্লা ও ফারহানা হামিদ। তাদের মতে, হাতে তৈরি কোনোকিছুই মেশিনে তৈরি পণ্যের মতো নিখুঁত হবে না। সেলাইয়ের ফোঁড় এদিক-সেদিক হবে, রঙ এর তারতম্য হবে। কিন্তু এই খুঁতটুকুই সেই পণ্যের নিজস্বতা। এটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে খুঁতই হবে সৌন্দর্য।
খুঁতের সত্ত্বাধিকারী দুজনেই ডিজাইনার ও শিল্পী। ব্র্যান্ড হিসেবে খুঁত প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনলাইন পেজ বা শোরুম তৈরির চিন্তা নয়, বরং নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষুধা থেকে শাড়ি-গয়নার নকশা করতে শুরু করেন দুজনে। বন্ধুদের জন্যও বানাতেন পোশাক। প্রচুর মানুষের কাছ থেকে সেগুলোর প্রশংসা পাওয়ার পর একদিন অনলাইন পেজ খোলার ভাবনা আসে তাদের। ২০১৮ সালের পহেলা বৈশাখে একটি সোহাগী মালা এবং 'লাল' নামের একটি শাড়ি নিয়ে প্রথম অনলাইনে আসে খুঁত।
খুঁতের প্রতিটি পোশাকেরই আছে আলাদা আলাদা নাম। জারুল, সুরমা, মাধবীলতা, মায়াবতী, পাতা, আকাশি, জরি, কঙ্কা, মঞ্জিল, বাহারীসহ অসংখ্য সুন্দর নামে অলংকৃত করা হয়েছে পোশাকগুলোকে। এ ব্যাপারে ফারহানা হামিদ জানান, একটি শাড়ি দেখার পর অথবা সেটি বোনার সময় ডিজাইনারদের মাথায় যে ভাবনা আসে কিংবা প্রকৃতির যে দিকটির সাথে মিল খুঁজে পান, তার উপর ভিত্তি করে পোশাকের নামকরণ করা হয়।
রিসাইক্লিং এবং প্যাচওয়ার্ক
হালফ্যাশনে সবাই যখন প্রতিনিয়ত নতুন পোশাক গায়ে চড়াতে ব্যস্ত, খুঁত তখন ভাবছে কাপড়ের পুনঃব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে। সেই থেকে তারা নিজেদের পণ্যে যুক্ত করে নতুন একটি ধারা- প্যাচওয়ার্ক। কাপড়ের টুকরো জোড়াতালি দেওয়ার যে নকশা, সেটির কেতাবি নামই হলো প্যাচওয়ার্ক। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের নারীরা কাপড় জোড়া দিয়ে এবং সেলাই করে কাঁথা বানিয়ে আসছে। প্যাচওয়ার্ককে বলা যায় তারই একটি বর্ধিত সংস্করণ।
ইতিহাসে জানা যায়, ৫০০০ বছর আগেও এ ধরনের কাজ হতো কাপড়ে! মধ্যযুগে যোদ্ধাদের বর্মের ভেতর উষ্ণতা বজায় রাখতে দেওয়া হতো জোড়াতালির কাপড়। বিশ শতকে চরম অর্থনৈতিক মন্দার সময় ব্যবহৃত পুরোনো কাপড় জোড়া দিয়ে প্যাচওয়ার্কের সাহায্যে আরামদায়ক কুইল্ট তৈরি হতো আমেরিকায়। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং নেপালেও বহুদিন যাবত চলছে এই জোড়াতালির ফ্যাশন।
খুঁত তাদের প্রায় প্রতিটি পণ্যে যুক্ত করেছে প্যাচওয়ার্কের নকশা। শাড়ির পাড়- আঁচল থেকে শুরু করে স্কার্ট, পাঞ্জাবি, চাদর, জ্যাকেট, কুইল্ট, স্কার্ফ, ব্লাউজ এমনকি বসার মোড়া, টুল, কুশন কভারের মতো গৃহস্থালি পণ্যেও রয়েছে প্যাচওয়ার্ক। এর আগে যাত্রা, দেশালের মতো ব্র্যান্ডগুলো প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কিছু কাজ করলেও, অনলাইনে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে খুঁত।
কিন্তু খুঁতের ডিজাইনারদের মাথায় প্যাচওয়ার্কের ভাবনা এলো কিভাবে? ফারহানা হামিদ জানালেন সেই গল্প।
