সুখী লাগা, চাপ কমা বা আসক্তির মতো...প্রেমে পড়লে মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে?
ভালোবাসার প্রাথমিক অনুভূতির সাথে তো সবাই পরিচিত। অনেক সময় বুক ধুকপুক করে, চিন্তা করলে বা মানুষটি সামনে এলে হাতের তালু ঘামিয়ে যেতে পারে। অন্য কাউকে বা কোনো কিছু নিয়েই পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারেন না হয়তো। কিন্তু, কখনো কি ভেবেছেন এমনটা কেন হয়? এর পেছনে কাজ করছে আসলে আমাদের মস্তিষ্ক।
মস্তিষ্কের ইমেজিং রিসার্চে দেখা গেছে, মস্তিষ্কের কিছু অংশ ও নিউরোকেমিক্যাল আমাদের ভালোবাসায় পড়তে ও জুটিবদ্ধ হতে ট্রিগার করে।
ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে স্ট্রেস কমে, অক্সিটসিন হরমোন নিঃসরণের কারণে শান্ত, নিরাপত্তার অনুভূতি আসে। ডোপামিন হরমোণ নিঃসরণের কারণে মন ভালো হয়ে যায়।
দেখা গেছে, কোনো আসক্তির ক্ষেত্রে মানব মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এমনটাও হয়। তবে এই প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক, অন্যান্য আসক্তির মতো না। মানুষের এই প্রেমানুভূতির মূলেও বিবর্তন নিহিত। প্রেমে পড়লে আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে মানসিক পরিবর্তন আসে, কিন্তু কীভাবে?
বাটারফ্লাই ড্যান্স
প্রেমে পড়লে পেটের মধ্যে প্রজাপতি নাচার মতো এক ধরনের অনুভূতি হয়।
নিউইয়র্কের কর্নেল মেডিসিন ব্রেন অ্যান্ড স্পাইন সেন্টারের পরিচালক নিউরোসার্জন ড. ফিলিপ স্টেইগ
এ প্রসঙ্গে বলছেন, এই প্রতিক্রিয়া আসলে পেটে বা হৃদপিণ্ডে হয় না। মস্তিষ্কে বিভিন্ন হরমোন ও নিউরো ট্রান্সমিটারের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ায় এ ধরনের অনুভূতি হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ মানুষদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমে ডোপামিন ও নিউরোট্রান্সমিটারের অত্যধিক উপস্থিতি দেখা গেছে। ডোপামিন ও অন্যান্য কেমিক্যালের কারণেই মানসিক শক্তি, নিবদ্ধ মনোযোগ ও আবেশের মতো অনুভূতিগুলো আসে মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে।
আসক্তির মতো
মানুষ যখন আরেক জন মানুষকে প্রচন্ড ভাল্ভাসতে শুরু করে, মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রা কমতে থাকে। অন্যদিকে, ডোপাইন, অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এরফলে মানুষ এই অনুভুতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
মানসিক চাপ প্রশমন
যদিও প্রেম কারো জন্য চাপের বিষয় হতে পারে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে - এটি দীর্ঘমেয়াদে চাপ কমাতে পারে।
নিউরোএন্ডোক্রিনোলজি লেটারস-এ ২০০৫ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রেম করছে এমন মানুষের নিউরোবায়োলজি পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রেমানুভূতির সাথে মানুষের স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেমের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। এটি এইচপিএ এক্সিস অ্যাক্টিভেশন নামে পরিচিত। গবেষণার ফলাফলে পরামর্শ দেওয়া হয়, আপনার সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধন গড়ে উঠলে তা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করতে পারে, এরফলে উল্লেখযোগ্য হারে উদ্বেগের মাত্রা কমে আসে।
নিরাপত্তার অনুভূতি
কম চাপ অনুভব করার একটি কারণ হতে পারে কারণ প্রেমানুভূতি মানুষকে নিরাপদ বোধ করায়, প্রিয়জনের প্রতি আস্থা গড়ে তোলে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের রিপোর্ট অনুসারে, আলিঙ্গন, চুম্বন এবং যৌনতার মতো শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। এরফলে মানুষের সঙ্গীর প্রতি বন্ধন, অনুভূতি আরও গভীর হয়। তৃপ্তি, প্রশান্তি এবং নিরাপত্তার অনুভূতি পায় মানুষ।
অক্সিটোসিন সামাজিক বন্ধন, মাতৃ প্রবৃত্তি এবং প্রজনন এবং যৌন আনন্দেও ভূমিকা রাখে।
নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, 'প্রেমের হরমোন' যুগলদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন ও বিশ্বাসের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তোলে।
সুখী হয়ে ওঠা
প্রেমে পড়লে মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ হয়। এই নিউরোট্রান্সমিতার মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে, একারণে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ যুগল একে অপরের সাহচর্যে তুলনামূলক হাসি-খুশি থাকে।
ব্যথা উপশম
২০১০ সালে প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় রোমান্টিক সম্পর্কে আবদ্ধ কিছু মানুষের মস্তিষ্কের এফএমআরআই স্ক্যান করা হয়। গবেষকরা দেখতে পান, রোমান্টিক পার্টনারের ছবি দেখলে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমের অংশে সচল হয়ে ওঠে। গবেষণার পরামর্শে বলা হয়, প্রেমানুভূতি মানুষের ব্যথার অনুভূতি প্রশমন করতে পারে।
রক্তচাপ কমায়
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ সার্ভিসেসের ২০০৭ সালে প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা যায়, বিবাহিত দম্পতিদের রক্তচাপ কম থাকে এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমে আসে। বিবাহিত বলতে ভালোবাসার সম্পর্ক আবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে বাস করা দম্পত্তি।
কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকির একটি বিশ্লেষণে, আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজি ৩.৫ মিলিয়ন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গবেষণা চালায়।
দেখা গেছে ৫০ বছরের কম বয়সী ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ দম্পত্তিদের এ রোগের ঝুঁকি ১২ শতাংশ কম থাকে। ৪১-৬০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের এ ঝুঁকি ৭ শতাংশ কম হয়।