করোনার ধকল কাটছে না পাদুকা শিল্পে
১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে একটি পাদুকা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন মাহমুদ আলী নামে এক ব্যবসায়ী। ভারতের পাটনা শহর থেকে আসা এই ব্যবসায়ীর হাত ধরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিস্তৃত হতে থাকে পাদুকা শিল্প।
বর্তমানে জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে দেড়শ পাদুকা তৈরির কারখানা রয়েছে। আর এসব কারখানায় কাজ করছেন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক। কিন্তু সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি করোনাভাইরাসের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহামারিতে পাদুকা শিল্পে প্রায় ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কারণে গত মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে কয়েক মাস কারখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়। এরপর কারখানা খুললেও পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাব ও বাজারে চাহিদা কম থাকায় জুতা উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। এখন পরিস্থিতি আগের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পাদুকা শিল্প।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও লাভের মুখ দেখতে তাদের অপেক্ষা করতে হবে পুরো শীতকালই। কারণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুতার কারখানাগুলোতে শীতকালে মানুষ পরেন এমন জুতা তৈরি হয় না। তাই ব্যবসা আবার ভালো হবে কিনা- সেটি জানতে শীতকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে, বলছেন ব্যবসায়ীরা।
এখন শুধুমাত্র ব্যবসা সচল রাখতেই কারখানাগুলো জুতা তৈরি করে পাইকারদের কাছে বাকিতে সরবরাহ করছে।
করোনার আগে স্থানীয় এই শিল্পকে মোকাবেলা করতে হয়েছে বিদেশি জুতার আগ্রাসন। কয়েক বছর ধরেই চীনা আর ভারতের সস্তা জুতার সঙ্গে প্রতিযোগীতা করে টিকে আছে পাদুকা শিল্প। বেশ কিছু কারখানা বন্ধও হয়েছে। টিকে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি কারখানায় মেশিনে জুতা তৈরি করা হচ্ছে। তুলনামূলক কম দাম এবং গুণগত মান সম্পন্ন হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে জুতা নিয়ে যান এখান থেকে। সর্বনিম্ন ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামের জুতা তৈরি হয় এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে।
মূলত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই এই পাদুকা ব্যবসা। এই দুই ঈদে বড় কারখানাগুলো এক কোটি টাকারও বেশি মূল্যের জুতা বিক্রি করে থাকে। আর ছোট কারখানাগুলোতে গড়ে ২০ লাখ টাকার জুতা বিক্রি হয়।
করোনাভাইরাসের কারণে এবারের ঈদ মৌসুমে ব্যবসা হয়নি। সরকারি নির্দেশনায় গত ২৫ মার্চ থেকে সবকটি পাদুকা কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েক মাস বন্ধ রেখে গত ঈদুল আজহার আগে খোলা হয় কারখানাগুলো। কিন্তু বাজারে চাহিদা না থাকায় ছোট-বড় সব কারখানারই উৎপাদন কমে যায়।
মহামারি শুরুর আগে বড় কারখানাগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৯০০ থেকে ১০০০ জোড়া জুতা তৈরি হতো। আর ছোট কারখানাগুলোতে তৈরি হতো ৪০০ থেকে ৫০০ জোড়া জুতা। ঈদুল আজহার আগে কারখানা খোলার পর বড় কারখানাগুলোতে দৈনিক ৫০০ জোড়া আর ছোট কারখানাগুলোতে গড়ে ১৫০ জোড়া জুতা তৈরি করেন শ্রমিকরা।
সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর গত অক্টোবর মাস থেকে উৎপাদনও কিছুটা বাড়তে থাকে।
এখন প্রতিদিন বড় কারখানাগুলোতে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ জোড়া জুতা তৈরি হচ্ছে। তবে বাজারে চাহিদা না থাকায় ছোট কারখানাগুলোর উৎপাদন আরও কমেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জোড়া জুতা তৈরি করছে তারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পীরবাড়ি এলাকার অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপক নয়ন আহমেদ বলেন, 'এখন আমাদের কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ জোড়া জুতা তৈরি হচ্ছে। উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও বাজারে চাহিদা না থাকায়- ব্যবসায় মন্দাভাব কাটছে না। জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে যদি করোনা পরিস্থিতি খারাপ না হয়, তাহলে হয়তো ব্যবসা ভালো হবে'।
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের পরিচালক আক্তার হোসেন বলেন,'যেহেতু অনেক টাকা বিনিয়োগ করা আছে- সেজন্য ব্যবসা সচল রাখতে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও এখন জুতা তৈরি করতে হচ্ছে। কার্ একেবারে বন্ধ রাখলে আর বাজার ধরা যাবে না। শীতকাল শেষ হলে আমাদের জুতার চাহিদা বাড়বে বলে আশা করছি। তখন হয়তো ব্যবসা করে আমাদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারব।'
টাইগার সুজের স্বত্বাধিকারী মো. হানিফ মিয়া বলেন,'পাদুকা ব্যবসার মৌসুমের ঠিক আগমুহূর্তে করোনাভাইরাস দেখা দেয়। তারপর কয়েকমাস কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। সেজন্য আমরা এবারের মৌসুমে কাঙ্খিত ব্যবসা করতে পারিনি। এখন বাজারে চাহিদা নেই, কিন্তু ব্যবসা সচল রাখার জন্য জুতা তৈরি করতে হচ্ছে। সব শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করতে হচ্ছে।'
'করোনাভাইরাসের কারণে আমরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি- তা পুষিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই। ব্যবসা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। পাদুকা শিল্পও ঘুরে দাঁড়াবে, আমরা এখন সেই আশাতেই আছি'- যোগ করেন হানিফ মিয়া।
এব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহসিন মিয়া বলেন,'আমাদের ব্যবসা ঈদ-কেন্দ্রিক। দুই ঈদে করা ব্যবসার মাধ্যমেই সারা বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে করোনার কারণে আমরা এবারের মৌসুম ধরতে পারিনি। তাই কারখানা মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আমরা এখন ব্যবসা ভালো হওয়ার আশায় দিন পার করছি।'