"শ্রমিক শ্রেণী, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা বা আমাদের বাসায় যারা কাজ করতে আসেন, তারা দেশি জনি প্রিন্টের শাড়ি বা অন্যান্য রংচংয়ে শাড়ি পরতেন। আমার আর শুক্লার এগুলো খুবই ভালো লাগতো এগুলো। আমরা মাঝেমাঝে এসব শাড়ি পরে ঘুরতে বেরোতাম। শাড়িগুলো খুব নরম আর আরামদায়ক। কিন্তু আধুনিক ছেলেমেয়েরা এসব শাড়ি পরতো না। হয়তো শ্রেণীবৈষম্যের কারণেই কমদামি শাড়ির দিকে আগ্রহ ছিল না তাদের। তখন আমরা ভাবতাম কিভাবে এই শাড়িগুলো ব্যবহার করে ফিউশন তৈরি করা যায়," বলছিলেন তিনি।
খুঁতের প্যাচওয়ার্কে দেশি প্রিন্টের নতুন শাড়ি ব্যবহৃত হলেও, তারা এটিকে রিসাইকেলড বলে থাকেন। কারণ ফ্যাক্টরিতে তৈরির সময় যেসব শাড়িতে দাগ লাগে বা একটু ছিঁড়ে যায়, সেগুলো রিজেক্ট বা বাতিল হিসেবে ফেলে রাখা হয়। এই শাড়িগুলো এনে প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে খুঁত। কারখানায় এতগুলো শাড়ি বানাতে গিয়ে প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে।
ফারহানা হামিদ বলেন, "প্রথমে ভেবেছিলাম রঙচঙে হওয়ায় প্যাচওয়ার্কের পোশাক বয়স্ক মানুষেরা পরবেন না। কিন্তু বাইরে বেরোলে যখন দেখি নানি-দাদিদের বয়সীরাও আমাদের প্যাচওয়ার্ক ব্লাউজ পরে ঘুরছেন, এটা আমাদের জন্য এক পরম পাওয়া।"
তাঁতি থেকে গ্রাহকের হাতে
খুঁতের শাড়ি তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের সুতা ব্যবহার করা হলেও সুতি তন্তুই প্রাধান্য পায় সবচেয়ে বেশি। টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, সিলেট, যশোর এবং ঢাকার জামদানি পল্লিতে বোনা হয় খুঁতের শাড়ি। প্রতিটি তাঁতে সুতার ধরনও হয় আলাদা। যেমন ঠাকুরগাঁওয়ের সুতা খসখসে, আবার টাঙ্গাইলের সুতা হয় একেবারে মিহি। শাড়ি বুনতে দেওয়ার সময় তাঁতিদেরকে নির্দিষ্ট রং-নকশা বলে দেন খুঁতের ডিজাইনাররা। একরঙা শাড়িতে কারুকাজ করার পাশাপাশি, সরাসরি তাঁতিদের বোনা শাড়িও রয়েছে খুঁতের সংগ্রহে। এগুলোকে বলা হয় ডবি শাড়ি। খুঁতের মায়াবতী, চন্দনা, সুরমাসহ আরও কিছু শাড়ি সরাসরি তাঁতিদের নকশাই গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তবে বাকি শাড়িগুলোর ক্ষেত্রে তাঁতির কাছ থেকে আসার পর ব্লকের কারিগরের কাছে পাঠানো হয়। সেখান থেকে শাড়িগুলো যশোর ও রাজশাহীতে হাতের কাজের কারিগরদের কাছে যায়। তারপর আবার ঢাকা আসে এবং ধুয়ে ইস্ত্রি করে ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়।
হাতের কাজ, ব্লক ও সেলাইয়ের ক্ষেত্রে খুঁতের রয়েছে নিজস্ব কারিগর। যশোর-রাজশাহীর কিছু গ্রামে এসব কারিগরদের বসবাস। তাদের অধীনে আবার কাজ করেন আরও ৪/৫ জন। এভাবে একটি ছোট এলাকার পাশাপাশি কয়েকটি বাড়িতে শুধু খুঁতের পণ্য নিয়েই কাজ করা হয়। আর প্যাচওয়ার্কের কাজ হয় ঢাকার আদাবরে অবস্থিত খুঁত এর অফিসে।
ব্যবসায়িক প্রসার
খুঁত এর সত্ত্বাধিকারী ফারহানা হামিদ ও উর্মিলা শুক্লা নিজেদের পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী বলে মানতে নারাজ। কারণ তারা খুঁত নিয়ে কাজ করেন শিল্প ও শৈল্পিক সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা থেকে, দেশীয় শিল্প নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার আগ্রহ থেকে।
ফারহানা হামিদ বলেন, "খুঁত ব্যবসার চেয়ে অনেক বেশি গ্রাহকের ভালোবাসায় চলে। একজন যখন টাকা দিয়ে আমাদের শাড়ি কেনেন, তিনি শুধু টাকাই দেন না; আমাদেরকে ভালোবাসাও দেন। শুধুমাত্র পণ্যের জন্য না, সেই ভালোবাসার টানেই ক্রেতা আবার আমাদের কাছে ফিরে আসেন।"
