আমরা কি বোকার স্বর্গে বাস করছি? ১০-২০ বছরে বনের বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা যায় না
'রয়েল' বেঙ্গল টাইগার বলে আদতে কিছু নেই। যা আছে সেটা হলো বেঙ্গল টাইগার।
কথাটা শুনে অনেকে মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন, তাই শুরুতেই এটা পরিষ্কার করে বলে রাখি, জীববিজ্ঞানের দুনিয়ায় 'রয়েল বেঙ্গল টাইগার' নামে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।
বাঘের আদি ইংরেজি নাম বেঙ্গল টাইগার দিয়েছিল সাদা চামড়ার মানুষেরা। বঙ্গশার্দূলের বৈজ্ঞানিক নাম প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস। অতীতে বেঙ্গল টাইগারের নয়টি উপ-প্রজাতি থাকলেও এখন তিনটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বর্তমানে আইইউসিএন-এর লাল তালিকা অনুযায়ী মহাবিপন্ন বা বিপন্ন।
১৯২৯ সালে বম্বে ন্যাশনাল হিস্ট্রি সোসাইটির জার্নালের 'টাইগার্স' শীর্ষক নিবন্ধে আর আই পোকক লিখেন, 'সুতরাং বেঙ্গল টাইগার প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস প্রজাতির প্রতিনিধি ও ব্রিটিশ ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের একটি উদাহরণ হিসেবে রইল।'
পোকক আরও জানান, 'একথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, ভবিষ্যতে ভারতীয় বাঘের আরও জাত আবিষ্কৃত হতে পারে। বর্তমানে আমি ভারতের সব বাঘকে একই জাতের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে অভিহিত করছি। এর নাম হচ্ছে- প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস লিন (লিনিয়াস)।'
কারও পক্ষে কি বন্য বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা সম্ভব?
বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা, অথবা জল বা স্থলের প্রধান যেকোনো মাংসাশী প্রাণীর সংখ্যা ১০, ২০, এমনকি ১০০ বছরেও দ্বিগুণ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে তো নয়ই, এটা বিশ্বের কোনো জঙ্গলেই সম্ভব নয়।
এ সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে কেবল তখনই যখন বাঘের রিজার্ভ ফরেস্ট বা অভয়ারণ্যের আয়তন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো যাবে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্যপ্রাণী চলাচলের অবাধ করিডোর তৈরি ও বজায় রাখা যাবে, এবং চোরাশিকার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যাবে।
আমি বিশ্বাস করি বর্তমানে প্রশাসনে অনেক বিচক্ষণ কর্মকর্তা রয়েছেন, অতীতের প্রশাসনগুলোতেও ছিলেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে অবস্থা দেখে মনে হয় যারা বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করার সাথে সংশ্লিষ্ট, তারা বাঘ বা বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধার বিষয়ে অজ্ঞ অথবা তাদের এ বিষয়টি বিশেষ কোনো মাথাব্যথা নেই।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একবার একজন বনমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি কাপ্তাই হ্রদে জলহস্তী আনার ব্যবস্থা করবেন। এ তৃণভোজী প্রাণীটির নিবাস আফ্রিকায়, বাংলাদেশে এটি কখনো স্থানীয় প্রাণী হিসেবে ছিল না। আফ্রিকা মহাদেশে সিংহ আর চিতাবাঘের মিলিত আক্রমণের চেয়ে জলহস্তীর আক্রমণে বেশি মানুষ মারা যায়। আরেকবার একজন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, 'পরিযায়ী পাখিরা বিদেশি। এরা বাইরে থেকে আমাদের দেশে এসে সব খাবার খেয়ে যায়, এদেরকে মেরে ফেলা বা ধরে খেয়ে ফেলা উচিত।'
