লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কোডেক্স লেস্টার, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বইটি রয়েছে বিল গেটসের ঝুলিতে
পৃথিবীতে এযাবৎ যত মানুষ এসেছেন, খেয়েছেন, থাকছেন, ভাবছেন তার মোট সংখ্যা বলা হয় ১১৭ বিলিয়ন মানে ১১ হাজার ৭০০ কোটি। এসব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষগুলোর একজন ধরা হয় ভিঞ্চি মানে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে। না ধরে উপায় কি? তিনি বিজ্ঞানকে শিল্পকলার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রকৃতিই যে প্রকৃত শিক্ষক তাও বুঝেছিলেন ভিঞ্চি। তিনি কৌতূহলী ছিলেন সবকিছুতে- মানবশরীরের গঠন থেকে রোবট পর্যন্ত। চমকে যাওয়ার মতোই ব্যাপার। পাঁচশ বছর আগে রোবট আসে কী করে? ভিঞ্চি সে কারণেই বড় যে অত আগেই আজকের কথা ভেবেছিলেন। পাখির ওড়াউড়ি দেখতেন আর আঁকতেন বিমানের চেহারা। প্যারাশুটও এঁকে গেছেন। পানির চলাচল নিয়ে ৫০০ ছবি তিনি এঁকেছেন, শিশির কিভাবে গড়ে ওঠে থেকে শুরু করে চাঁদে পানি আছে কি নেই পর্যন্ত তার ভাবনা বিস্তৃত ছিল।
বলা হয় ৩০টির মতো নোটবুক তিনি পূর্ণ করেছেন লিখে আর এঁকে যার সবগুলোই বিজ্ঞান বিষয়ক। এগুলোর মধ্যে বেশি পরিচিত কোডেক্স লেস্টার। তাতে তিনি পৃথিবীর গঠন নিয়ে লিখছেন, যখন আমার বলছি যে পৃথিবীর ক্ষয়-বৃদ্ধি আছে তাহলে ধরে নিচ্ছি মাটি হচ্ছে এর পেশি, পাহাড় এর হাড়গোড় আর এর রক্ত হচ্ছে পানি।
ওই অল্প কটি কথাতেও ধরা পড়ছে কত বড় ভাবুক ছিলেন ভিঞ্চি। পাঁচশ বছর ধরে মানুষটি পৃথিবীকে ভাবনার খোরাক জুগিয়ে চলেছেন। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন দার্শনিক, বিজ্ঞানী, আবিস্কারক, প্রকৌশলী ও শিল্পী। এর যেকোনো একটি হওয়াই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুঃসাধ্য। তার বুদ্ধি ছিল অপরিমেয়, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অতুলনীয় আর কৌতূহল ছিল বাঁধভাঙা।
মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলছিলেন, 'আমি মানুষটির ভক্ত আমার ছোটবেলা থেকেই। অনন্য এক মানুষ ছিলেন তিনি, তার মস্তিষ্ক এমন সব বিষয় ভাবত যা আর কেউ ভাবেনি, তার মন এমন কিছু খুঁজত যা আর কেউ খোঁজেনি।
বিল গেটসের কাছেই আছে ভিঞ্চির নোটবুকটি নাম যার কোডেক্স লেস্টার। এটি তিনি ১৯৯৪ সালে এটি কিনেছিলেন প্রায় ৩১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে। ভিঞ্চি ছিলেন বাঁ হাতি। পাতা ডানদিক থেকে লেখা শুরু করতেন আর মাঝে মাঝেই ছবি এঁকে বুঝতে চাইতেন যা ভাবছেন সেটি বাস্তবভিত্তিক কি না।
কোডেক্স লেস্টার নিয়ে কিছু কথা