তবে গত ৫ বছরে অনেকটা প্রসার হয়েছে এই দেশীয় ব্র্যান্ডটির। মাত্র তিনজন মিলে যাত্রা শুরু করা খুঁতে এখন অফিস স্টাফ, শিল্পী-কারিগর মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫০-৬০ জন। ২০১৯ সালে ধানমন্ডি ৯/এ তে চালু হয় খুঁতের শোরুম।
ফারহানা হামিদ জানালেন, প্রতি মাসে ২০০০-২৫০০ পিস শাড়িসহ মোট ৫০০০ পণ্য বিক্রি হয় তাদের। অনলাইন-অফলাইন দুদিকেই আছে সমান জনপ্রিয়তা।
খুঁতে শাড়ি রয়েছে ১৩০০-১৫,০০০ টাকার মধ্যে; অন্যদিকে কামিজ-টপ ১০০০-৫০০০ টাকা , ব্যাগ ৩০০-৩০০০ টাকা, বাচ্চাদের জামা ৫০০-৫০০০ টাকা এবং ছেলেদের পোশাক ১২০০-৩৫০০ টাকার মধ্যে। এর মধ্যে অ্যান্ডি সিল্ক সুতা সবচেয়ে দামি হওয়ায় এই সুতায় তৈরি পোশাকের দাম সবচেয়ে বেশি।
তবে করোনাকালে খুঁতের বাড়ি বন্ধ থাকায় কিছুটা ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কর্তৃপক্ষ। সে সময় নতুন শাড়ি বানানো বা স্টকের শাড়ি ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তখনো ক্রেতাদের পাশে পেয়েছে খুঁত। লকডাউন তুলে দেয়ার পরপর ক্রেতারা পোশাক কিনতে শুরু করায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে গেছে বলে জানান খুঁতের মালিকেরা।
ক্রেতার চাহিদা
বলাই বাহুল্য, এই মুহূর্তে শাড়িপ্রেমী নারীদের কাছে খুঁতের চাহিদা তুঙ্গে। পছন্দসই শাড়ি না পেয়ে প্রায়ই অভিযোগ করতে দেখা যায় ক্রেতাদের। কিন্তু খুঁতের মালিকেরা জানালেন, প্রচুর চাহিদা সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ শাড়ি বাজারে না আনার কারণ হচ্ছে তাতির স্বল্পতা। এই মুহূর্তে তাদের অধীনে কাজ করছেন ১৫ জন তাঁতি এবং প্রতিটি শাড়ি ২০০ পিস করে বুনতে দেন তারা। এর বেশি বুনতে দিলে সেটা তাঁতিদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে যায়। শাড়ির একই বুনন-সুতার মান নিশ্চিত করতে না পারলে নতুন তাঁতিদের সাথে কাজ করে না খুঁত।
দেশের বাইরে কলকাতায় বেশ চাহিদা রয়েছে খুঁতের পণ্যের। এরই মধ্যে দুইবার কলকাতায় মেলার আয়োজন করেছে খুঁত। কলকাতা থেকে কেউ বাংলাদেশে এলে অনেকেই তাদের বন্ধুবান্ধবের জন্য হাত ভরে কিনে নিয়ে যান খুঁতের শাড়ি। এমনকি দেশের বাইরে শাখা খুললেও সেটা প্রথম কলকাতায়ই হবে বলে জানান ফারহানা হামিদ।
খুঁতের একজন ক্রেতা তাসনুভা মিম বলেন, "খুঁতের শাড়ির পাড়ে যে নকশা সেটা আমার কাছে বেশ ভালো লাগে। আর শাড়িগুলোর রং ভীষণ সুন্দর। আর সুতি হওয়াতে পরতেও খুব আরামদায়ক। একটা অন্য রকম নিজস্বতা রয়েছে খুঁতের শাড়িতে।"
আরেক ক্রেতা অনন্যা জাহান বলেন, "খুঁতের শাড়ি বরাবরই টানে আমাকে। যখন ওদের শাড়ি পরি, একটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা-প্রশান্তি কাজ করতে থাকে নিজের ভিতর। যদিও আরও অনেক আইটেম আছে ওদের, তবে শাড়িটাই আমাকে টানে বেশি। তবে এটা ঠিক, কখনো কখনো দামটা বেশি হওয়ায় পছন্দের অনেক শাড়িই কেনা হয়ে ওঠেনা।"
