টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ৬ বছর ধরে মানুষের পাশে তারা
হাতখরচ বাঁচিয়ে নিজের শখপূরণের প্রবণতা স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে দেখা যায় প্রায়ই। তবে নিজের জন্য বরাদ্দ সামান্য এ টাকা বাঁচিয়ে অসহায়, দরিদ্র শিশুদের পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই মোটেও সহজ নয়। এ অসাধ্য কাজটিই করে দেখিয়েছেন সাভারের অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার সদ্য কৈশোর পেরোনো একঝাঁক তরুণ।
মানুষের পাশের দাঁড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে তৈরি করেছেন 'ব্রাদারহুড' নামে একটি সামাজিক সংগঠন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের '১৮ বছর বয়স' কবিতার মতো তারুণ্যে ভরপুর এ তরুণরা কখনও ছুটছেন বন্যাদুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আবার কখনও ঘরের পাশের পঙ্গু বৃদ্ধের মুখে হাসি ফোটাতে সবজি ভ্যান কিনে করে দিচ্ছেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল সাভারের আশুলিয়ার কাছে কাজ শুরু করে 'ব্রাদারহুড' নামে সংগঠনটি। প্রাথমিকভাবে ১৩৫ জন স্কুলপড়ুয়া কিশোরের উদ্যোগে শুরু হয় সংগঠনটির কাজ। এরপর আর থেমে থাকেনি তারা।
প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি, একইসঙ্গে নিজ এলাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার একই বয়সী কিশোরদের একত্রিত করার প্রয়াসে কখনও ক্রিকেট বা ফুটবল টুর্নামেন্ট, কখনও রক ফেস্টের আয়োজন করে তারা। মানুষের সেবার পাশাপাশি এসব আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ সমাজকে সচেতন করা এবং ব্যস্ত রাখাই ছিল এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। বর্তমানে সংগঠনের বেশিরভাগের বয়স ১৮-২০ বছর। যাদের অধিকাংশই কলেজ শিক্ষার্থী অথবা এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ফারভিদ মিরাজ বলেন, 'ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে থাকতে, খেলাধুলা করতে পছন্দ করতাম। বিশ্বাস করতাম বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্বই আমাদের একসঙ্গে রাখতে পারে। প্রতিটি খেলায় জয়ও এনে দিতে পারে। সেখান থেকেই একটি সংগঠন গঠনের পরিকল্পনা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-ছোট ছেলেদের চা-বাদাম বিক্রি করতে দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগতো। পরে সবাই মিলে একটি নাম ঠিক করে কাজ শুরু করে দিলাম। তারপর কেউ যখন আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসতো- আমরা সম্মিলিতভাবেই সাহায্য করতাম। খেলার মাঠ থেকেই আমাদের পরিবার এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে ব্রাদারহুড নামটিকেই নির্বাচন করা, পরে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের মাধ্যমে সংগঠন হিসেবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করি।'
গত ৫ বছর ধরে এ ধরনের কাজে সংগঠনটির অর্থায়ন কীভাবে যোগাড় হয়, এ প্রসঙ্গে মিরাজ বলেন, 'নির্বাহী কমিটির সদস্যরা প্রতিমাসে নিজেদের হাতখরচের টাকা জমা করে সংগঠনের কাজে ব্যবহার করি। এছাড়া আমাদের বড় প্রজেক্টগুলো সম্পন্ন করতে বাবা-মায়ের কাছে সব জানাই। উনারা আমাদের অনেক সাহায্য করেন।'
এ প্রসঙ্গে মিরাজের বাবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের সমাজকল্যাণের সহকারী অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, 'অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার ছেলে টিফিনের টাকা জমিয়ে দরিদ্র বেশ কয়েকজনকে কাপড় কিনে দেয়। সেই থেকে শুরু- এরপর বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে ওদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দরিদ্রদের খাওয়ানোসহ বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে। বাবা হিসেবে চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত এসব কাজে উৎসাহ দেওয়ার।'
সংগঠনটি বর্তমানে একটি কার্যনির্বাহী কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কমিটির সদস্য সংখ্যা ৫২ জন। এছাড়া সাধারণ সদস্য হিসেবে ১০০ জন রয়েছে বলে জানালেন মিরাজ।
ভালোবাসার দেয়াল
মানবতার দেয়ালের মতো বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা আমবাগান, ইসলামনগর, পানধোয়া, গকুলনগরে সদ্য কৈশোর পেরুনো এ তরুণ সংগঠকরা তৈরি করেছে "ভালোবাসার দেয়াল'' । যেখানে মানুষ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পোশাক রেখে যায়, দরিদ্র মানুষরা সেখান থেকে প্রয়োজনমতো পোশাক সংগ্রহ করে নেন। সংগঠনটির সাধারণ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশে থাকা এলাকাগুলোর মোট ১০ টি স্থানে এ দেয়াল তৈরি করেছেন তারা। নিজেরাই সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি করেন দেয়ালগুলো।