থমাস কোকের নাম জড়িয়ে গেছে ওই পাণ্ডুলিপির সঙ্গে। তিনি ভিঞ্চির পাণ্ডুলিপিটি কিনেছিলেন ১৭১৯ সালে। থমাস ছিলেন আর্ল অব লেস্টার। ইতালীয় ভাষায় লেখা চামড়ার বাধাই করা পাণ্ডুলিপিটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭২। পাতার দুই পাশেই লেখা। লেস্টারে ২৬৩ বছর থাকার পর ১৯৮০ সালে শিল্পপতি আর্মান্ড হ্যামার নিলাম থেকে এটি কিনে নিয়েছিলেন ৫.১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে। তাই একে কোডেক্স হ্যামারও বলা হয়। হ্যামার ভিঞ্চি বিষয়ক পণ্ডিত কার্লো পেদরেত্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন এর হারানো পাতাগুলোকে খুঁজে বের করতে আর ইংরেজীতে অনুবাদ করতে। সাত বছর লেগে যায় কার্লোর, আর কাজটি তিনি সফলভাবেই শেষ করেন।
তারপর নিউইয়র্কে ক্রিস্টির নিলাম থেকে ১৯৯৪ সালে নোটবুকটি কিনে নেন বিল গেটস। এর প্রতিটি পৃষ্ঠা স্ক্যান করে ডিজিটাল ইমেজ ফাইল বানানো হয়। পরে সেগুলোকে স্ক্রিন সেভার বা ওয়ালপেপার হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয় উইন্ডোজ ৯৫ চালিত ডেস্কটপগুলোয়। ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) ৫০০তম মৃত্যুবার্ষিকী এগিয়ে এলে গেটস ডিজিটাল ফাইলগুলো জাদুঘরে দেখানোর সুযোগ করে দেন ২০০০ সাল থেকে। সিডনীর পাওয়ারহাউজ থেকে তা যায় টোকিওতে। তারপর সিয়াটল হয়ে যায় ডাবলিনে। তারপর যায় আরিজোনার ফিনিক্স জাদুঘরে, মিনিয়াপলিসে ও উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্প জাদুঘরে।
২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভিঞ্চির জন্মস্থান ফ্লোরেন্সের উফিৎসি জাদুঘরে প্রদর্শিত হয় কোডেক্স লেস্টার। নোটবুকটির প্রথম সংগ্রাহক হিসাবে মাইকেলএঞ্জেলোর ছাত্র গুগিলিয়েলমো দেলা পোর্তার নাম করা হয়। তারপর থমাস কোকের হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটা ছিল চিত্রশিল্পী গুইসেপ্পে ঘেজ্জির কাছে।
মানুষটি যেমন ছিলেন
মোনালিসা আর লাস্ট সাপারের শিল্পী হিসেবেই লোক তাকে চেনে। আর গবেষকরা চেনে ভাবুক ও আবিস্কারক হিসেবে। অথচ ভিঞ্চি খুবই কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে রঙ্গতামাশায় প্রায়ই মেতে থাকতেন। বলছিলেন মিনিয়াপলিস ইনস্টিটিউ অব আর্টসের কোডেক্স লেস্টারের কিউরেটর আলেক্স বর্তলত।
তিনি আরও বলেন, মজার মানুষ ছিলেন ভিঞ্চি। একটা লিজার্ড পুষতেন তিনি, বুন্ধরা দুষ্টুমি করে বলত লিওনার্দোর পোষা ড্রাগন। দুটি বাদুড়ের পাখাও বেধে দিয়েছিলেন সেটির গায়ে।
তিনি ছিলেন নিরামিষভোজি আর যুদ্ধবিগ্রহ পছন্দ করতেন না। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার কোনো সুযোগ পাননি। আলেক্স বলছিলেন, 'এটা তার জন্য শাপে বর হয়েছিল। লেখাপড়া করতে পারেননি বলেই সম্ভবত তিনি গতানুগতিকভাবে পৃথিবীকে দেখতে শেখেননি, পৃথিবীকে তিনি দেখেছেন স্বাধীনভাবে, বুঝেছেন আর সবার চেয়ে বেশি।'
