অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে পরিবহন শ্রমিকদের
'পেটে ভাত নেই, আমাদের নিয়ে নিউজ করে কি হবে? তিন-চার দিন ধরে যে না খাওয়া সে কথা তো কেউ জিজ্ঞেস করে না। আমাদের কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়। সারাদিনে সকালে একটা বিস্কুট খেয়ে দুপুর পর্যন্ত আছি। টার্মিনালেও থাকতে দেয় না, কোথায় গিয়ে থাকবো আমরা? আমরা তো বাসে কিংবা টার্মিনালেই ঘুমাই ঢাকাতে তো অন্য কোথাও থাকার জায়গা নেই।' কথাগুলো বলছিলেন এনা ট্রান্সপোর্টের হেলপার মো. আজিজুল ইসলাম।
শুধু মহাখালী বাস টার্মিনালের আজিজুলেরই নয়, দেশের সকল পরিবহন শ্রমিকের চিত্র এটি। দেশে চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দেড় বছর ধরেই নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। গত ১লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষেধের কারণে একপ্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল ও গাবতলী বাস টার্মিনালে সরেজমিনে দেখা যায়, টার্মিনালে সারিতে সারিতে রাখা রয়েছে বিভিন্ন রুটের বাস। বাসের হেলপার, ড্রাইভাররা অলস সময় পার করছেন। কেউ কেউ বাস ঝাড়া-মোছায় ব্যস্ত ছিলেন। আবার কিছু কিছু বাস মেরামত করতেও দেখা যায়।
পরিবহন শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কেউ কেউ বাস পাহারা দিয়ে কিছু টাকা পায়, সেটা দিয়ে খাবার খরচ ওঠে। এছাড়া অধিকাংশ শ্রমিকই কোনো কাজ ছাড়াই অলস সময় কাটান বাসে কিংবা টার্মিনালে। অনেকে আবার চলে গিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। কিছু কিছু বাসের ড্রাইভার ও সুপারভাইজারের ঢাকাতে থাকার জায়গা থাকলেও হেলপারদের বাসে কিংবা টার্মিনালেই কাটাতে হয় পুরোটা সময়।
কেউ কেউ অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, আবার অনেকেই ইতিমধ্যে পরিবর্তন করেছে পেশা। তবে এ কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে অন্য কিছু করে দিনযাপনেরও খুব বেশি সুযোগ নেই।
বিভিন্ন বাসের হেলপারি করতেন সাইফুল ইসলাম। লকডাউনের মধ্যে পেশা পরিবর্তন করে এখন রিক্সা চালান সাইফুল।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'পরিবহনও চলে না আমাদের রোজগারও হয় না। না খেয়ে থাকতে হয়। কতক্ষণ না খেয়ে থাকা যায়। তাই সোমবার থেকে রিক্সা চালানো শুরু করেছি'।
এনা ট্রান্সপোর্টের হেলপার মো. আজিজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা যারা বাসের হেলপার তাদের সবাই ই বাসে ঘুমায়। বাস চলাচল করলে দিনে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হতো। তখন নিজের প্রয়োজনমত খরচ করতে পারতাম, সাথে সাথে বাড়িতেও বাবাকে টাকা পাঠাতাম। কিন্তু গত দেড় বছর ধরেই আমাদের দিন খেয়ে না খেয়ে কাটতেছে। মাঝে মাঝে বাস চালু হলে কিছু টাকা উপার্জন হয় পরে বন্ধ হলে জমানো টাকা ভেঙ্গে খাওয়ার পরে ধার দেনা করে চলতে হয়'।
তিনি আরও বলেন, 'রমজানের আগ থেকেই পরিবহন বন্ধ রয়েছে। মাঝে শুধু কয়েকদিনের জন্য চালু হয়েছিল। এখন কঠোর লকডাউন দেওয়ায় না খেয়ে মরার মতো অবস্থা হয়েছে। গত চার দিন শুধু কোনোরকম রুটি, বিস্কুট খেয়ে কাটাচ্ছি'।
এনা পরিবহনের সুপাইভাইজার মো. মারুফ টিবিএসকে বলেন, 'গত লকডাউনে আমাদের শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে কিছু সহযোগিতা করেছিল কিন্তু এবারের লকডাউনে এখনও কোনো সহযোগিতা পাইনি। দেড় বছরের মধ্যে সরকারি কোনো সহযোগিতা আমাদের দেওয়া হয়নি'।
মারুফ আরও বলেন, 'গাড়ি বন্ধ থাকায় কোনো উপার্জন নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মহাখালী টার্মিনালে থাকি অন্য শ্রমিকদের সাথে গল্প করে সময় কাটাই। গত দুই মাসের বাসা ভাড়া জমে আছে তা পরিশোধ করতে পারিনি। হাতে জমানো যে টাকা ছিল তা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ভাবছি সুযোগ পেলেই পরিবারের অন্য সদস্যদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো'।