আমার মনে আছে একবার একজন বিশেষজ্ঞ আন্তর্জাতিক বাঘ সংরক্ষণ ফোরামে মত দিয়েছিলেন, আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করবে। কিন্তু আমরা ওই দশক পার করে ফেলেছি। অথচ আমাদের বাঘের সংখ্যা বিশ বছর আগের মতোই আছে। সংখ্যাটা স্রেফ ১০ শতাংশ কম-বেশি হয়েছে।
চিড়িয়াখানা বা যেকোনো আবদ্ধ প্রজননকেন্দ্রে ১০ বছরে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ করা সম্ভব, কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশে নয়। চিড়িয়াখানা হচ্ছে পোল্ট্রি ফার্মের মতো একধরনের অ্যানিমেল ফার্ম। এখানে সুষম খাবার, সঙ্গী, পর্যাপ্ত পরিমাণ স্থান ও বাচ্চা পালনের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে প্রতি ছয় থেকে নয় মাসে তিন থেকে ছয়টি বাচ্চা বাঘ জন্ম নেবে।
নিঃসঙ্গ পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বাঘকে প্রতি মৌসুমে পাঁচ থেকে ছয়টি বাঘিনীর সাথে মিলনের ব্যবস্থা করা যায়। এরপর বাচ্চা বাঘ জন্ম নিলে সেগুলো বাঘিনীর কাছ থেকে নিয়ে এসে মানুষের মাধ্যমে পরিচর্যা করতে হয়। এভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার যে কোনো বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্র একই বয়সের ২০টি পর্যন্ত পুরুষ ও স্ত্রী বাঘ সরবরাহ করতে পারে। কোনো চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক ইত্যাদির জন্য এ ধরনের আবদ্ধ প্রজনন কেন্দ্র থেকে বাঘ সংগ্রহ করা যায়।
কিন্তু বন্য পরিবেশে এটা সোজা কথায় একেবারেই সম্ভব নয়।
সুন্দরবনে বাঘেরা কি বন্দি?
সুন্দরবনকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক।
জৈবিকভাবে দেখতে গেলে, একজোড়া প্রজননক্ষম বাঘের খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য বছরে ৫০০টি চিত্রা হরিণ দরকার হয়। এর পাশাপাশি বাঘগুলো কিছু বুনো শূকর, বানর, ও অন্যান্য প্রাণীও খেতে পারে।
এ অনুমানটি করা হয়েছে ভারতের কর্ণাটকের ড. উলহাস কারান্থ ও তার সহকর্মী, বাংলাদেশের ড. মনিরুল এইচ খান, এবং ড. অ্যাডাম বার্লো'র করা গবেষণার ওপর ভিত্তি করে।
এখন, সুন্দরবনে হরিণ, শূকর, বানর ইত্যাদি প্রাণীর সংখ্যা সীমিত। আর এগুলোর সবগুলোই বিভিন্ন গাছপালার ওপর নিজেদের খাবারের জন্য নির্ভরশীল। যদিও বানর ফল-পাতার বাইরেও কিছু প্রাণীকেও খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।
সুন্দরবনের গাছপালা ও অন্যান্য উদ্ভিদের পরিমাণও নির্দিষ্ট। এটি নির্ভর করে জমি, বৃষ্টি, আর্দ্রতা, জোয়ার, দিনের আলোর দৈর্ঘ্য, শিকারী প্রাণী, কীটপতঙ্গের চাপ ইত্যাদির ওপর।
এ কারণেই সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ১০ শতাংশ কমবেশির মধ্যেই এখনো সীমাবদ্ধ রয়েছে।
বাঘ বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, খাবার ও বিচরণের পর্যাপ্ত জায়গাসমৃদ্ধ একটি আদর্শ বনে একটি প্রজননক্ষম বাঘের চলাফেরা ও বসবাসের জন্য কমপক্ষে ১০ বর্গ কিলোমিটার জায়গার প্রয়োজন হয়। বনের পরিস্থিতি ও শিকারের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে এটি ১০ থেকে ৫০ বর্গ কিলোমিটার হতে পারে।
আদর্শিকভাবে, একটি পুরুষ বাঘের এলাকা (টেরিটরি) হলো ৫২ বর্গ কিলোমিটার। স্ত্রী-বাঘের জন্য এ স্থান ৪৪ বর্গ কিলোমিটার। নিজেদের আস্তানায় বাঘেদের একাধিক আবাসস্থল (গুহা) থাকে। বিভিন্ন সময়ে তারা সেগুলো পরিবর্তন করে।
সুন্দরবনের আয়তন ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগ ৪০০০ কিলোমিটার। সে হিসেবে বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনে ৪০০-এর বেশি বাঘ থাকার কথাই না। এখন পর্যন্ত সুন্দনবনে বাঘের সংখ্যা কখনো ৪০০ হয়েছে বলে জানা যায়নি।
