ঢাকা সিটি কর্পোরেশন একত্রিত করা, মেট্রো সরকার গঠনের প্রস্তাব অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ক টাস্কফোর্সের
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন একত্রিত করার সুপারিশ করেছে অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ক টাস্কফোর্স। সব ধরনের আহ্বান এবং সমালোচনা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ঢাকা শহর দুই ভাগে বিভক্ত করে।
৩০ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া টাস্ক ফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'দিল্লির মতো ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে একত্রিত করে একটি 'মেট্রোপলিটন সরকার' গঠন করলে উপকার হবে।'
প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকার মেয়ররা নগরীর সেবার মান উন্নয়নে ইউটিলিটি পরিষেবাগুলোকে একত্রিত করে একটি মেট্রোপলিটন সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ প্রথম এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
তিনি প্রথমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পান। পরে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন। তবে মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটিকে অবাস্তব বলে উল্লেখ করে, কারণ সরকার বিশেষ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওপর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃত্ব দিতে অনিচ্ছুক ছিল।
সাম্প্রতিক টাস্ক ফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকাকে পুনরায় একীভূত করা হলে শাসন ব্যবস্থায় গতি আসবে, অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা কমবে এবং সম্পদের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত হবে। প্রতিবেদনে সমন্বিত নগর পরিকল্পনার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'ভূমি ব্যবহার, পরিবহন অবকাঠামো ও জনসেবাকে সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ নগর মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হোক।'
সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গঠনের সুপারিশ
টাস্কফোর্স ঢাকার সব ধরনের গণপরিবহন ও সহায়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে একই প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনার সুপারিশ করেছে।
প্রস্তাবিত সমন্বিত গণপরিবহন ইউনিটের অধীনে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিং (বিআরএফ), ট্রাম, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), লাইট রেল ট্রানজিট (এলআরটি), মনোরেল, শহরতলির যাত্রীবাহী ট্রেন, মেট্রোরেল (এমআরটি) এবং রাইডশেয়ার পরিষেবাগুলো থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এই ইউনিটটি মেয়রের কার্যালয় অথবা একটি নির্দিষ্ট স্থানীয় সরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলে বিভিন্ন গণপরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।'
এছাড়া, এসব সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা তার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে এবং আরও বাসযোগ্য ও কার্যকরভাবে পরিচালিত রাজধানী শহরে রূপ নিতে পারবে।'
ঢাকার চ্যালেঞ্জসমূহ
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা সমস্যার কারণে আধুনিক ও বাসযোগ্য রাজধানী হিসেবে ঢাকার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'ঢাকার সড়ক নকশা অপরিকল্পিত। এটি মোট এলাকার মাত্র ৭ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় পর্যায়ের সড়কের মধ্যে কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই এবং প্রধান সংযোগ সড়কেরও অভাব রয়েছে। ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা পুরোনো পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে একমুখী ট্র্যাফিক প্রবাহ, দ্বিমুখী ট্র্যাফিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সড়ক টোল নীতি নির্ধারণ বা বহুমুখী গণপরিবহন কেন্দ্রের মতো আধুনিক ব্যবস্থা এখনও চালু হয়নি।'
এতে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যমান বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে নতুন রেললাইন ও একাধিক ফ্লাইওভারের অনুমোদন জটিলতা আরও বাড়িয়েছে। 'এছাড়া, মূলধননির্ভর ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে গণপরিবহন অবকাঠামোর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে।'
প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসপাতাল, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহজ প্রবেশাধিকার এখনও নিশ্চিত হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার ফলে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
ঢাকার কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা দক্ষিণে, অধিকাংশ আবাসিক এলাকা উত্তরে