গাবতলী বাস টার্মিনালের ওয়েলকাম পরিবহনের ড্রাইভার মো. সজিব টিবিএসকে বলেন, 'আমরা করোনা দেখে ভয় পাই না, লকডাউন দেখে ভয় পাই। গাড়ির চাকা ঘুরলে আমাদের ইনকাম হয়। এই লকডাউনে ইনকাম নাই, তাই আমাদের অনাহারে আর অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে। আমাদের খাবার দেয়া হোক, না হয় গাড়ি চালু করা হোক'।
গোল্ডেন লাইন পরিবহনের হেলপার আলামিন হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'সকাল থেকে না খেয়ে রয়েছি। কাজ নেই বেকার হয়ে বসে আছি। আমাদের কষ্টের কথা সরকারের কানে পৌঁছায় না। পৌঁছালে আমরা সবার আগে সহযোগিতা পেতাম'।
সাউদিয়া পরিবহনের হেলপার মাসুদ টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দিকে সরকার যেন নজর দেন। তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে। গত সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে পরিবারকে পাঠিয়েছি। মাসে ৫০০ টাকা সুদ দিতে হবে'।
গাবতলী বাস টার্মিনালের ভেতরে সাবা ফাস্ট ফুড হোটেলের সামনে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ অসহায় মানুষকে ফ্রি খাওয়ানো হয়। সেখানে খাচ্ছিলেন সূর্যমূখী পরিবহনের হেলপার মো. রবিন।
রবিন টিবিএসকে বলেন, 'এখানে খাবার না পেলে না খেয়ে থাকতে হতো। দুপুর ও রাতে এখানে খাবার খাই'। রবিনের মতো এমন আরও কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক এখানে খেয়ে কোনোমতে দিন যাপন করছেন।
ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক মো. মানিক মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'এবারে আচমকা লকডাউন পরে যাওয়ায় আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ২/৩ দিন পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান ও ত্রান দেওয়ার বিষয়ে। এছাড়া কম মূল্যে চাল, ডাল, চিনি আমাদের শ্রমিকদের কাছে বিক্রি করার জন্য সরকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে'।
তিনি আরও বলেন, 'মহাখালী বাস টার্মিনালেই বাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার ও হেলপার মিলে প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক রয়েছে। তাদের গত বছর লকডাউনে সহযোগিতা করা হয়েছিল, এবারও করা হবে। আমরা এখনও সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রণোদনার আশ্বাস পাইনি। নিজেরা যে কিছু করবো সেটাও বড় কোনো সহায়তা ছাড়া সম্ভব না'।
পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী টিবিএসকে বলেন, 'বিভিন্ন দেশে আগে খাবার দেয়, এরপরে লকডাউন। কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের কিছু্ই দেওয়া হয়নি। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, মালিক সমিতির সাথে সমন্বয় করে ঈদের আগে চাল, ডাল, চিনি, সেমাই, তেলসহ কয়েকটি প্রয়োজনীয় পণ্য শ্রমিকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করছি'।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বারবার সরকারকে বলেছি, আমাদের ভিক্ষার দরকার নেই। আমাদের ১০ টাকা কেজি মূল্যের চাল দেওয়া হোক। শ্রমিকরা টার্মিনালের সামনে গিয়ে ট্রাক থেকে কিনে নিবে, কিন্তু সেটাও দিচ্ছে না। এ করোনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিকরা'।
সারা দেশে প্রায় ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক রয়েছে উল্লেখ করে এ শ্রমিক নেতা বলেন, এখন প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক বেকার। মাত্র ১০ থেকে ১২ লাখ শ্রমিক পণ্যবাহী গাড়ি চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্যাহ টিবিএসকে বলেন, 'আমার এনা পরিবহনের শ্রমিকদের জন্য আজকে আমি ২৫ লাখ টাকার চেক দিয়েছি। প্রত্যেক গাড়ি বাবদ ১০ হাজার করে দেওয়া হবে। এছাড়া আমরা সমিতি থেকেও শ্রমিকদের জন্য ত্রাণ ও আর্থিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছি। খুব দ্রুতই তাদের সহযোগিতা করা হবে'।
তিনি আরও বলেন, 'আসলে আমরা মালিকরাও তো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। করোনা সবাইকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এরপরেও আমরা গত লকডাউনে শ্রমিকদের পাশে ছিলাম, এবারেও থাকবো'।