আগুনে ঝালের বাঙালির মহাকাব্যিক 'ঝালমুড়ি'
রান্নার বই লেখা সাইরা হ্যামিলটনের জন্য ছোটবেলায় দাদীর কাছে বেড়াতে যাওয়া সহজ ছিল না। যুক্তরাজ্যের প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী পরিবারে জন্ম সাইরার। গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রতিবছর ওয়েলস থেকে ফ্লাইট চেপে আসতেন ঢাকায়। পরের যাত্রাটুুকু আরও কঠিন। কিশোরগঞ্জ জেলার বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত ঘেরা দামপাড়া গ্রামে যেতে ট্রেন, বাস, রিকশা, ডিঙি নৌকায় করে ভেঙে ভেঙে পথ পাড়ি দিতে হতো।
স্টেশনে, ঘাটে, ধুলোভরা রাস্তার এই দীর্ঘ যাত্রাপথে একটি জিনিস কিন্তু বারবারই সাইরার চোখে পড়ত, তা হলো ঝালমুড়িওয়ালা। স্টিলের কৌটায় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তৈরি হওয়া ঝমঝম শব্দই তার আগমনী বার্তা। ছোট্ট সাইরা জানত মজার এক খাবার আসতে চলেছে, যার ওপর এখন সে হামলে পড়বে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে আইকনিক স্ন্যাকসগুলোর মধ্যে অন্যতম ঝালমুড়ি। একে মশলাযুক্ত মুড়ির তৈরি এক সালাদই বলা চলে। দেশের মানুষ যে জিনিস খেতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে- সেই চাল আর মশলাই এর প্রধান উপকরণ। (পছন্দের কাতারে তৃতীয় খাবারটি অবশ্যই মাছ)।
"আমার মনে হয় এটা বলা ঠিক হবে যে ঝালমুড়ি এক ক্লাসিক স্ট্রিটফুড- যা সারা বাংলাদেশেই পাওয়া যায়। এর স্বাদ দারুণ, যা সত্যিই মুখে পানি আনবে"- বলেন সাইরা। বাংলাদেশি রান্না নিয়ে সাইরার লেখা 'মাই বাংলাদেশ কিচেন' বইয়ের প্রথম রেসিপিতেই পাওয়া যাবে ঝালমুড়ির নাম।
এর মূল উপকরণ হলো মুড়ি যা সাধারণত গরম বালু বা লবণে চাল ভেজে তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবন এমনকি বিশেষ উপলক্ষতেও এর দেখা মিলে। মুসলিমদের রমজান কিংবা হিন্দুদের দুর্গাপূজার সময়েও মুড়ি বা মুড়ির তৈরি খাবার পরিবেশিত হয়ে থাকে।
কিন্তু যে দেশীয় পটাকা মুড়িতে বিশেষত্ব নিয়ে আসে সেটা হলো 'ঝাল'। কাঁচামরিচ, লাল মরিচের গুঁড়া, চানাচুর সব মিলিয়ে এমন এক টকঝাল মুড়িমাখা তৈরি হবে যা কাছে নিলে নাকও জ্বলবে!
লবণ, বিটলবণ বা সৈন্ধব লবণ কিংবা কখনো সবগুলো মিশিয়েই মাখা হয় মুড়ি। স্বাদ বাড়াতে সঙ্গে লেবুর রস ও তেঁতুলের পানিও মেশানো হয় যার টক স্বাদ জিভে জল আনে। এর বাইরে কুচিকুচি করে কাটা পেঁয়াজ, শসা, পুদিনা পাতা, ধনে পাতার সঙ্গে কখনো টমেটো মিশিয়ে টকঝাল এক খাবার তৈরি হয়। আর সবশেষে পড়বে সারা বাংলাদেশের পছন্দের সরিষার তেলের কয়েকটি ফোঁটা। এর ঝাঁজই ঝালমুড়িকে এনে দিবে পূর্ণতা।
উপকরণগুলো মোটামুটি দেশের সবজায়গায় পাওয়া যায় বলেই ঝালমুড়ির দেখাও সর্বত্রই মিলে। পশ্চিমবঙ্গের ভেলপুরি, কর্ণাটকের চুরুমুড়ি, নেপালের চটপটি সবই বাংলাদেশের প্রিয় এই স্ট্রিটফুডের প্রায় কাছাকাছি ধরনের খাবার। তবে ঝালমুড়ির বিশেষত্ব শুকনো ও তরল উপকরণগুলো মেশানোর অনুপাতে (যেমন: ভেলপুরিতে পানি বেশি থাকবে, ডালও থাকবে বেশি। ঝালমুড়ির মতো শুকনো হয়)। এরসঙ্গে আছে বাংলাদেশের কড়া ঝালপ্রীতি। সাইরা বলেন, "এর ঝাঁজ আপনি নাকে পাবেন, গলায় না।" স্থানীয় অনেকেই বলেন টকঝাল খাওয়ায় ঘাম ঝড়ে যা আর্দ্র আবহাওয়ায় শরীর ঠাণ্ডা করতে সাহায্য করে।
দক্ষিণ এশিয়ার রন্ধনশৈলীতে মুড়ির দীর্ঘ ইতিহাস থাকায় ঠিক কখন কোথায় মুড়িকে ভিন্ন স্বাদে পরিবেশন করা শুরু হয় তা বলাটা কঠিন। কীভাবে কীভাবে যেন মুড়ির অস্তিত্ব প্রায় সবসময়ই ছিল আর খাওয়াও হতো বিচিত্রভাবে।
ভোজনবিদ ও লেখিকা পৃথা সেন বলেন, "বিষয়টি হলো মুড়ি আবহমান কাল থেকে বাংলার অন্যতম প্রধান খাবার। বিশেষ করে আকালের সময় ভাতের বিকল্প হিসেবে মুড়ি সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রায় সব খাবারেই চাল ব্যবহৃত হয়। ডিজার্ট বা মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে সকাল, দুপুর কিংবা রাতের খাবারে সব জায়গায় চাল থাকেই।"
স্টিলের কৌটা বা প্লাস্টিকের ডিব্বা বা মগে ভালোমতো মিশিয়ে কাগজের ঠোঙায় করে বিক্রি হয় ঝালমুড়ি। দামও বেশ কম- ১০ বা ২০ টাকা (০.০৯ – ০.১৯ পাউন্ড)। এই ঠোঙা খুব সহজেই হাতে নিয়ে ঘোরা যায়। আবার খাওয়া শেষে হাতে লেগে থাকা তেল-ঝোলও সেই ঠোঙাতেই মুছে ফেলা যায়। ব্যবহারিক দিক থেকেও ঠোঙার গুরুত্ব কম নয়। কার্ডবোর্ড বা ম্যাগাজিন পেপারের চারকোণা একটি কার্ড চামচ হিসেবে সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়।
প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে ঝালমুড়ি বানানো হয় বলে যার যার পছন্দ অনুযায়ীও উপকরণ মেশানো বা বাদ দেওয়ার বিকল্প থাকে বলে জানান সাইরা।
অনেক মুড়িওয়ালা বিশেষ মশলার স্বাদের এত বেশি জনপ্রিয় যে কাল্টের মতো ভক্তও থাকে তাদের। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অফিসগামীরাও দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ির জন্য অপেক্ষা করে।
ভারতীয় উদ্যোক্তা ও ভ্রমণপিপাসু অর্ণব মিত্র চার দেশের ২০টির বেশি শহরের ভিন্ন ধরনের স্ন্যাকগুলো খেয়েছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের ঝালমুড়ি সবচেয়ে বেশি ঝাল। আরেকটি জিনিসের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তা হলো মুড়িওয়ালার 'সোয়্যাগ'।
"প্রতিষ্ঠিত মুড়িওয়ালারা জানে যে তারা বিখ্যাত। সাধারণত তারা লুঙ্গি পরেন। গায়ে জামা পরতেও পারেন, নাও পরতে পারেন। কিন্তু তারপরও তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী। যেন বলছেন, আমি সামান্য মানুষ বটে তবে আপনি মার্সিডিজ থামিয়ে আমার কাছে খেতে আসবেন কারণ সামান্য উপকরণগুলোই অসাধারণ করে তোলার জাদু আমি জানি," বলেন অর্ণব।
ব্রিটিশ শেফ অ্যাঙ্গাস ডেনুন ডানকানও এ বিষয়ে একমত। সস্তা সাধারণ কিছু উপকরণ বেশ যত্ন নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে কিছুটা রহস্যময় মিশিয়ে পুরো জিনিস তৈরি করা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই রহস্যের সঙ্গেই আসে এর প্রতি এক অনন্য আকর্ষণ। "ভালো একটি খাবার সস্তায় কীভাবে তৈরি করা সম্ভব আমি তা নিয়ে আগ্রহী। তাছাড়া দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সুনিপুণভাবে কোনো কাজের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিও আমি ভালোবাসি,' বলেন তিনি।
দক্ষিণ এশীয় স্ট্রিটফুড নিয়ে একটি ভিডিও নির্মাণের জন্য কলকাতায় বেশ কয়েকবার আসেন ডানকান। সেখান থেকেই ঝালমুড়ির প্রতি তার আগ্রহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ঝালমুড়িএক্সপ্রেস' নামের প্রফাইলের মাধ্যমে গত ১৭ বছর ধরে তিনি ইংল্যান্ডে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন।
ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরুর প্রসঙ্গে ডানকান বলেন, "আমি তখন পথেঘাটে থাকছিলাম। গাড়ি বা গণপরিবহনে বিক্রি করা সম্ভব এমন একটি ব্যবসা শুরু করার দরকার ছিল যা কম খরচেই হবে, আবার বানানোও কঠিন নয়।"
"কিন্তু ঝালমুড়ির মতো অন্য কোনো খাবারকে আমি সীমা ছাড়িয়ে এত বেশি জনপ্রিয় হতে দেখিনি। প্রথম যখন যুক্তরাজ্যের অস্বচ্ছল এক পাড়ার বাজারে এটা নিয়ে আসলাম, সবাই তা গ্রহণ করল। সেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ সব মানুষ থাকত। রাস্তার কোণায় সবার চোখের সামনেই খাবারটি বানিয়ে ফ্রেশ বিক্রি করা হতো," বলেন তিনি।
কিন্তু তারপরও বাংলাদেশি স্ট্রিটফুডের অভিজ্ঞতা লন্ডনে দেওয়া সম্ভব না, কেননা ঝালমুড়ি খাওয়ার মধ্যে একটা গোষ্ঠীগত একাত্মতার বিষয়ও কাজ করে।
ঢাকার স্থপতি নিশাত তাসনিম অরণী বলেন, "বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়াটা দারুণ। কেননা এর টক-মিষ্টি-ঝাল আর মুড়মুড়ে স্বাদ আড্ডার দারুণ এক পরিবেশ তৈরি করে।" উপকরণগুলো সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি সহজে বানানো যায় বলে বাড়িতেও তা খাওয়া যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. লতিফুল বারী বলেন, বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে জিনিসটি মিশে আছে। "কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন বিকেলে চায়ের সঙ্গে কী খেতে পছন্দ করেন। উত্তর যদি হয় ঝালমুড়ি তবে বুঝবেন তারা বাংলাদেশি।"
স্থানীয়রা ঝালমুড়ি খাওয়ার অলিখিত নিয়মও তৈরি করে রেখেছে। চামচ দিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়া ঘোরপাপ আর অজ্ঞতার পরিচয় দিবে। সাইরার মতে, হাতমুঠো করে মুড়ি নিয়ে সেটা সাবলীলভাবে মুখে নেওয়াটা বাংলাদেশিদের বাইরে কারও পক্ষে রপ্ত করা কঠিন।
যারা নিয়মিত খায় তাদের জন্যও এটা এক খেলার মতো। কারণ ঝালমুড়িওয়ালা যখন জিজ্ঞেস করেন 'কতটুকু ঝাল দিব?' তখন যেন খেলার মতোই রীতিমতো ডেয়ারিং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে একেকজনের সাহসিকতা ঝালাই করা হয়।
বেশকিছু বিক্রেতা ডিম কিংবা কোয়েলের মাংস দিয়ে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু যারা ঝালমুড়ির চিরাচরিত রূপটিই পছন্দ করে, তাদের জন্য এটা দারুণ এক নিরামিষ খাবার যেখানে পরিচিত উপকরণগুলোই দুর্দান্তভাবে পরিবেশিত হচ্ছে।
"আমি মনে করি এখান থেকে যে তৃপ্তি মিলবে তা অন্য কোথাও পাওয়া অম্ভব না। স্থান কিংবা পরিবেশভেদে ঝালমুড়ির স্বাদও বদলে যায়। আসল ঝালমুড়িতে একই ঠোঙা থেকে নেওয়া দুমুঠো মুড়ির স্বাদ ভিন্ন হতে পারে। দামি মাংসযুক্ত ঝালমুড়িতে সেই রোমাঞ্চকর ব্যাপারটি নেই।"
পরিশেষে বলা চলে, বাংলাদেশের ঝাল এই খাবার শৈল্পিক এক ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে জাগতিক বিষয়েও অবর্ণনীয় রহস্যের স্বাদ দিবে। "বেশি শুকনা করে খেতে মজা নয়, আবার বেশি আগে বানানো হলে বা তরল উপকরণগুলো ভুল হলে মুড়ি নরম হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঠিকভাবে বানানো হলে পুরো মজাটা পাবেন যা অন্য কোথাও মিলবে না," বলেন সাইরা।
- সূত্র: বিবিসি ট্রাভেল; ইংরেজিতে লিখেছেন আয়েশা ইমতিয়াজ