সুন্দরবনে প্রতিবছর কিছু বাঘ মারা যায়, কিছু বাঘকে বিষ দিয়ে মারা হয়। আবার চোরাশিকারিরাও বাঘ শিকার করে। লোকালয়ে কোনো বাঘ ঢুকে গেলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ।
বাঘ যখন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, শিকার করতে পারে না, অথবা দাঁত পড়ে যায় তখন নিজের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
আবার যখন বাচ্চা বাঘ বড় হয়ে যায়, তখন বাবা বাঘ বা টেরিটোরির অন্যান্য পুরুষ বাঘ এ তরুণ বাঘগুলোকে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। জঙ্গলের নিয়মে তখনো অনভিজ্ঞ এ বাঘগুলো নিজেদের নতুন এলাকা তৈরি করে উঠতে না পারলে তারা বন ছেড়ে গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। সুন্দরবন সীমান্তবর্তী এসব গ্রামে অনেক মানুষ তাদের গবাদিপশু নিয়ে বাস করে।
এ তরুণ বাঘেরা বাঘ-মানুষের সংঘাত অঞ্চলে প্রবেশ করে। শেষ পর্যন্ত এ বাঘগুলোর অধিকাংশ আর টিকে থাকতে পারে না।
তাই সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই অল্প পরিমাণ ওঠা-নামা ছাড়া কখনো বেড়ে উঠতে পারে না। এসব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, সুন্দরবন বাঘের জন্য বসবাসের আদর্শ কোনো জায়গা নয়।
এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনের বাঘগুলো মানুষের দ্বারা বনের মধ্যে একপ্রকার 'বন্দিদশায়' বাস করে। কারণ হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশ থেকে শুরু হওয়া এই পাললিক সমভূমি এখানকার বনগুলোকে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এ কারণে, সুন্দরবন থেকে বাঘ বেরিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যান্য অংশে ও মায়ানমারে যেতে পারে না। কোনো বাঘ কখনো পরিযায়ী হতে চাইলেও সুন্দরবনের আশেপাশের মানুষের হাতেই নিহত হতে হয় তাকে।
কোনো বাঘকে গ্রামবাসীর হাত থেকে উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দিলেই যে সেটির জীবন বেঁচে যায় তাও নয়। অনেক সময় বনে ফিরতে পারলেও নিজেদের ডেরায় আর প্রবেশ করতে পারে না সমাজচ্যুত এ বাঘগুলো। তখন বনের ভেতরে তাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যায়।
তাই যথাযথ পরিমাণে জঙ্গল ও শিকারের ব্যবস্থা করা ছাড়া বন্য পরিবেশে কোনো মানবশক্তিই বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পারবে না।
আর সুন্দরবনের আয়তন বাড়ানোও অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত কোনো উপায় নয়। কারণ এ কাজ করতে গেলে বনের আশেপাশের অসংখ্য মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হবে।
যা-ই হোক, নেপাল, ভূটান ও ভারতের কিছু টাইগার রিজার্ভ বাঘের বিচরণস্থল বৃদ্ধি করার মাধ্যমে তাদের বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।
পাশাপাশি এ দেশগুলো বাঘ আছে এমন বনগুলোর মধ্যে বাঘ ও বাঘের খাদ্য প্রাণীগুলোর চলাচলের জন্য করিডোর তৈরি করে দিয়েছে। এছাড়া এসব দেশ সফলভাবে চোরাশিকার বন্ধ করতে পেরেছে।
তবে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে, প্রাণীরা যে হারে উদ্ভিদকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে, উদ্ভিদ একই হারে বৃদ্ধি পায় না। তাই পরিবেশ বাড়িয়েও যে বাঘের সংখ্যা একটানা বাড়ানো যাবে তাও কিন্তু নয়। আবার নিজেদের টেরিটোরি নিয়ে বাঘগুলো অনেক সময় নিজেদের মধ্যেও লড়াই করে।
নতুন দ্বীপে ম্যানগ্রোভ ও হরিণ বাড়ানো?
উদাহরণস্বরূপ, কোনো প্রকার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই সরকার দেশের দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলে নতুন সৃষ্ট দ্বীপগুলোতে হরিণ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
উপকূলে বনায়ন প্রক্রিয়াটিও প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ। নতুন করে জন্ম নেওয়া দ্বীপে বনবিভাগ দুই থেকে চার প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ লাগিয়েছে। কিন্তু এ কাজের আগে উচিত ছিল বালুতটে স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি ও নতুন প্রাণী ও উদ্ভিদকে প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠার জন্য সময় দেওয়া।
এর ফলে ওই দ্বীপগুলোতে হরিণের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, তাতে মানুষ-হরিণের নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে এখন কি আমরা চাইলেই ঢাকার চিড়িয়াখানা বা দেশের দুটো সাফারি পার্ক থেকে বাঘ এনে এসব হরিণসমৃদ্ধ দ্বীপে ছেড়ে দিতে পারি?
দৃশ্যটি কল্পনা করুন।
এখানে একটা বা একাধিক বাঘ ছেড়ে দিলে সেগুলো ওই হরিণ দেখে ভয় পাবে। কারণ এর আগে ওই বাঘগুলো এমন প্রাণীকে কখনো দেখেনি।
কিন্তু ধীরে ধীরে ধাতস্থ হওয়ার পর বাঘগুলো নির্বিচারে হরিণ শিকার করতে শুরু করবে। এ হরিণগুলো আবার খেঁকশিয়াল বাদে জীবনে আর কোনো শিকারী প্রাণী দেখেনি। এগুলোর আচরণ বাঘের সামনে গড়পড়তা গৃহপালিত প্রাণীর মতো হয়ে যাবে।
এক-দুবছরের মধ্যেই বেশিরভাগ হরিণ বাঘের মুখে বেঘোরে প্রাণ হারাবে। হরিণ শেষ হয়ে গেলে বাঘগুলো খাবারের জন্য, বিশেষত গবাদিপশুর জন্য লোকালয়ে হানা দেওয়া শুরু করবে। এরকম হলে বাঘে-মানুষে সংঘাত বেড়ে যাবে, দুপক্ষেরই প্রাণহানি ঘটবে।
আমাদের মনে রাখা উচিত, সারাবিশ্বে কেবল একবারই একটি বেঙ্গল টাইগারকে জনৈক দ্বীপ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দবনের স্থানান্তর হরা হয়েছিল। সেবার নবাগত ওই বাঘটিকে ওই অঞ্চলের স্থানীয় বাঘ এক মাসের মধ্যে মেরে ফেলেছিল।
প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানে 'কোনো শূন্যস্থান' নাই। এক প্রাণী মারা গেলে আশেপাশের অন্য কোনো সত্তা ওই শূন্যস্থান খুব দ্রুতই দখল করে নেয়।
এখন প্রশ্ন জাগে, আমাদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির মাননীয় সদস্যরা সিলেট বা বৃহত্তর চট্টগ্রামে বেঙ্গল টাইগারকে পুনরায় পরিচিত করে দেওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা বাস্তবসম্মত কি না?
আমার বা অন্য যেকোনো বিজ্ঞানীর উত্তর একটাই হবে, না।
সর্বপ্রথম প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৯৯ শতাংশ বনাঞ্চল, শালবন ইত্যাদি থেকে বাঘ কেন হারিয়ে গেছে?
