যেভাবে ব্রিটিশদের পরিচিত করা চা ক্রমশ হয়ে উঠলো পাকিস্তানিদের আটপৌরে পানীয়
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের একজন মন্ত্রী আহসান ইকবাল দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে জনগণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন চা খাওয়া কমিয়ে দিতে। এরপর একটি টুইটে তিনি পাকিস্তানের চা আমদানির বার্ষিক বিলের চিত্র তুলে ধরেন। পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা আমদানিকারক দেশ। ২০২০ সালে দেশটি চা কেনার জন্য ৫৮৯.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে।
চা ভালোবাসে পাকিস্তান
চা বা 'চাই' পান করতে ভালোবাসেন পাকিস্তানিরা। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, চায়ের বয়স প্রায় পাঁচ হাজার বছরের কাছাকাছি। হালের কবিতা থেকে গড়পড়তা টিভি সিরিয়াল, সবকিছুতেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চা। পাকিস্তানের সবচেয়ে ছোট্ট গ্রামটি থেকে শুরু করে, মেট্রোপলিটন শহর; চায়ের স্বাদ পাওয়া যাবে সবখানে। নতুন বউ বাড়িতে এলে তার গুণের বিচার করা হয় তিনি কত ভালো চা তৈরি করতে পারেন তা দিয়ে। এক কাপের চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে হয়ে যায় বিলিয়ন ডলারে ব্যবসায়িক চুক্তি।
কিন্তু পাকিস্তান কীভাবে চা-কে এত আটপৌরে করে নিল? চলুন জেনে নেওয়া যাক সে গল্প। পাকিস্তানের সাথে চায়ের সম্পর্ক খুঁজতে গেলে স্বভাবতই ঔপনিবেশিক অতীতের কথা পাড়তে হবে। তবে তার আগে জানতে হবে এশিয়ায় চায়ের ইতিহাস।
এশিয়ায় চা
অনেকে মনে করেন চায়ের উৎপত্তি চীনে, প্রায় ৪৭০০ বছর আগে। আবার কারও কারও মতে চা এসেছে ভারত থেকে। তবে বিতর্ক থাকলেও এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অনেক আগে থেকেই মধ্য-এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, ভূমধ্যসাগরবর্তী অঞ্চল, ও মধ্যপ্রাচ্যে চায়ের প্রচলন ছিল।
ভৌগোলিকভাবে চা-কে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল টি হর্স সড়ক। সিল্ক রোড থেকে দক্ষিণে যে শাখা রাস্তাটি বেরিয়ে গিয়েছিল সেটিই টি হর্স সড়ক নামে পরিচিত। প্রায় দুর্ভেদ্য কিছু ট্রেইল আর হাঁটাপথের তৈরি এই সড়ক বেশ কয়েক শতাব্দী পুরনো। অনেকে তো মনে করেন টি হর্স সড়কের বয়স ২০০০ বছরেরও বেশি। তিব্বত ও বার্মার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল এ রাস্তাটি।
সে আমলের বণিকেরা টি হর্স সড়ক ধরে ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশ থেকে চা-পাতার খণ্ড (তখনকার দিনে চা-পাতাকে চেপে ইটের টুকরার মতো করে পরিবহন করা হতো) নিয়ে চলে যেতেন তিব্বতে। তার বিনিময়ে তারা তিব্বত থেকে নিয়ে আসতেন বলিষ্ঠ টাট্টু ঘোড়া।
অষ্টম শতকে চায়ের উপস্থিতি ভারতেও ছিল। কিন্তু এখনকার মতো জনপ্রিয় পানীয় হয়ে ওঠেনি তখনো। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন বন্দরশহরে চা বেশি পান করা হতো। চা গণমানুষের রোজকার পানীয় হয়ে উঠেছিল আরও অনেক পরে। স্থানীয় ভারতীয়রা সে সময় লাচ্ছি, ও বিভিন্ন ফলের রস খেতেন। ব্রিটিশরা আসার আগ পর্যন্ত ভারতে চা পান ততটা জনপ্রিয় হয়নি।
