উপমহাদেশের প্রথম দুর্গোৎসব হয়েছিল রাজশাহীতে!
প্রায় ৫০০ বছর আগে দুর্গোৎসবের প্রথম প্রচলন করেছিলেন রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায়। তারপর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্গোৎসবের সূচনা হয়।
ত্রেতাযুগে স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। আর কলিযুগে রাজা কংস নারায়ণ আধুনিক পদ্ধতিতে উৎসবের ঘনঘটায় এই পূজার আয়োজন করেন। মহাযজ্ঞের মাত্রা ছাড়িয়ে তা আজ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।
তবে দুর্গোৎসবের সূচনা করলেও সেই পুণ্যভূমি এখনো অনেকটাই অবহেলায় রয়েছে। দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পায়নি জাতীয় স্বীকৃতি। অবশ্য তাহেরপুরের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ বছরও সেখানে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছেন।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, রাজা কংস নারায়ণের মন্দির বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে (৮৮৭ বঙ্গাব্দ) এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, অসুরের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির লক্ষে এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং এর পর থেকে এ উপমহাদেশে সর্বজনীন শারদীয় দুর্গাৎসবের শুরু।
তাহিরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে জায়গাটি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার একটি পৌরসভা। তবে কালক্রমে 'তাহিরপুর' নামটি তাহেরপুর বলে উচ্চারিত হচ্ছে। এই রাজবংশের আদিপুরুষ ছিলেন মৌনভট্ট। আর বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামন্ত রাজা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত কংস নারায়ণ রায়। তিনি সুলতানি আমলে চট্টগ্রামে মগ দমনে বীরের ভূমিকা পালন করেন। পাঠান আমলে কিছুদিন ফৌজদারের দায়িত্বও পালন করেন। মোগল আমলে এসে কিছুকাল বাংলা-বিহারের অস্থায়ী দেওয়ান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি 'রাজা' উপাধি পান।
বাংলা মোগলদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলে সম্রাট আকবর রাজা কংস নারায়ণকে সুবেবাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। কিন্তু যথেষ্ট বয়স হওয়ায় তিনি দেওয়ানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তাহেরপুরে ফিরে ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
সমসাময়িক বাংলার হিন্দু সমাজে তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকার মানসে এক মহাযজ্ঞ সাধন করতে আগ্রহী হন। এই লক্ষ্যে তার পরগণার সব শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে দরবারে আহ্বান করে তাদের মত জানতে চান।
তার মনোবাসনার কথা শুনে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী বললেন, 'বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ— এই চারটি মহাযজ্ঞ নামে কথিত। প্রথম দুটি কেবল সার্বভৌম সম্রাটেরা করতে পারেন, আর পরের দুটি কলিতে নিষিদ্ধ। তোমার পক্ষে দুর্গোৎসব ভিন্ন অন্য কোনো মহাযজ্ঞ উপযুক্ত নাই। এই যজ্ঞ সকল যুগে সকল জাতীয় লোকেই করতে পারে এবং এক যজ্ঞেই সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়।' সমাগত সব পণ্ডিত রমেশ শান্ত্রীর এই মতে সমর্থন দিয়েছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজা কংস নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন করেন। উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। আজও বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সেই পদ্ধতিই অনুসৃত হচ্ছে।
তবে কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মী নারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান।
পরে অবশ্য লক্ষ্মী নারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানী জয় সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের নামফলকটি বর্তমানে রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিবশেখরেশ্বর। তার বাবা শশী শেখরেশ্বরের সময় থেকে রাজারা কলকাতায় গিয়ে থাকতেন। শুধু পূজার সময় আসতেন। ১৯২৭ সালে শেষবারের মতো তিনি তাহেরপুরে এসেছিলেন। এরপর তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়।
একপর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দির প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িতে কলেজ করা হয়। রাজবাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরে যাওয়ার ফটকটিও এক সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে।
শ্রী শ্রী দুর্গামাতার মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিরঞ্জীব রায় জানান, দেশভাগের পর ১৯৬২ সাল থেকে মন্দিরে দুর্গাপূজা বন্ধ হয়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়ীতে কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কলেজের ভেতর নেওয়া হয় দুর্গামন্দিরকে। মাঝখানে প্রায় ৬০ বছর মন্দিরে দুর্গাপূজা বন্ধ থাকার পর ২০১২ সাল থেকে মন্দির সংস্কার করে আবার সেখানে দুর্গাপুজার উৎসব শুরু হয়।
'২০১৮ সালে মন্দিরে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অষ্টধাতুর প্রতিমা দেন স্থানীয় সাংসদ এনামুল হক। কিন্তু উপমহাদেশে এ মন্দিরের মাধ্যমে দুর্গোৎসবের প্রচলন শুরু হলেও এখনো এর জাতীয় স্বীকৃতি পায়নি। অনেকটাই অবহেলা অনাদরে রয়েছে মন্দিরটি। আমরা চেষ্টা করছি জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য,' বলেন চিরঞ্জীব রায়।
তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'মন্দিরটির জাতীয় স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা চলছে। স্থানীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে আমরা বসে এ নিয়ে আলোচনা করেছি। এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে, যেন মন্দিরটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়।'
শনিবার সকালে তাহেরপুর পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর পূজামণ্ডপে খুব বেশি ভিড় নেই। পুরোহিত গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটু পর তিনি মহাঅষ্টমীর পূজা শুরু করেন। ঢাক-ঢোলের বাদ্যি ও ধুপধুনোর গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যায় চারদিক। মাঝে মধ্যে ভক্তকুলরা এসে জানাচ্ছেন পূজা ও অর্চনা।
গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, 'অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর পূজামণ্ডপে লোক সমাগম কম হচ্ছে। দূর দেশের ভক্তকুলরা আসতে পারেননি। তবে করোনাভাইরাস মহামারি থেকে মানবকুল রক্ষা পাক, এটাই আমাদের প্রার্থনা।'