ক্রেতাদের অভিযোগ আসে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ফারহানা বলেন, "এক হাজার মানুষ পণ্যের সুনাম করলে, একজন তো অভিযোগ করেছেই। প্রতিটা অভিযোগই আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি, সেটা শুধরে নিয়েছি। দশটা শাড়ির মধ্যে একটায় তো ভুল হতে পারে মাঝেমাঝে। তবে আমাদের ক্রেতারা সেই অভিযোগটুকুও এমনভাবে করেন যেন ঘরের মানুষকে বলছেন, তারা কখনোই খারাপ আচরণ করেন না।"
নারীর ক্ষমতায়ন
হাতের কাজের পণ্য নিয়ে কাজ করায় সঙ্গত কারণেই খুঁতে নারী কর্মীর সংখ্যা বেশি। আর মালিকানায় যে দুজন নারী আছেন তা আগেই বলা হয়েছে। নারী হওয়ার কারণে শুরু থেকেই আশেপাশের প্রচুর নারীর সমর্থন পেয়েছেন দুই উদ্যোক্তা। খুঁতের অধীনে কর্মরত নারীদের জন্যেও একটি ভরসার জায়গা তৈরি করেছেন দুজনে। এমনকি খুঁতের শোরুম ইনচার্জ হিসেবেও আছেন একজন নারী।
ফারহানা বলেন, "আমরা সবাইকে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য সম্মান দিতে চেয়েছি, জেন্ডার বৈষম্যের জায়গা নেই এখানে।"
বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তাকে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে হলেও, ফারহানা ও শুক্লার ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভালোবাসা পেয়েছেন তারা। দুজনেই পরিবার থেকে প্রচন্ড ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন, সহায়তা পেয়েছেন।
ফারহানা হামিদের ভাষ্যে, "পুরুষতান্ত্রিকতার বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি আমাদের। শুক্লাদি যখন খুঁত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তার স্বামী তখন সংসার-বাচ্চাকে সামলেছে। নারী হিসেবে আমাদের উপর কোনো কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। আমাদের মতো সাপোর্ট অন্য নারীরা পেলে তারা দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যেতে পারতো।"
শুধু তাই নয়, সমসাময়িক খ্যাতনামা অনলাইন ব্র্যান্ডগুলোকেও পাশে পেয়েছে খুঁত। খুঁতের সত্ত্বাধিকারীরা মনে করেন, উদ্যোক্তারা তাদের পাশে বন্ধুর মতো দাড়িয়েছেন বলেই মিলেমিশে সবাই নিজ নিজ ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও লক্ষ্য
সারা বাংলাদেশ ঘুরে আরো বেশি হাতে তৈরি পণ্য খুঁজে আনতে চায় খুঁত। শীতল পাটি, সোনার গহনা, পুতুল ইত্যাদি পণ্য এবং এসবের কারিগরদের এই ব্র্যান্ডটির সাথে যুক্ত করতে চান খুঁতের সত্ত্বাধিকারীরা। এছাড়া, ভবিষ্যতে গৃহস্থালি পণ্য ও বাচ্চাদের পোশাকের সম্ভাব আরও সমৃদ্ধ করার ইচ্ছাও রয়েছে তাদের।
একটি দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে খুঁতের মূল লক্ষ্য একটাই- উদ্যোক্তারা চান, মানুষ অনেক বেশি দেশীয় পোশাক পড়ুক। ফারহানা হামিদ বলেন, "এশিয়ায় নেপাল থেকে বাইরে গেলেই হ্যান্ডমেইড জিনিসের চল খুব কম। আমাদের এত অসাধারণ তাঁতশিল্প ও কারিগর থাকা সত্ত্বেও মানুষ মেশিনমেড জিনিসের দিকে ঝুঁকছে। ফলে তাঁতিরা হারিয়ে যাচ্ছেন। আমরা চাই তাদের টিকিয়ে রাখতে। মানুষ যেন প্রকৃতির ক্ষতি কম হবে এমন পণ্যে আগ্রহ প্রকাশ করে, তারা যেন আরও বেশি মাটির কাছাকাছি থাকে।"
তিনি আরও বলেন, "যাত্রার শুরু থেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন ছিল খুঁতের। নারী ও পুরুষের সমান সংখ্যক তৃতীয় লিঙ্গের কর্মী নিয়োগ দিতে ইচ্ছুক আমরা। কিন্তু খুঁতে কাজ করতে আগ্রহী, এমন কোনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এখনো আমরা পাইনি, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
