করোনাকালে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ টি বাল্যবিয়ে
করোনাকালে সাত মাসে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং এরমধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করেছে মোট ৫ হাজার ৮৯ জন।
বিষয়টি উঠে এসেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর একটি গবেষণায়।
সংস্থাটি থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬ টি বাল্যবিয়ে হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা 'বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্লেষণ: করোনাকাল ২০২০' শীর্ষক এক জরিপ রিপোর্টে এ তথ্যগুলো উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার জরিপের রিপোর্টটি একটি ওয়েবিনারের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। জরিপটিতে সহযোগিতা করেছে ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।
মূলত বয়:সন্ধিকালের মেয়েদের ও তাদের অভিভাবকদের বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত জ্ঞান বাড়ানোর জন্য, করোনাকালীন সময়ে বাল্যবিয়ের কারণগুলো কী ছিল, করোনাকালে বাল্যবিয়ে বন্ধে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কাজ কতটা কার্যকর হয়েছে এবং বাল্যবিয়ে বন্ধে নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ কী হতে পারে, এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই এই জরিপটি চালানো হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।
গবেষণার তথ্যমতে, যেসব মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৫০.৬ জনের বিয়ে হয়েছে ১৬-১৭ বছরের মধ্যে, শতকরা ৪৭.৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১৩-১৫ এর মধ্যে এবং শতকরা ১.৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১০-১২ বছর বয়সে।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হযেছে বরগুনাতে ১,৫১২ টি, ১,২৭২ টি কুড়িগ্রামে, নীলফামারিতে ১,২২২, লক্ষীপুরে ১,০৪১ টি এবং কুষ্টিয়াতে ৮৮৪ টি।
তাদের দেওয়া তথ্যমতে, বাল্যবিয়ের উদ্যোগ যারা নিয়েছেন, এরমধ্যে শতকরা ৭৮ জনই বাবা-মা। অথচ শতকরা ৯৬ ভাগ উত্তরদাতা মনেকরেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়া উচিৎ। বাল্যবিয়ে নিয়ে সচেতনতা ও চর্চার মধ্যে বড়ধরণের একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানানো হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারী সকলেই স্বীকার করেছেনে সরকারি অফিস, স্থানীয় এনজিও, পুলিশ এবং হেল্পলাইনগুলো যথেষ্ট কার্যকর ছিল। অনেকক্ষেত্রে মেয়েরাই নিজে বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে। সাধারণত দারিদ্র, নিরাপত্তার অভাব, স্কুল বন্ধ, কম যৌতুক, পাত্রপক্ষের কাছে চাহিদা ইত্যাদি কারণেই বাল্যবিয়ে দেয়া হয়।
গবেষণার সুপারিশমালায় উঠে এসেছে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি বাড়ানোর কথা, গণমাধ্যমের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় নেতাদেরকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করানো।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ৩৭ শতাংশ বলেছেন করোনাকালে তারা তাদের আশেপাশে অন্তত একটি করে বাল্যবিয়ে বিয়ে দেখেছেন। বরগুনার শতকরা ৮৮ ভাগ মানুষ জানিয়েছেন তারা অন্তত একটি বাল্যবিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন এইসময়ে, লক্ষীপুরে শতকরা ৬৩, খুলনা ও নীলফামারিতে শতকরা ৫৬ জন।
দেশের শতকরা ৩৩ ভাগ জেলায় করা এই জরিপে কথা বলা হয়েছে ১০-১৯ বয়সী অবিবাহিতা মেয়ে, ১৮ বছরের নীচে যাদের বিয়ে হয়েছে, সেইসব বাবা-মা, যাদের ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়ে আছে এবং সবধরণের সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের সাথে।
গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে টেলিফোনে ও মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, এমজেএফের সহযোগী সংগঠনগুলো তথ্য সংগ্রহ করেছে।
জরিপের তথ্য মতে, জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের শতকরা ৭৭.৯ জন ছেলে ও মেয়ে দেশে আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে। বিভিন্ন এলাকার ম্যারেজ রেজিষ্টাররা ৪,৮৬৬ টি বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন এই সময়ে। শতকরা ৩০ ভাগ উত্তরদাতা উল্লেখ করেছেন দারিদ্র এবং প্রতিদিনকার জীবনের টানাপোড়েনের কারণে তারা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
ওয়েবিনারে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জেনারেল সেক্রেটারি মালেকা বানু, স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মারফি, জরিপের উপর মন্তব্য করেন ইউএনএফপিএ এর ডেপুটি রিপ্রেসেন্টিটিভ এইকো নারিতা ও ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেসেন্টিটিভ ভীরা মেনডোনকা।
জরিপের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কোঅর্ডিনেটর অর্পিতা দাশ ও সিনিয়র ম্যানেজার গিয়াসউদ্দীন আহমেদ।
উল্লেখ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের হার। শতকরা ৫৯ জন বাল্যবিয়ের স্বীকার। বাল্যবিয়ের হার বেশি, বিশ্বের এরকম ১০ টা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে। অথচ বাংলাদেশসহ বিশ্ব নেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিলেন।