কমেছে চায়ের বিক্রি, শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা
গত বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ। চলতি বছর উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও কমেছে চায়ের বিক্রি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক দূরত্বের কথা ভেবে বেশিরভাগ চায়ের দোকান ও হোটেল-মোটেল বন্ধ রয়েছে। ফলে অবিক্রিত চায়ের স্তুপ তৈরি হচ্ছে ওয়্যার হাউসগুলোতে। এ পরিস্থিতিতে বাগানের কার্যক্রম সচল রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চা উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও বিক্রি না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সেগুলো ওয়্যার হাউসে পড়ে রয়েছে। এতে চায়ের গুণগতমাণ নষ্ট হচ্ছে। আবার অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর চায়ের দামও কম। এভাবে চলতে থাকলে চা শ্রমিকদের বেতন দেওয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা পেলে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
চা বোর্ড জানায়, চলতি বছর দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি। গত পাঁচ মাসে (মে পর্যন্ত) উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ ৪৬ হাজার কেজি। গত বছর প্রথম পাঁচ মাসে উৎপাদন ছিল এক কোটি ৬২ লাখ ৮১ হাজার কেজি। চলতি বছর আবহাওয়ার জন্য উৎপাদন কিছুটা কমলেও উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও চা বিক্রি থমকে রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চায়ের টং দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাগুলো দেশের চায়ের প্রধান গ্রাহক। করোনাভাইরাসের কারণে এ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় চা বিক্রি কমেছে।
শ্রীমঙ্গল পদ্মা টি সাপ্লাই স্টোরের পরিচালক কাজল হাজরা বলেন, গত বছরের তুলনার এ বছর চায়ের বিক্রি কয়েকগুণ কমেছে; একই সঙ্গে কমেছে চায়ের দামও। আমার ঘরে যে পরিমাণ চা মজুত আছে তা আর কিছুদিন থাকলে গুণগত মাণ নষ্ট হয়ে যাবে। এতে আমি বিপুল পরিমাণ লোকসানের সম্মুখিন হবো। চা বিক্রি করতে না পারলে তার প্রভাব শ্রমিকদের বেতন ভাতার উপর পড়বে বলে জানিয়েছেন বাগান মালিকরা। তারা জানান, চা বিক্রি করে যে টাকা আসে তা দিয়েই বাগানের সকল খরচ চালানো হয়।
নাহার চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার পিযুষ কান্তি জানান, আমার ওয়্যার হাউজে (চা রাখার স্থান) প্রায় ৩০ হাজার কেজি চা জমে আছে। এগুলো ক্রেতার অভাবে বিক্রি করতে পারছি না। যেটুকু বিক্রি হচ্ছে তা-ও গড়ে ১৫৫ টাকা কেজি দরে।
''এত কম দামে চা বিক্রি করে তো আসল টাকাই তুলতে পারছি না। আবার শ্রমিকদের বেতনও বকেয়া রাখা যায় না। এভাবে চলতে থাকলে কীভাবে শ্রমিকদের বেতন দেব সেই চিন্তায় রয়েছি'', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলি জানান, করোনার কারণে চা বিক্রি তিন গুণের বেশি কমেছে। ভালো কোয়ালিটির চা বিক্রি হলেও সাধারণ মানের চা বিক্রি হচ্ছে কম।
''নিলামে যে চা উঠছে তার প্রায় অর্ধেক অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বেতন ভাতা দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হতে হবে'', বললেন জি এম শিবলি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের বিপন কর্মকর্তা আহসান হাবিব জানান, গত মৌসুমে (এপ্রিল ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২০) চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলের ৪৫টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৯০.৪৪ মিলিয়ন কেজি যার গড় দাম ছিল কেজি প্রতি ১৭৬.০৮ টাকা। আর চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছয়টি এবং শ্রীমঙ্গলে তিনটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ৬.৬৬ মিলিয়ন কেজি। গড় দাম ছিল ১৫৫ টাকা কেজি।
হামিদিয়া চা বাগানের ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বছর আমরা এক লাখ ৮৫ হাজার কেজি চা উৎপাদন করি। চলতি বছর চায়ের উৎপাদন কিছুটা কম থাকলেও এরই মধ্যে আমার ২৫ হাজার কেজি চা ওয়্যার হাউজে জমা হয়েছে।
''চরম সংকটে আছি। শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছি। ব্যাংকও ঋণ দিচ্ছে না। সরকারি প্রণোদনাই পারে এ সমস্যা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে'', যোগ করেন তিনি।
টি প্লান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিপিটিএবি)সদস্য সচিব জহর তরফদার বলেন, এ বছর শ্রীমঙ্গলে ২০টি নিলাম করার পরিকল্পনা ছিল। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নিলামে ১৮ হাজার ৭০০ কেজি চা বিক্রি হয়েছে। নিলামে কমেছে ক্রেতাদের অংশগ্রহন, সঙ্গে চায়ের দামও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ''বেশিরভাগ চা কোম্পানির মালিক বিদেশি। তারা আজ বিক্রি করতে না পারলে ছয় মাস পরে পারবে। কিন্তু করোনার কারণে ডেইরি, খামারিসহ যে সব শিল্প বর্তমানে ধ্বংসের পথে রয়েছে সরকার আগে তাদেরকে দেখবে। গার্মেন্ট খাত আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সেক্টর। সরকার কোনটা আগে দেখবে। ব্যাংক সেক্টরে অনেকের বেতন কমলেও চা বাগানের কারো বেতন কিন্তু এখনও কমেনি। চা বাগান এখনো অনেক ভাল আছে।''
বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান,মন্ত্রণালয় এবং চা বোর্ড বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অবগত আছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৯ সালে চা-শিল্পে ১৬৫ বছরের ইতিহাসের রেকর্ড ভেঙে দেশে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়। সে বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ মিলিয়ন বা আট কোটি কেজি। তবে বছর শেষে উৎপাদন হয় ৯৬ দশমিক ০৭ মিলিয়ন কেজি বা ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি।