করোনাভাইরাস: অবজ্ঞার শিকার রেমিট্যান্স যোদ্ধারা
'একদিন করোনাভাইরাস থাকবে না। শুধু মনে থাকবে প্রবাসীদের নিয়ে তোমাদের মন্তব্য, ঘৃণা এবং গালিগালাজের ইতিহাস। যদিও জানি বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ করোনা রোগীর চিকিৎসা হবে প্রবাসীদের রক্ত পানি করা টাকায়। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই হে জন্মভূমি।'
শাহাদাত হোসেন নামে কাতার প্রবাসী এক ব্যক্তির ফেসবুকে এমন একটি স্ট্যাটাস দেন। যদিও লেখাটি তার নিজের নয়। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বেশির ভাগ বাংলাদেশির ফেসবুক থেকে এই স্ট্যাটাসটি শেয়ার করা হচ্ছে। কে লেথাটি প্রথম পোস্ট করেছিলেন তা জানা যায়নি।
প্রবাসীদের নিয়ে আবেগঘন এই পোস্টটি রীতিমতো ভাইরাল। কিন্তু কেন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনটা লিখছেন? নিজের দেশের মানুষের প্রতি কেন তাদের এত অভিযোগ, আক্ষেপ?
গত মার্চে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলকলি বেকারির গেইটে একটি নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে লেখা ছিল 'বিদেশি লোকের প্রবেশ নিষেধ'। এছাড়া একই মাসে সিলেট শহরে ইবনে সিনা নামে একটি বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের দরজায় লেখা ছিল, 'বিদেশ ফেরত কোনো রোগী বা দর্শনার্থী এই হাসপাতালে আসবেন না'।
কথাগুলো দাগ কেটেছে প্রবাসীদের মনে। স্বজনদের দেশে রেখে হাজার কিলেমিটার দূরে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আজ অনেক অসহায়। করোনাভাইরাস ছড়ানোর পেছনে তাদেরকে সরাসরি দায়ী করে নিজ দেশের মানুষের ঘৃণা ও অযাচিত মন্তব্যে আজ তারা সমালোচিত।
কিন্তু তারপরও তারা দেশের মানুষের প্রতি বিরক্ত নন। বিদেশ ফেরতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ছবি পোস্ট করে জাফর আহমেদ নামে এক সৌদি প্রবাসী তার ফেসবুক একাউন্টে লিখেছেন, 'দোয়া করি, করোনাভাইরাস থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক বাংলাদেশ'।
প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে দিন-দিন শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। অর্থবছরের হিসাবে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। ফলে সঙ্গত কারণেই প্রবাসীদের বলা হয়ে থাকে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য প্রবাসীদের দায়ী করে অনেকের অযাচিত মন্তব্য ও আচরণে ব্যাথিত হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। দেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলোর অন্যতম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গত ১ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছয় হাজার ৭৯১ জন প্রবাসী ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এসেছেন। এর মধ্যে বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৫২৩ জন। আর ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিন শেষ করেছেন পাঁচ হাজার ৬৩৮ জন। বাকি ৬৩০ জন প্রবাসী বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাইরে অবস্থান করছেন।
ছুটিতে দেশে আসলে আগে যে মানুষগুলো জামাই আদর দেখিয়ে বুকে টেনে নিতেন, তারাই এখন প্রবাসীদের দূরে সরিয়ে রাখছেন। বিদেশ থেকে কী এনেছেন জিজ্ঞেস না করে প্রবাসীদের দেখে অনেকেই অন্যপথে হাঁটতে শুরু করেছেন। দৃশ্যগুলো প্রবাসীদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ তারা বিদেশ থেকে এসে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থেকেছেন। তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মেলেনি।
কিন্তু নিজ দেশে ফিরে এভাবে অবহেলিত হতে হবে তা তারা কখনোই কল্পনা করেননি। প্রবাস থেকে এসেছেন শুনলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে গুজব ছড়িয়ে সামাজিকভাবেও হেয় করার ঘটনা ঘটছে।
১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামের জাফর আহমেদ। দাম্মামের আল জুবাইল শহরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্টোর কিপার হিসেবে কাজ করেন তিনি। কখনও ভাবেননি নিজ দেশের মানুষের কাছে প্রবাসীরা অপমান-বঞ্ছনার শিকার হবেন। প্রবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন অযাচিত মন্তব্য শুনে তিনি এবার ছুটি পেলেও দেশে আসেননি।
মুঠোফোনে তিনি বলেন, বিভিন্ন উত্সব এলে দেশের মানুষ পরিবার নিয়ে কতো আনন্দ করে। কিন্তু আমরা হাজার কিলোমিটার দূর থেকে চোখের পানি ফেলি। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অমানবিক পরিশ্রম করে দেশের জন্য টাকা পাঠাই। সেই দেশ থেকে এমন আচরণ আমরা প্রত্যাশা করিনা।
মালয়েশিয়া প্রবাসী কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার জয়নাল আবেদীন সরকারের কিছু সক্ষমতার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যে মানুষগুলো ইতালি থেকে বাংলাদেশে ঢুকলো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদেরকে কেন চিহ্নিত করতে পারলো না?
'দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ইতালি ফেরতদের আটকাতে পারল না। কিন্তু তার দায় নিতে হয়েছে লাখ লাখ প্রবাসীকে।' যোগ করেন তিনি।
কাতার প্রবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাতলপার ইউনিয়নের আহম্মদ আলীর ছেলে আবুল কাশেম। গত ৩ মার্চ তিনি দেশে ফেরেন। ১৬ মার্চ কিছুটা অসুস্থবোধ করলে ১৭ মার্চ চিকিৎসক তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। কিন্তু হাসপাতালের পরিবেশ নোংরা হওয়ার ভর্তি না হয়ে তিনি বাড়িতে চলে যান।
এরপর গুজব ছড়ানো হয় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষায় তিনি সুস্থ্য আছেন বলে জানান চিকিৎসকরা। অথচ মানুষের ছড়ানো গুজবের কারণে সামাজিকভাবে তাকে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে।
একই জেলার সদর উপজেলার বাহরাইন প্রবাসী জাকির সরকার বলেন, আমার শারীরিক কোনো অসুস্থ্যতা না থাকার পরও গত ১৬ মার্চ দেশে ফিরে নিয়ম মেনে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। তবুও কেউ আমাদের সঙ্গে আগের মতো মিশছে না। চারপাশের মানুষগুলোর এমন রূঢ় আচরণ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, কারণ আমরা প্রবাসী।
'আমাদের দুঃখ-কষ্ট থাকলেও সেটি প্রকাশ করব না। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করে যাবো।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, এ কথা সত্য, প্রবাসীদের কেউ কেউ দেশে এসে কোয়ারেন্টিন না মানার কারণে পুরো বাংলাদেশ এখন হুমকির মুখে। তবে কোয়ারেন্টিন না মানা প্রবাসীদের সংখ্যা খুবই কম। সেজন্য ঢালাওভাবে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের এখন অপমান করা হচ্ছে। যা একেবারেই অনুচিত। আমাদের অর্থনীতিতে তাদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
'মুক্তিযুদ্ধসহ সকল দুর্যোগেই প্রবাসীরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে তারা আমাদের কাছ থেকে সম্মানপ্রাপ্য। অথচ আমরা তাদের উল্টো অপমান-অবজ্ঞা করছি।'
তিনি বলেন, এই রোগ তো প্রবাসীরা ইচ্ছে করে নিয়ে আসেননি। তাদের কয়েকজনের অসচেতনতাকে দায়ী করা যেতে পারে। তবে সরকারের দায় সবচেয়ে বেশি। সরকারই এই সময়ে প্রবাসীদের দেশে আসতে দিয়েছে। তাদের কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার ফারুক বলেন, বিদেশ ফরত প্রবাসীদের বাড়িতে লাল স্টিকার লাগিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিন শেষে একজন প্রবাসী অন্য সবার মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন। এ সময় যদি কেউ তাদের সঙ্গে অসাদচরণ করেন তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।