ঋণ করে ক্রেস্ট ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার চেষ্টা
ঋণ করে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ঢাকার ক্রেস্ট ব্যবসায়ীরা। গত বছরের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে বিধি-নিষেধ জারি করা হয়। এর কয়েক মাস পরে অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও সবকিছু এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় খেলাধুলার আয়োজন নেই। আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে এখনো বিধি-নিষেধ কাটেনি। কর্পোরেট অনুষ্ঠানাদিও এখন তেমন নেই। ফলে দুঃসময় কাটছে না ব্যবসায়ীদের।
ঢাকার কাঁটাবন, ক্রেস্ট বিক্রির অন্যতম বাজার। এখানে পাইকারি এবং খুচরা দুই ভাবেই ক্রেস্টের বিকিকিনি চলে। এ ছাড়া মহাখালি, বায়তুল মোকাররম ও গুলিস্তানে আলাদা মার্কেট গড়ে উঠেছে।
জানা গেছে, শুধু রাজধানীতেই ক্রেস্ট তৈরি করে এমন প্রতিষ্ঠান আছে হাজার খানেক। বিভাগীয় এবং জেলা, উপজেলা শহরগুলোতেও আছে ক্রেস্টের ব্যবসা।
কাঁটাবনের নিশান অ্যাড এর কর্ণধার কে এম মনিরুজ্জামান তিন দশক ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে আমার প্রতিমাসে ব্যবসা ছিল সাড়ে তিন লাখের মতো। যাতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা লাভ হতো। এখন মাসে বিশ হাজার টাকাও লাভ করতে পারছি না। দোকান ভাড়া-কর্মীর বেতন মেটাতে গিয়ে গত এক বছরে প্রায় পনের লাখ টাকার মত ঋণ করেছি'।
তিনি বলেন, 'আমার দোকানে কর্মী ছিল ১৬ জন। তাদের ব্যয় বহন করতে না পেরে ১১ জনকে ছাঁটাই করেছি। পাঁচজন দিয়ে এখন দোকান চালাচ্ছি। আশা করছি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুললে ব্যবসাটা কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তবে পুরোপুরি ব্যবসায় ফিরতে আরো সময় লাগবে'।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রেস্ট ব্যবসার পিক টাইম অক্টোবর-মার্চ মাস। এই খাতে কম করে হলেও ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আর বছরে বাজার আছে ৪০০ কোটি টাকার। গত দুই দশকে এই খাতের দুই-তিন গুণ সম্প্রসারণ হয়েছে।
সরেজমিনে ঢাকার বেশ কয়েকটি ক্রেস্ট বিক্রির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানেই ক্রেতা নেই। মাঝেমধ্যে দু-একজন ক্রেতা এলেও দিনের অধিকাংশ সময় অলস পার করছেন মালিক-কর্মচারীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলাধুলা, করপোরেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রধান ক্রেতা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হলেও অনুষ্ঠান হচ্ছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ছোট পরিসরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এর জন্য কেউ কেউ অল্প পরিসরে ক্রেস্ট নিচ্ছেন।
বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করেছেন অনেক মালিক
করোনায় টানা তিন মাস দোকান বন্ধের পর গত জুনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলে মালিকরা। কিন্তু এই সময়ে দোকান ভাড়া বাবদ মাসে যে টাকা দিতে হয় সেটিই তুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে তাই অনেক ব্যবসায়ী কর্মী ছাঁটাই করেছেন।
ক্রেস্ট ব্যবসায়ীরাদের কেন্দ্রীয় কোনো সংগঠন নেই। তবে ক্রেস্টের প্রধান বাজারগুলো ঘুরে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে এই খাতের পাঁচ হাজারের অধিক কর্মজীবী চাকুরি হারিয়েছেন।
বায়তুল মোকাররমের স্মৃতি এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আবুল হাসেম টিবিএসকে বলেন, 'কার্জ-কর্ম আগের তুলনায় ৭০ শতাংশই নাই। আমাদের দোকানে কর্মী ছিল ৮ জন। তারমধ্যে এখন আছে দুই জন। বাকিদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি'।
সংকটে পড়ে ক্রেস্টের ব্যবসা ছেড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী
করোনা সংকটে পড়ে ক্রেস্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। ঢাকার কাঁটাবন মার্কেটে দোকান আছে ১৮০টি। তার মধ্যে ১৫ ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আরো অনেকেই হাটছেন একই পথে। অন্য ব্যবসা শুরু করেছেন কেউ কেউ। ঢাকার অন্যান্য মার্কেটগুলোর চিত্রও কাছাকাছি।
মহাখালির ব্যবসায়ী মান্না দে। দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে তিনি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। করোনার সংকটে টিকে থাকতে না পেরে মাস চারেক আগে নোয়খালিতে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়েছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আট মাসের দোকান ভাড়া বাকি ছিল। জমি বিক্রি করে দোকান ভাড়া দিয়ে, গ্রামে চলে এসেছি। আমার দোকানে কর্মী ছিল ৭ জন। তাদের কিছু টাকা-পয়সা দিয়েছি। বলেছি আপাতত নিজের মত করে কিছু করতে। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, ব্যবসাটা ধরে রাখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি'।
রাজনীতির প্রভাবও পড়েছে ক্রেস্ট ব্যাবসায়ীদের ওপর
রাজধানীর গুলিস্থানের নান্দনিক অ্যাওয়ার্ডের কর্ণধার মো. আসাদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'আগে নানান রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন ধরনের ক্রেস্ট বানানোর অর্ডার নিয়ে আসতেন। যদি গত পনের বছর আগের কথা ধরি, ওই সময়ের তুলনায় অর্ডার এখন অনেক কম'।
কাঁটাবনের অ্যাওয়ার্ড এন্ড গিফট আইটেম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কাওসার হোসেন টিটু টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সমিতির পক্ষ থেকে আন্দোলন করে তিন মাসের দোকান ভাড়া মওকুফ করিয়েছি। দোকান মালিকরাও টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। অনেকে ব্যবসায়ী ঋণ করেও টিকতে না পারায় বাধ্য হয়ে ব্যবসা ছেড়েছে। খুবই বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে আমাদের'।