ঋত্বিক ঘটক : রহস্যঘেরা উল্কার জীবন
“মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।/এইভাবে, পৃথিবীর ইতিহাস বারবার/বদলে গেছে,/তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে।/মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।”
‘আমাদের ফেলো না’ কবিতায় এমনি করেই ঋত্বিক ঘটক বলেছেন জীবনবোধের কথা। বুকের মধ্যে মানুষের প্রতি ভালোবাসার কষ্ট আর দায়িত্ব নিয়ে আজীবন ধুঁকেছেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে উল্কার মতো এসে প্রলয় ঘটিয়ে গেছেন তিনি। ৫০ বছরের জীবনে সিনেমা বানিয়েছেন ৮ টি। কিন্তু এই সংখ্যাটা দিয়ে তার শিল্পী জীবনকে যাচাই করতে গেলে ভুল হবে।
তিনি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার চলচ্চিত্রকে। তাকে বলতে শুনি আমরা- ‘ছবি লোকে দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন খোলা থাকবে, ততদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাব। প্রতিবাদ করা শিল্পীর প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। শিল্প ফাজলামি নয়। যারা প্রতিবাদ করছে না তারা অন্যায় করছে। শিল্প দায়িত্ব। আমার অধিকার নেই সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার। শিল্পী সমাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সে সমাজের দাস। এই দাসত্ব স্বীকার করে তবে সে ছবি করবে।’
তাহলে চলুন তার জীবনের কয়েকটি বিষয় জেনে নেই, ঘুরে আসি তার রহস্যে ঘেরা উল্কার মতো বেগবান জীবন থেকে।
১। ঋত্বিকের সৃজনশীলতার শুরু কবি এবং গল্পলেখক হিসেবে। এরপর তিনি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন আর তারপর চলে যান গণনাট্যের দিকে। কিন্তু এখানে এসেও থিতু হননি তিনি। চলে গেছেন সেলুলয়েডের হাতছানিতে চলচ্চিত্রের দিকে। তার যুক্তি ছিল ‘একসঙ্গে লক্ষ মানুষের কাছে নিজের কথা এখুনি বলতে চলচ্চিত্রই একমাত্র মাধ্যম’। ঋত্বিকের ভাষ্যমতে তিনি সিনেমার প্রেমে পড়েননি কোনোদিন, তার বলার কথাগুলো কত কম সময়ে কত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, সেই মাধ্যমটাই খুঁজে গেছেন। সিনেমার চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম খুঁজে পেলে সিনেমাকে ‘লাথি মেরে’ চলে যেতেও পিছপা হতেন না তিনি।
২। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঋত্বিকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের চিত্রনাট্য,পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত ছবিতে নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। মূল চরিত্র একজন মাতাল বুদ্ধিজীবী নীলকণ্ঠ বাগচী,যে তার বন্ধুদের মত সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক স্বয়ং। সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক হলেও এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগ,রাজনৈতিক পরিস্থিতি,১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সময়ের একটি নির্মোহ-নির্মম সমালোচনাও বটে। সুশীল লেখক সত্যজিৎ বসু যখন তাকে বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনার কথা,নীলকণ্ঠ বাগচীর কণ্ঠে তখন চরম উপহাস,”ভাবো,ভাবো,ভাবা প্র্যাক্টিস করো।”
৩। ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশের ছেলে। একটি সমাজসচেতন ও সংস্কৃতিমনা পরিবারের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে হৃষিকেশ দাশ লেনের এক বাসায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হলেও কবিতা ও নাটক লিখতেন। মা ইন্দুবালা দেবী। বাবা-মায়ের এগারোতম এবং কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তারা চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।
১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ কোর্স শেষ করে পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তার বড় ভাই ওই সময়ের খ্যাতিমান এবং ভিন্ন ধারার লেখক মনীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী। আইপিটিএ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনে মনীশ ঘটক সম্পৃক্ত ছিলেন। মনীশ ঘটকের কন্যা মহাশ্বেতা দেবী সমাজচিন্তক। যিনি পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিলেন।
৪। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মর্মবেদনা নিয়ে শরণার্থী হয়ে কলকাতায় চলে যাওয়া— এসব ঘটনা প্রবাহ ঋত্বিকের জীবন দর্শন নির্মাণে প্রভাবিত করে। সমাজের বিদ্যমান এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে তৈরি হয় তার বিদ্রোহী মন। পরবর্তীকালে তার শিল্প সৃষ্টিতেও প্রভাব ফেলে এই অনুভূতিগুলো।
৫। দেশ ভাগের বিষয়টা কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি তিনি। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে তিনি একসময় চিৎকার করে বলেছিলেন, “মাতামাতি! বাংলাকে ভেঙে চুরমার করে দিল, আর মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব? এটা বদমাইসি! চাই, খুব বেশি করে চাই দুই বাংলার সংস্কৃতিকে এক ফ্রেমে আঁটতে। প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝল না কেউ।”