এক দশকেও উদ্ধার হয়নি জাতীয় জাদুঘরের ছয়টি নিদর্শন!
জাতীয় জাদুঘর থেকে এক দশক আগে খোয়া যাওয়া মূল্যবান ৬টি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। এ নিয়ে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, সেটিও আর চালু নেই।
২০১০ সালের মার্চ মাসে ইতিহাস ও ধ্রুপদী বিভাগের ২১ নম্বর গ্যালারি থেকে খোয়া যায় ২৬টি নিদর্শন (২টি স্বর্ণ ও ২৪টি ব্রোঞ্জের মুদ্রা)। পরের বছর ২০টি নিদর্শন পাওয়া গেলেও বাকি ছয়টি এখনো নিখোঁজই আছে।
এই ঘটনায় ওই সময় রাজধানীর শাহবাগ থানায় জাতীয় জাদুঘরের তৎকালীন সচিব আলম আরা বেগম একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল জাদুঘরের উপ-কিপার নূরে নাসরিন, সহকারি কিপার সাইফুজ্জামান ও আরো তিন কর্মচারিকে। তবে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় পরে সবাইকে চাকরিতে পুন:বহাল করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'খোয়া যাওয়া ছয়টি নিদর্শন আমরা এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। এ নিয়ে যে মামলা হয়েছিল, তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন একটি লাইন উল্লেখ আছে, যদি নিদর্শনগুলো কখনো খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে মামলাটি আবার চালু হবে।'
জাতীয় জাদুঘর ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনের এক বিশাল সংগ্রহশালা। এতে এক লাখেরও বেশি প্রত্মসম্পদ আছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই সেখান থেকে প্রত্মসম্পদ চুরি হয়। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এমন চুরির ঘটনা ঘটেছে ২০টি।
২০১০ সালের এমন একটি ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে ২৬টি নিদর্শন খোয়া যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। নকল নিদর্শন বানিয়ে চুরিরি বিষয়টি তখন ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফী মোস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চুরির ঘটনাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হলে সরকারের উপর এক ধরনের চাপ থাকত, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। চুরির ঘটনায় কারো বিচার হয় না। চুরিও বন্ধ হয় না।'
তিনি বলেন, 'সরকারি কর্মকর্তাদের জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরা তিন বছর এখানে থেকে অন্যত্র চলে যান। এরা কি প্রত্মতত্ত্বের গুরুত্ব বোঝার মতো লোক! প্রত্নতত্ত্বের মর্ম বোঝেন, জাদুঘরের পরিচালক করার মতো এমন লোক কি বাংলাদেশে নেই?'
অতীতের যত চুরি
পুরান ঢাকার নিমতলীতে জাতীয় জাদুঘরের ভবন থাকার সময় ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালের মধ্যে জাতীয় জাদুঘর থেকে ১৪৪টি প্রাচীন নিদর্শন, মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য মূর্তি চুরি হয়। খোয়া যায় বেশ কিছু ঐতিহাসিক খাবারপাত্রও। এগুলো আর উদ্ধার করা যায়নি।
১৯৮২ সালে জাদুঘর থেকে মধ্যযুগের ১২টি দুর্লভ স্বর্ণালঙ্কার চুরি হয়। জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর একটি বাসে নিদর্শনগুলো রাখা ছিল। এ ব্যাপারে মামলা হলেও স্বর্ণালঙ্কারগুলো আর উদ্ধার করা যায়নি।
১৯৯১ সালে জাদুঘরের তিনতলায় লোহার গ্রিল কেটে শোকেস ভেঙে চুরি করা হয় দীঘাপাতিয়ার মহারাজার ব্যবহৃত সিংহমূর্তি আকৃতির সিংহাসনের হাতলটি।
২০০৭ সালে ফ্রান্সের গিমে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের পাঁচটি জাদুঘর থেকে ১৪৫টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়। এ জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ফরাসি দূতাবাসের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী একই বছরের ২৫ ডিসেম্বর পুরাকীর্তির প্রথম চালানটি বিমানে ওঠানোর আগে ষষ্ঠ ও সপ্তম দশকের দুটি বিষ্ণুমূর্তি খোয়া যায়।
ওই ঘটনায় বেসামরিক বিমান পরিবহন চলাচল কর্তৃপক্ষের নিম্নপদস্থ ১৩ জন কর্মচারিকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। পরে র্যাব মূর্তি দুটির ভাঙা টুকরো সাভার থেকে উদ্ধার করে। মামলার মীমাংসা আজও হয়নি। বিষ্ণুমূর্তি দুটি বীমা করা ছিল। বীমার টাকাও পরে আর পাওয়া যায়নি।
২০১০ সালের মার্চ মাসে জাদুঘরের চতুর্থ তলায় প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের সংরক্ষণ কক্ষ থেকে বেশ কিছু পুরাকীর্তি চুরি হয়। এসবের মধ্যে ছিল- ১০টি হাতির দাঁত, তিনটি ফিঙ্গে পাখির মমি ও একটি হলদে পাখির মমি। চোরকে ধরা যায়নি, পুরাকীর্তিগুলোও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কথা বলতে চান না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা
বিভিন্ন সময়ে জাদুঘরের চুরি হওয়া ও খোয়া যাওয়া নিদর্শনগুলোর বিষয়ে কথা বলার জন্য জাতীয় জাদুঘরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
অধ্যাপক সুফী মোস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এসব বিষয় নিয়ে কথা বলায় অতীতে আমি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। ভবিষ্যতেও বলে যাবো। মূল কথা হলো, জাদুঘরের মহাপরিচালক পদে যতদিন না যোগ্য লোক বসবেন, ততদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।'
জাতীয় জাদুঘর বর্তমানে ১২৮টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।