করোনাভাইরাস মহামারি যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে, সেসময় সবাইকে সচেতন করার উদ্দেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে প্রতিদিন 'ভালোবাসার দেয়ালে' করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আপডেট দিতেন তারা।
এতিমদের জন্য তহবিল
২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর গঠন করা হয় ব্রাদারহুড এতিম তহবিল, আশেপাশের ছিন্নমূল শিশুদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নেয় সংগঠনটি। প্রাথমিকভাবে আটজন অসহায় শিশুকে অর্থ সহায়তা করে তারা। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পুরো পৃথিবী যখন স্তব্ধ, সেসময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কিছুটা ব্যাহত হয় সংগঠনটির শিক্ষা কার্যক্রম। বর্তমানে ৪ জন মাদ্রাসা এবং ৩ জন শিশু স্কুলে অধ্যয়নরত আছে।
এক বৃদ্ধাকে মুরগি পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়েছে । মুরগি পালন করে ও ডিম বিক্রি করে বর্তমানে ওই নারীর পরিবার কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখছে বলে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন সেনওয়ালিয়া এলাকায় বসবাসরত ওই নারী।
বন্যার্তদের পাশে ব্রাদারহুড
বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সাভার উপজেলা শাখার কাছে সিলেটের বানভাসি মানুষের জন্য পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে হস্তান্তর করার বিষয়টি জানালেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফারভিদ মিরাজ। ভর্তি পরীক্ষা সামনে থাকায় নিজে যেতে না পারলেও নেত্রকোনায় বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ দিতে তাদের একটি দল গেছে বলে জানালেন তিনি।
২০২১ সালে সাতক্ষীরায় ভয়াবহ বন্যার সময় সেখানেও সাভারের ৩টি সংগঠনের সঙ্গে ব্রাদারহুড প্রায় ২শ' মানুষকে ত্রাণ দেয়। এছাড়া ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে রক্তদান কর্মসূচি চালানোর কথাও জানান তিনি। মূলত ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে সাভার, আশুলিয়া এবং ধামরাইয়ে অবস্থিত হাসপাতালগুলোতে নিজ উদ্যোগে রক্তদান করে তাদের সংগঠনটি।
অনলাইন লাইব্রেরি
এছাড়া তরুণ প্রজন্মের মাঝে সাহিত্যচর্চার জন্য অনলাইনে একটি গ্রুপ 'সাহিত্য সংলাপ' গঠন করে তারা। এছাড়া তরুণ প্রজন্মের ভেতর বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখতে অনলাইনভিত্তিক ফ্রি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিও তৈরি করেছে সংগঠনটি। 'পৌঁছে দিব জ্ঞানের আলো' নামে এ লাইব্রেরিটিতে বর্তমানে প্রায় ৬০টি বই রয়েছে। এ থেকে বই পড়ার নিয়মও বেশ সহজ, যে কেউ চাইলে এ পাঠাগারের বই পড়তে পারবেন, আবার লাইব্রেরিটির জন্য বই অনুদানেরও সুযোগ রয়েছে। এমনটি জানালেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফারভিদ মিরাজ।
পরিবেশ রক্ষায় ব্রাদারহুড
পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার রাস্তা প্লাস্টিক ও পলিথিন অপসারণের কাজ করছে সংগঠনটি। ২০১৯ সালে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আমবাগান এলাকার রাস্তায় প্লাস্টিক এবং পলিথিন অপসারণ কর্মসূচি গ্রহণ করে তারা। পাশাপাশি বাঁশ দিয়ে ডাস্টবিন তৈরি করে দেয়। প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বৃক্ষরোপণ এবং রাস্তা প্লাস্টিক পলিথিন সরানোর কর্মসূচিও নেয়।
চিকিৎসার জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহ
'দরিদ্র অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় এগিয়ে যাওয়ার নজিরও কম নয় তাদের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মায়ের চিকিৎসায় অর্থসংগ্রহ, আরও বেশ কয়েকজন মুমুর্ষু রোগীর চিকিৎসায় সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করেছি। এছাড়া অন্যান্য নতুন তরুণ সংগঠনগুলোকেও পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে তাদের সাথে কাজ করে যাচ্ছি'- বলেও জানালেন মিরাজ।
২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় কর্মহীন সাধারণ মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেন তারা। এছাড়া সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকাগুলোতেও জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করেন নিজ উদ্যোগে। এমনকী ওইসব এলাকাগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতেও কাজ করেন তারা।
এছাড়া, তরুণদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করতে ফুটবল ক্লাব গঠনসহ সব ধরনের খেলাধুলার সর্বশেষ খবর ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে প্রচার, প্রতি রমজান মাসে ইফতার সামগ্রী বিতরণসহ ঈদে দরিদ্র শিশুদের জন্য ঈদ উপহার দেওয়া, ক্যাম্পাসে বাদাম-চা ইত্যাদি বিক্রি করে- এমন শিশুদের শিক্ষাদান এবং বিনোদন প্রদান এবং যেকোনো জাতীয় দিবসে শিশু-কিশোরদের জন্য চিত্রাঙ্কণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সংগঠনটি। বিশেষ কোনো উপলক্ষে দরিদ্রদের মাঝে খাদ্যবিতরণও করে সংগঠনটি।