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা (সিবিডি) দক্ষিণে অবস্থিত, অথচ অধিকাংশ আবাসিক এলাকা উত্তরে। এর ফলে পুরো শহরজুড়ে ব্যাপক যাতায়াতের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'উদ্বেগজনকভাবে শহরের ৮৫ শতাংশ উন্নয়ন অবৈধ এবং অগ্নিনিরাপত্তা মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া, বিমানবন্দর ও সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকা নগরীর ঘনবসতি বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে। এদিকে, নির্মাণের উপযোগী জমির অভাবের কারণে জলাভূমি ভরাট করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করা হচ্ছে, যা ভয়াবহ পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় যানবাহনের গতি বছরের পর বছর নাটকীয়ভাবে কমছে। ১৯৯৭ সালে ডিউটিপি গবেষণায় গড় গতি ছিল ২৫ কিমি/ঘণ্টা, যা ২০০৫ সালে এসটিপি গবেষণায় ১৫ কিমি/ঘণ্টায় নেমে আসে। এরপর ২০১৫ সালে আরএসটিপি গবেষণা অনুযায়ী, এটি আরও কমে ৬.৭ কিমি/ঘণ্টায় পৌঁছায়। সাম্প্রতিক ইউআরএসটিপি গবেষণার (অপ্রকাশিত) ফলাফল পরিস্থিতির আরও অবনতি দেখাচ্ছে।
'এই নিম্নমুখী প্রবণতা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, ঢাকা ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে, প্রায় অচল শহরে পরিণত হচ্ছে। গুগলের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর।'
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বসবাসযোগ্যতা সূচক, বায়ুদূষণ সূচক, যানবাহনের গতি সূচক এবং পানি মান সূচকসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক র্যাংকিং ঢাকার বাসযোগ্যতা, দূষণ, যানবাহন ব্যবস্থাপনা, পানি মান ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার চরম সংকটকে তুলে ধরছে।
'অনেক ক্ষতি ইতোমধ্যেই অপরিবর্তনীয় হয়ে গেছে, যেমন এলোমেলো সড়ক নকশা, যা আধুনিক যানবাহন ব্যবস্থাপনা ও গণপরিবহন কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রশস্ত ফুটপাত, সাইকেল লেন বা গণপরিবহন অবকাঠামোর জন্য কোনো জায়গা নেই। রেলপথ সড়ক অবকাঠামোর সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে আছে, এবং রেল ও সড়ক সেতুগুলো জলপথের গতি ও সম্ভাবনাকে সংকুচিত করেছে।'
প্রতিবেদন আরও উল্লেখ করেছে, ঘনবসতিপূর্ণ ও অনিয়ন্ত্রিত শহরতলির বিস্তার, বিশেষ করে নদী তীরবর্তী এলোমেলো উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে পরিকল্পিত সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, 'উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১১.৫ কিলোমিটারজুড়ে (তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত) অপরিবর্তনীয় নিষিদ্ধ এলাকা শহরের গতিশীলতা ও সম্প্রসারণকে আরও সীমিত করে রেখেছে।'
এছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলো যেখানে তাদের ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে কৌশলগতভাবে একাধিক বিমানবন্দর ও রানওয়ে গড়ে তুলেছে, সেখানে ঢাকা এখনো মাত্র একটি বিমানবন্দর ও একটি রানওয়ের ওপর নির্ভরশীল। এটি শহরের উন্নয়নকে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আধুনিক, স্মার্ট ও বিনিয়োগবান্ধব রাজধানী হওয়ার জন্য ঢাকা প্রস্তুত নয়
অর্থনৈতিক সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাঠামোগত দুর্বলতা স্পষ্টভাবে দেখায় যে ঢাকা একটি আধুনিক, স্মার্ট ও বিনিয়োগবান্ধব রাজধানী হিসেবে কার্যকর হওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।
'এসব গুরুতর সমস্যার পরও রাজধানী স্থানান্তর বা বিকেন্দ্রীকরণের কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা নেই, যদিও প্রতিবেশী দেশগুলো সফলভাবে এ ধরনের রূপান্তর বাস্তবায়ন করেছে। এখন আর প্রশ্নটা বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে নয়, বরং সেটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে টিকে থাকার প্রশ্ন।'
প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ঢাকার সক্ষমতা একটি টেকসই রাজধানী হিসেবে কাজ করার জন্য ক্রমেই কমে যাবে, যা জাতির দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি সৃষ্টি করবে।
প্রতিবেদনে টাস্ক ফোর্স উল্লেখ করেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০টি দেশ তাদের রাজধানী স্থানান্তর করেছে বা স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নাম এসেছে।
এই স্থানান্তরের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে: জনসংখ্যা ও যানজট, যা বিদ্যমান রাজধানীগুলোর অবকাঠামোতে চাপ সৃষ্টি করে; দেশের অভ্যন্তরে আরও ভালো প্রবেশযোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা এবং পরিবেশগত উদ্বেগ, যেমন ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষ হওয়া, জমি তলিয়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দূষণের ঝুঁকি। এসব কারণে ইন্দোনেশিয়া জাকার্তা থেকে রাজধানী নুসান্তারা-তে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এই স্থানান্তরের লক্ষ্য হলো, নতুন শহরকে একটি আধুনিক, স্মার্ট শহর হিসেবে গড়ে তোলা, যার শারীরিক যাতায়াতের চাহিদা কম হবে এবং এটি হবে স্থিতিস্থাপক, পরিবেশগতভাবে টেকসই, উদ্ভাবনী, ২১ শতকের এবং বিনিয়োগবান্ধব রাজধানী।'