ভারতে চা
১৭ শতকে ইউরোপকে চায়ের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় ওলন্দাজেরা। তখন বনেদী ইউরোপীয়রা চায়ের মধ্যে ভেষজ গুণাবলী আছে ভেবে চা পান করতেন। চা ক্রমশ ইউরোপে শিল্প-সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদির প্রতীক হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ইউরোপের সাধারণ জনগণ, বিশেষত ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চরা চায়ের স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করেন।
১৯ শতকের শুরু থেকেই চীন থেকে বিপুল পরিমাণে চা আমদানি করতে শুরু করে ব্রিটিশেরা। একসময় তারা মনে করলো, এভাবে চা আমদানি করতে থাকলে রাজকোষে আর কোনো অর্থ অবশিষ্ট থাকবে না। তখন তারা চা নিয়ে তাদের কৌশল বদলাল।
ততদিনে ভারতের বেশিরভাগ অংশ ব্রিটিশরাজের অধীনে। চতুর ব্রিটিশরা তখন চীনা বণিকদের কাছ থেকে ভারতীয় আফিমের বদলে চা কিনতে শুরু করলো। এ কৌশল এতটা সাফল্য পেল যে ১৮৩০-এর দশকে ব্রিটিশ আর চীনের মধ্যে আর তেমস বাণিজ্য ঘাটতি রইল না, বরং এ ঘাটতি চীনের দিকে মোড় নিল।
তবে ব্রিটিশদের এ সুখ বেশিদিন রইল না। চীনের জন্য আফিমের আমদানি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হিসেবে আবির্ভূত হলো। তখন কিং রাজবংশের শাসকেরা আফিমের সরাসরি বাণিজ্য নিষিদ্ধ করলেন এবং ১৮৩৮ সালে ক্যান্টনে থাকা ব্রিটিশ আফিমের মজুত পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দিলেন। এ ঘটনার জেরে শেষ পর্যন্ত চীন-ব্রিটেনের মধ্যে প্রথম আফিমের যুদ্ধ শুরু হলো। এরপরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ বলে আরেকটি যুদ্ধ হয়েছিল।
দুইটি আফিমের যুদ্ধের ফলে চীনের জন্য চা রপ্তানির আরও অনেকগুলো পথ খুলে গেল। এদিকে ব্রিটিশরা দেখল চায়ের ব্যবসায় অনেক লাভ। তাই নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলে চা চাষের চেষ্টা করতে লাগলো তারা। অবশ্য এ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল ১৭৫৭ সাল থেকেই। তবে পঞ্চাশ বছরেও এ চেষ্টায় কোনো সুবিধা করতে পারেনি তারা।
এরপর ১৮২৩ সালে এক স্কটিশ মেজর টের পেলেন, চাইলে আসামে চা চাষ করা যেতে পারে। এভাবেই ভারতবর্ষে শুরু হলো চায়ের চাষ। চীনের চারা থেকে আসামে তৈরি হওয়া চা প্রথমবারের মতো লন্ডনে পাঠানো হলো ১৮৩৮ সালে। আসাম টি প্ল্যান্টেশন প্রতিষ্ঠা করলো ব্রিটিশরা। ১৮৬০-এর দশক থেকেই তৎকালীন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে চা চাষ ছড়িয়ে পড়লো।
চায়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি
ভারতবর্ষে প্রাথমিকভাবে চা জনপ্রিয় ছিল ব্রিটিশ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কাছে। ১৯০০ সালের পরে টি অ্যাসোসিয়েশন অভ ইন্ডিয়া বিভিন্ন মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে চা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে চা পানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চা ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন রাজকর্মচারীর দপ্তরে চায়ের প্রচলন ঘটানো হয়। চা-কে মানসিক বলবর্ধক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এর ফলে সাধারণের মধ্যে চা পানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এতে করে ব্রিটিশরা যেমন বাড়তি রাজস্ব আয় করতে পারলো, পাশাপাশি চা-পানের সাথে 'ব্রিটিশ' হওয়ার একটি অনুভূতি জড়িয়ে গেল। আর বেশিরভাগ ভারতীয় মননে তখন ব্রিটিশ আর সভ্যতা সমার্থক ছিল।
চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য কারখানা, খনি, রেলস্টেশন ইত্যাদি স্থানে চায়ের দোকান বসানো হলো। তবে কেবল ১৯৫০-এর দশকেই চা মূলত জনগণের পানীয় হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মজার ব্যাপার হলো, যে চা-কে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের কাছে পরিচিত করে তুলেছিল, সে চা-ই এখনো ব্রিটেনে 'বিদেশি' পানীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। হাল আমলে এ উপমহাদেশ থেকেই নতুন পরিচয়, স্বাদ ও গন্ধে পশ্চিমে যাচ্ছে চা।
আটপৌরে চা
চা ছিল সস্তা (এখনো আছে)। তাই দুবেলা চা পানে বিশেষ খরচ করতে হতো না। এ একটি কারণে চা ঔপনিবেশিক সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু দেশভাগের পর আরও কিছু কারণে চায়ের জনপ্রিয়তা এখনো হারায়নি, বরং বেড়েই চলছে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিদায় নেওয়ার পর বিক্রেতারা চা-কে দেশীয় হিসেবে নতুন রূপ দিলেন। চা উৎপাদনকারী, বিক্রেতা, চা সমিতি সবাই চেষ্টা করল চা-কে একটি জাতীয় প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে।
পাকিস্তানি ও ভারতীয়দের জন্য চা একটি সাধারণ পানীয় হয়ে উঠলো। চা-কে দেখা হলো জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব সবকিছুর ওপরে। ১৯৬০-এর দশকে ভারত ও পাকিস্তানে চায়ের বিজ্ঞাপনগুলোতে এ থিমটি স্পষ্ট দেখা যায়। আর এটি একটি বড় কারণ পাকিস্তানি ও ভারতীয়রা চায়ের সাথে কখনো বিচ্ছেদ ঘটায়নি।
আর্থ-সাংস্কৃতিক দিক থেকে চা বা চাই পান করাটা আর পাকিস্তানি হওয়াটা একে অপরের সমতুল্য হয়ে গেছে এখন। ব্রিটিশ পানীয় থেকে খুব সহজেই চা পাকিস্তানি পানীয় হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই মন্ত্রী আহসান ইকবালের কথামতো কোনো পাকিস্তানি যদি দিনে কয়েক কাপ চা খাওয়া বাদ দিয়ে দেন তাহলে তিনি নিজের জীবনের একটি অংশকে হারিয়ে ফেলবেন।
পাকিস্তানে চা জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে ঔপনিবেশিক সময়ের অনেক ধারণাও সাহায্য করেছিল। যেমন ব্রিটিশ শাসনের সময় চা-কে উন্নয়নের প্রতিভূ হিসেবে দেখা হতো। একইভাবে সদ্যস্বাধীন পাকিস্তানেও চা ছিল উন্নয়েন একটি প্রামাণিক প্রতীক। ব্রিটিশ আতিথেয়তার অংশ ছিল চা, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও চা আতিথেয়তার অপিরহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। আবারও এমনও বলা যায়, ব্রিটিশদের জন্য 'ভালোবাসা' বা যেকোনো রকমের 'কলোনিয়াল হ্যাংওভার' চায়ের মাধ্যেম টিকিয়ে রেখেছে পাকিস্তানিরা। তাই আর যা-ই হোক, কোনো মন্ত্রীর আহ্বানে চায়ের কথা বেমালুম ভুলে যাবেন না পাকিস্তানিরা।
সূত্র: দ্য ডন