অপরিকল্পিত খাল খননের পরিণাম: নোয়াখালীতে বসতভিটা হারা ৩ হাজার পরিবার
৭০ বছরের সুফিয়া খাতুন বহু বছর আগ থেকে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ধানশালিক ইউনিয়নের চরমন্ডলিয়া গ্রামে বাস করছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। ছেলেদের আয় আর নিজের জমিতে চাষাবাদ করে কয়েক বছরের সঞ্চয়কৃত টাকা দিয়ে প্রায় দেড় বছর আগে আলগী খালের দক্ষিণ পাশে এক একর জমির ওপর একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেন। নতুন ঘরে সন্তানদের নিয়ে ভালোই কেটেছে ২-৩ মাস। এপর ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়া আলগী খালটি খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই খাল কাটায় যেন কুমির ঢুকে পড়ে সুফিয়ার নতুন ঘরে!
পাশ্ববর্তী নদী থেকে জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করে খালে। কয়েকদিনের মাথায় জোয়ার আর ভাটার টানে খালে ভেঙে পড়ে যায় সুফিয়ার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে তৈরি করা স্বপ্নের ঘর।
শুধু সুফিয়া খাতুন নয়, আলগী খালের ভাঙনের কবলে পড়ে গত দেড় বছরে বসতভিটা হারিয়েছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। অন্যের জায়গায় ঝুপড়ি ঘর করে এখন কোনোভাবে দিন পার করছেন তারা। ভাঙনের কবলে পড়ে দুই থেকে তিনবার স্থান পরিবর্তন করে ঘর নির্মাণ করেছেন অনেকেই। এরই মধ্যে আবারও ভাঙতে ভাঙতে খাল চলে এসেছে অনেকের বসতভিটার কাছে। প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে খালের ওপর থাকা ছোট-বড় অন্তত ৭টি ব্রিজ ও কালভার্ট। পানিতে মিশে গেছে দোকান-পাট, ফসলী জমি, মাছের ঘের, নার্সারি ইত্যাদি। চলতি বর্ষা মৌসুমে চরমন্ডলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বসতভিটা হারানোর শংকায় রয়েছে আরও অন্তত এক হাজার পরিবার।
নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ধানশালিক ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে 'চর আলগী খালটি' অপরিকল্পিতভাবে খননের অভিযোগ ওঠেছে। পাশ্ববর্তী নদীর জোয়ারের পানি প্রবেশ করে খালটি বর্তমানে প্রায় নদীতে পরিণত হয়ে গেছে। আর তাতেই শুরু হয়েছে দু'পাশে ভাঙন। ভাটার সময় খালে ভেঙে পড়ে খালের দু'পাশে থাকা বাড়ি-ঘর ও জমি। তবে বর্তমান অবস্থার জন্য উল্টো ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের দায়ী করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দায় মেনে নিতে যদিও রাজি নন স্থানীয় চেয়ারম্যান।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, খালে স্লুইজ গেইটের কাজ সম্পন্ন না করে গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩০ ফুটের আলগী খালটি ৯০ ফুট কাটে পানি উন্নয়ন বোর্ড। স্লুইজ না থাকায় গত এক বছরে পাশ্ববর্তী মেঘনা ও বামনী নদীর জোয়ারের পানি এ খালে প্রবেশ করতে শুরু করে। নিয়মিত জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় বর্তমানে ৯০ ফুটের খালটির প্রস্থ হয়ে গেছে ৩০০ ফুট। এখন আলগী খালটি অনেকটাই নদীতে পরিণত হয়ে গেছে। প্রায় ৯ কিলোমিটার এ খাল এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয়দের জন্য। ব্রিজ না থাকায় নারী, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় খাল পার হচ্ছেন। নৌকা পার হতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ঘটছে দূর্ঘটনা। ৯ কিলোমিটার খালটির ছয়টি স্থানে ছয়টি নৌকায় প্রতিদিন গড়ে কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলার প্রায় ৩ হাজার লোক খাল পাড়ি দিচ্ছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ধানশালিক ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড চরমন্ডলিয়া গ্রামের এই স্থানটিতে একসময় ফসলি জমি ছিল। পরে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের জন্য চিকন একটি নালা কাটা হয়। এরপর ২০০৬ সালে প্রথমে সরকারিভাবে কিছুটা প্রশস্ত করে একটি খাল কাটা হয়। ২০০৯ সালের দিকে খালের আয়তন বাড়ানো হয় প্রায় ৩০ ফুট। এরপর ২০২০ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩০ ফুটের খালটি ৯০ ফুট প্রস্থ ও প্রায় ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে কাটে। খালের আয়তন বাড়ার পর দুই পাশে থাকা মেঘনা ও বামনী নদী থেকে জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করলে ভাঙন শুরু হয়। গত দেড় বছরে খালে বিলীন হয়েছে প্রায় ৯০০ একর কৃষি জমি, সুপারি, আম বাগান, সবজি ক্ষেত ও মাছের খামার।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, এ অঞ্চলের মানুষের সুবিধার্থে খালটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ও সেচ কাজে এর ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখন উল্টো স্থানীয়দের জন্য খাল কেটে কুমির আনার দশা হয়েছে। আম, জাম, নারিকেল, সুপারি ও সবজি ছাড়াও ৯শ একর জমিতে ধান চাষ করতো স্থানীয়রা। মৌসুমে প্রতি একর জমিতে ধান উৎপাদন হতো প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ মণ। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৪০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে ৯শ একর জমিতে প্রতি বছর উৎপাদন হতো প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার ধান। এ অঞ্চলের উৎপাদিত ধান পাশ্ববর্তী কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় বিক্রি করা হতো।
কিন্তু গত দেড় বছরে দু'টি ধানের মৌসুম গেলেও জমি না থাকায় ধান উৎপাদন করতে পারেননি এ অঞ্চলের চাষীরা। নিজেদের শেষ সম্বল ফসলি জমিটুকু হারিয়ে অনেকেরই দিন কাটছে অভাব অনটনে। অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে কোনমতে কাটাচ্ছে জীবন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের যোগসাজশে এ অপরিকল্পিত খাল খনন এবং পানি আটকানোর বাঁধটি কেটে দেওয়ার কারণে তারা আজ তাদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। আলগী খালের ভাঙন রোধ করে বসতভিটা ও ফসলি জমি রক্ষার পাশাপাশি বিগত দেড় বছরে যারা ভাঙনের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের তালিকা করে ক্ষতিপূরণের দাবিও জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।
সুফিয়া খাতুন জানান, নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে খাল থেকে ২শ ফুট দূরত্বে তৈরি করা আধাপাকা ঘরটি ভাঙার পর তার থেকে একটু দূরে আবারও নির্মাণ করেন আরও একটি দোচালা টিনের ঘর। নির্মাণের দুই মাসের মাথায় সেই ঘরটিও বিলীন হয়ে যায় একই খালে। বর্তমানে পরিবারের ১২ জন সদস্য নিয়ে খালের উত্তর পাশে একটি ঝুপড়ি ঘর করে কোনমতে বসবাস করছেন তিনি।
তিনি বলেন, "একসময় আমাদের সবাই ছিলো। আমাদের জায়গা জমি সব এ খালে চলে গেছে। এ খাল আমাদের ফকিরের চেয়েও ফকির করে দিয়েছে। ফকিররাতো দিনে এনে দিনে খেতে পারছে, কিন্তু আমরা তাও পারছি না"। এ পর্যন্ত চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছ থেকেও কোন সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। এখন নিজেদের ভাগ্য আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন সত্তরোর্ধ্ব এ বৃদ্ধা।