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৃথিবীকে দেখার দারুণ ক্ষমতা তার ছিল। তিনি পর্যবেক্ষণ থেকেই পৃথিবীকে বোঝার তত্ত্বসমূহ দাঁড় করান আর একইসঙ্গে তত্ত্বগুলোর কার্যকরিতা পরীক্ষা করতে থাকেন। পরীক্ষা ঠিক ফল বয়ে না আনলে চিন্তায় পরিবর্তন আনতেন এবং নতুন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লেগে যেতেন। চিরাচরিত চিন্তাকে প্রশ্ন করার মতো যথেষ্ট সাহস তার ছিল। আলেক্স বলছিলেন, এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের তৈরি ফাঁদে আটকা পড়েছি। আজকের এই পৃথিবী পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে, চাপ বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেও। তাই ভিঞ্চি আজও আমাদের পথপ্রদর্শক। আমাদের এখন তার মতোই কৌতূহলী হয়ে উঠতে হবে, হতে হবে সৃজনশীল তবেই মুক্তির উপায় মিলবে।
বেচে থাকতেই লিওনার্দো জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তখন জর্জিও বাসারি তার প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। তবে তাকে আধুনিক সময়ে পুনরাবিস্কারের অনেকটা কৃতিত্ব শিল্প ঐতিহাসিক জাঁ পল রিখটারের। উনিশ শতকে তার কয়েকটি নোটবুক ইংরেজীতে অনুদিত হয়েছিল। তারপর আমেরিকান পণ্ডিত এডওয়ার্ড ম্যাকার্ডি লিওনার্দোর পাণ্ডুলিপিগুলো থেকে বাছাই করা কিছু বর্ণনার সংকলন প্রকাশ করেন ১৯৩০ সালে। ম্যাকার্ডি তখন বিষয়ভেদে লেখাগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নেন। ঐতিহাসিক জর্জ সার্টনের নামও আসে ম্যাকার্ডির সঙ্গে। ম্যাকার্ডি বুঝতে চাইছিলেন পূর্বসুরীদের থেকে লিওনার্দো কেন আলাদা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সার্টন লিওনার্দোকে নিয়ে অনেকগুলো বক্তৃতা দেন। তিনি বলছেন, 'আমি মধ্যযুগের অনেকের লেখালেখি অধ্যয়ন করেছি, ওই যুগটাকে না বুঝলে বোঝা মুশকিল লিওনার্দো কতটা অগ্রসর ছিলেন সময়ের তুলনায়। তিনি দুইটা সেতু রচনা করে গেছেন একটা হলো মধ্যযুগের সঙ্গে রেনেসা যুগের অন্যটি হলো শিল্পকলার সঙ্গে বিজ্ঞানের'।
মোনালিসার কথা কিছু
মোনালিসা লিওনার্দোর স্টুডিওতেই ছিল ১৫১৯ অবধি। তারপর রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের রাজকীয় সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর তা ফরাসী বিপ্লবীদের করায়ত্ব হয়। কিছুকাল ছিল নেপোলিয়নের শোয়ার ঘরে। আর তারপর থেকেই আছে ল্যুভে। উল্লেখ্য, লিওনার্দো তার জীবনের শেষ পর্যায়ে ফরাসী রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের আতিথ্যে কাটিয়েছেন।
বেশি দাম তুলেছে যে বইগুলো
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূলকপি বিক্রি হয়েছে ৪৩.২ মিলিয়ন ডলারে। ইউয়ান রাজ্যের শিল্পী ঝাও মেংফুর (১২৫৪-১৩২২) লেখা চিঠি বিক্রি হয়েছে ৩৮.২ মিলিয়ন ডলারে ২০১৯ সালে। বুক অব মরমন (১৮৩০) বিক্রি হয়েছে ৩৫ মিলিয়ন ডলারে ২০১৭ সালে। সং রাজ্যের পণ্ডিত জেং গংয়ের লেখা চিঠি বিক্রি হয়েছে ৩১.৭৩ মিলিয়ন ডলারে ২০১৬ সালে।
কোডেক্স লেস্টার বিক্রি হয়েছে ১৯৯৪ সালে ৩০.৮০ মিলিয়ন ডলারে যার মূল্যমান ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ৫৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি। তাই গবেষকরা বলছেন, কোডেক্স লেস্টারই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দামকাড়া বই।
- সূত্র: এমপিআর নিউজ, বিজনেস ইনসাইডার