উদ্যোক্তাদের অনুভূতি
প্রতিটি শাড়ির নকশার ক্ষেত্রেই দুজনে পরামর্শ করে সমন্বিতভাবে কাজ করেন ফারহানা হামিদ ও উর্মিলা শুক্লা। পণ্যের ছবি তোলা, অনলাইনে দেওয়াসহ প্রযুক্তিগত কাজগুলো ফারহানা হামিদই করেন এবং অনলাইন পেজের তত্ত্বাবধান করেন মল্লিকা।
খুঁত নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে উর্মিলা শুক্লা বলেন, "খুঁত আমার কাছে আমার সন্তানের মতো, যার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সবকিছুতেই আমি আছি। খুঁতের কাজ ভালো হলেও আমার দায়, খারাপ হলেও তা আমারই।"
উদ্যোক্তা জীবনের পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয় ও মডেলিং করেন ফারহানা হামিদ। কিন্তু প্রচন্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি প্রশান্তি খোজেন খুঁতের বাড়িতে এসে এবং খুঁত নিয়ে কাজের মধ্য দিয়ে। শাড়ির প্রতি নিজের ভালোবাসা ও মায়া থেকেই অন্য কারো চাইতে নিজের আনাড়ি হাতের ফটোগ্রাফিই খুঁতে কাজে লাগাতে চান ফারহানা।
খুঁতের নকশা কেউ নকল করছে কিনা এমন প্রশ্নে ফারহানা হামিদ বলেন, "এটাকে আমি বরং বলবো যে আমাদের পণ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই ধাচের পণ্য নিয়ে এসেছে। এই যে অনুপ্রেরিত হয়ে একই জিনিস বানানোর চেষ্টা করেছে, এটাও আমাদের ভালোই লাগে। তবে আমরা বলবো ডিজাইনের পাশাপাশি কাপড়ের মানটুকুও যেন বজায় রাখে, কিংবা আমাদের চেয়েও যেন ভাল মানের দেওয়ার চেষ্টা করে।"
খুঁতের বাড়িতে আড্ডা ও মেলা
শোরুম নয়, একেবারেই ঘরোয়া আমেজে সাজানো আউটলেটকে 'খুঁতের বাড়ি' বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ব্র্যান্ডের সত্ত্বাধিকারীরা। সবুজে ঘেরা এই ছিমছাম জায়গায় চাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতে পারেন ক্রেতারা। শাড়ি কিনতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। উদ্যোক্তারা চান, ইটকাঠের শহরে ছোট্ট একটা আড্ডা দেওয়ার জায়গা থাকুক খুঁতের শুভাকাঙ্ক্ষীদের!
এছাড়া গত জানুয়ারি মাস থেকে নিজেদের শোরুমে আরও কয়েকটি দেশীয় ব্র্যান্ডের পণ্য প্রদর্শনীর জন্য জায়গা করে দিয়েছে খুঁত। নির্দিষ্ট কিছু ভাড়ায় একটা কোণে নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে পারবে এসব ব্র্যান্ড। এখন থেকে নিয়মিত মেলার আয়োজন করতে আগ্রহী খুঁত।
উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ
শখের বসে নয়, বরং আঁটঘাট বেধে দৃঢ় মনমানসিকতা নিয়ে উদ্যোক্তা হতে ইচ্ছুকদের ব্যবসায়ে নামার পরামর্শ দিলেন ফারহানা হামিদ।
তিনি বলেন, "আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন অনেকেই আমাদের বলেছে যে আমরা এটা শখের বসে শুরু করেছি। কিন্তু তা নয়। একদম নিয়ম করে ব্যবসায়ে সময় দিতে হবে। ভীষণ সৎ থাকতে হবে এবং ডেডিকেশন লাগবে।"
"শুধু ব্যবসায়িক চিন্তা করলে শুধু ব্যবসাই হবে, গ্রাহকের ভালোবাসা পাবেন না। সততা, নিষ্ঠা, ভালোবাসা এবং পর্যাপ্ত সময় দিতে পারলেই কেবল উদ্যোক্তা হিসেবে উন্নতি করা যাবে।"