এর সহজ উত্তর হলো, ওসব স্থানে বাঘেদের নির্জনে বাস করা বা বেড়ে ওঠার জায়গা নেই। ওই অঞ্চলের বনগুলোতে বাঘেরা এ সুবিধা পায় না, বন রক্ষণাবেক্ষণেও বিশেষ পরিকল্পনা নেই, আর আদিবাসীদের কয়েক শতকের জুমচাষ; এসব কারণে ওই বনগুলোতে বাঘের টিকে থাকা দুরূহ।
এসব বনে হরিণ, বুনোষাঁড়, বুনো শূকর ইত্যাদি শিকারেরও উপস্থিতি নেই।
বাঘকে চামড়া, মাংস, হাড় ইত্যাদির জন্য অনেককাল আগে থেকেই শিকার করেছে মানুষ। এক্ষেত্রে কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি পাহাড়ের জীবনযাপনের জ্ঞান বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ বাঙালিকে পাহাড়ে বাস করতে দিয়েছিলেন। এই বাঙালিরা চাষবাস ও বসবাসের জন্য নজিরবিহীন হারে বনের জমি দখল করেছে।
খারাপ বিনিয়োগে কখনো টাকা ব্যয় করা উচিত নয়?
কেউ যদি বাঘের পেছনে অর্থ খরচ করতে চায়, তবে সেটা কেবল সুন্দরবনেই হওয়া উচিত। অন্য জায়গায় বাঘের বংশবিস্তার করানোর চেষ্টা বিফলে যাবে, কারণ এ স্থানগুলো এখন কেবল মানুষের বসবাসযোগ্য।
যদি ভারত ও মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নতুন করে বাঘের বংশবিস্তার ও অন্যান্য প্রাণীকে সংরক্ষণ করার জন্য বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষের উচিত সবার আগে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী সময়ের মতো বনাঞ্চলের পরিবেশ নিশ্চিত করা। যে বন থাকবে মানুষের আনাগোনার বাইরে, কেবল কিছু আদিবাসী গোত্র সেখানে বাস করবে, কোনো বাঙালি নয়।
যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ও বজায় না রাখা গেলে কোনো বন্যপ্রাণীকেই টেকানো যাবে না। এর বাইরে অন্য কোনো প্রকল্প কেবল কিছু তথাকথিত বিজ্ঞানী, বনবিভাগের কর্তা, প্রশাসনিক কর্তা, স্থানীয় দালাল আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের পকেট ভারি করা ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না।
আলাদা বন্যপ্রাণী বিভাগ তৈরি ও বন্যপ্রাণী বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধার
বাঘের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার করার মিথ্যা স্বপ্নের বদলে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর উচিত বৃহত্তর সিলেট ও বিভাগীয় চট্টগ্রামে চিরহরিৎ বনগুলোর বাস্তুসংস্থানকে ১৯৪৭ সাল-পূর্ববর্তী অবস্থার ন্যূনতম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পুনরুদ্ধার করার কাজটি বিবেচনা করা।
এ ধরনের রিজার্ভ ফরেস্ট ও অভয়ারণ্যকে নতুন সৃষ্ট বন্যপ্রাণী বিভাগের দায়িত্বে নিয়ে আসা হোক। এই বিভাগের কাজ হবে বন্যপ্রাণী ও বন রক্ষা করা, গাছ না কাটা ও স্থানীয় গাছকে বিদেশি-অপরিচিত গাছ দিয়ে প্রতিস্থাপন না করা ইত্যাদি দিক নিশ্চিত করা।
এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে নতুনভাবে প্রাণ পাওয়া এ বনগুলোতে ছোটখাটো প্রজাতিগুলো নির্বিঘ্নে টিকে থাকতে পারবে। এসব প্রজাতির মধ্যে রয়েছে হুলক গিবন, বানরের বিভিন্ন প্রজাতি, লজ্জাবতী বানর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, খাটাশ, বেজি, বিনতুরং, খেঁকশিয়াল, শিয়াল, ছোট হরিণ, চিতা ও বাঘ ব্যতীত অন্যসব বুনো বিড়াল ইত্যাদি।
এর বাইরে হর্নবিল, ময়না, টিয়া ইত্যাদির মতো অনেক প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ ও জলজ প্রজাতি আমাদের বনগুলোতে ফিরে আসবে ও সংখ্যায় বংশবৃদ্ধি করবে। এতে বনে শিকার ও শিকারী উভয় প্রজাতিই বাড়বে।
- ড. রেজা খান: প্রধান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, দুবাই সাফারি পার্ক, পাবলিক পার্কস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ডিপার্টমেন্ট, দুবাই মিউনিসিপালিটি।
- ভাষান্তর: সুজন সেন গুপ্ত