স্থানীয় সাহাব উদ্দিন জানান, ২০২০ সালের জুন মাসে কৃষি বিপণন বিভাগ কবিরহাট থেকে ৫০টি উন্নতমানের আম গাছের চারা দেওয়া হয় তাকে। ওই চারাগুলোকে বড় করার জন্য ২০ হাজার টাকা ব্যয় করে একটি নার্সারি তৈরি করে চারাগুলো সেখানে সংরক্ষণ করেন তিনি। কিন্তু মাস না যেতেই এক রাতে ভাটার টানে সবগুলো চারাসহ খালে চলে যায় তার নার্সারিটি। একই অবস্থায় হয়েছিল স্থানীয় ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার মহিন উদ্দিনের। তিনিও কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে ৫০টি আমের চারা পেয়েছিলেন। তাও বিলীন হয়েছে চর আলগী খালে।
মো. লিটন নামের এক পোল্ট্রি ব্যবসায়ী জানান, গত ৩০জুন বার্ধক্যজনিত কারণে নিজ বাড়িতে মারা যান তার বাবা। বাড়ির পাশে তাদের কোন জমি নেই। খালের উল্টো পাশে জমি থাকলেও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে অন্যের জমিতে কবর দিতে হয়েছিল তার বাবাকে। বাবার লাশ নৌকা যোগে ওই পাড়ে নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় নিজেদের জায়গায় উনাকে কবর দিতে পারেননি।
আব্দুল হালিম নামের একজন বলেন, "যদিও আমরা সবাই চরমন্ডলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু বর্তমানে খালটি মাঝখানে পড়ে যাওয়ায় আমরা উত্তর ও দক্ষিণ অংশে আলাদা হয়ে গেছি। আমরা উত্তর পাশের প্রায় তিন হাজার লোক মূল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন। দক্ষিণ পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও মাদ্রাসা থাকলেও উত্তর পাশ থেকে আমাদের ছেলে মেয়েদের নৌকাযোগে ঝুঁকি নিয়ে সেখানে পাঠানো সম্ভব হয় না। নামাজ পড়ার জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত ২০ টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে খাল পার হয়ে মসজিদে যেতে হয়। এছাড়াও দোকান পাট সব দক্ষিণ পাড়ে হওয়ায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একাধিকবার খাল পার হতে হয় আমাদের"।
খালের মধ্যে বাড়ির বেশিরভাগ অংশ ভেঙে পড়া আব্দুল হালিম বলেন, "কয়েক মাস আগে একবার ভাঙনের কবলে পড়ে উত্তর পাড়ে এসে নতুন করে আমরা বাড়ি করেছিলাম। বর্তমানে এ বাড়িটিরও দুই-তৃতীয়াংশ খালে পড়ে গেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের বসত ঘরটি পুরোই ভেঙে যাবে। এরপর আমরা কোথায় যাবো সেটা একমাত্র আল্লাহ জানেন"।
মধ্য চরমন্ডলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো. তানভীর নেওয়াজ জানান, বিদ্যালয় থেকে মাত্র ২০ ফুট দূরে খালটির অবস্থান। ইতোমধ্যে বিদ্যালয়ের মাঠের কিছু অংশ খালে ভেঙে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভাঙন ঝুঁকিতে থাকবে বিদ্যালয়টি।
নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে ধানশালিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াকুব নবী জানান, "খালে পানি জমাট বাঁধায় স্থানীয়রা নিজেরাই বাঁধটি কেটে দিয়েছিল। অভিযুক্তদের ছবিসহ তাদের তথ্য সরকারি দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে"। খালের ভাঙনের বিষয়ে সেতুমন্ত্রী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানে সম্মিলিতভাবে কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন জানান, গত বর্ষায় কিছুটা পানি জমাট বাঁধায় চেয়ারম্যান ও স্থানীয় লোকজন পানি আটকানোর বাঁধটি কেটে দিয়েছিল। যার ফলে বর্তমানে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা তাদেরই সৃষ্টি। তবে আগামী বছর বামনী নদীর রেগুলেটর এলাকায় ক্লোজার নির্মাণ করা হবে। ক্লোজার গেইট নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলে এ সমস্যা আর থাকবে না। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ কর্মকর্তা।