শিক্ষাখাতে মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত বরাদ্দের আবেদন মন্ত্রণালয়ের
মিড-ডে মিল চালু, মাসিক উপবৃত্তির টাকা বাড়ানো, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস বাড়ানো এবং অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখে শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউট কমানো ও লার্নিং লস রিকভারির জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে অতিরিক্ত ১৮,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে অর্থমন্ত্রণালয় মাত্র ৭,৮০৪ কোটি টাকা বাড়ানোর সম্মতি দিয়েছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে গত বছর মার্চ থেকে বন্ধ থাকা ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে মিড-ডে মিল বিতরণ ও মাসিক উপবৃত্তির টাকা বাড়িয়ে ড্রপ আউট কমানোর পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এজন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অতিরিক্ত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে তারা। তবে অর্থবিভাগ থেকে এ মন্ত্রণালয় থেকে ২৪৯২ কোটি টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তরের শিক্ষার্থীর লার্নিং লস রিকভারির জন্য ৩০ লাখ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়া, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্রডব্যান্ড কানেকশন দেওয়া ও সংসদ টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রচার অব্যাহত রাখতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই বাড়তি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পূরণে সম্মতি দিয়েছে অর্থবিভাগ।
এ মন্ত্রণালয়ের অপর বিভাগ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ চেয়ে অর্থবিভাগ থেকে বাড়তি দু' হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পেয়েছে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থবিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ-সবাই বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। আগামী ১৬ মার্চ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং ২২ মার্চ বাকি দুই বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে তাদের কর্মপরিকল্পনা বিস্তারিত জেনে বরাদ্দের পরিমাণ চূড়ান্ত করা হবে।
'দীর্ঘ এক বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমানো হবে আগামী অর্থবছরের মূল্য চ্যালেঞ্জ। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হবে। তবে সরকারের সার্বিক রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও বিবেচনায় নিতে হবে', জানান তিনি।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর শিক্ষাখাতের দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ রয়েছে ৬৬,৪০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ২৪,৯৪০ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩৩,১১৯ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ৮,৩৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
প্রাথমিক ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে অর্থবিভাগের জারি করা পরিপত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ২৭,৪৩২ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩৬,৪৩১ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে অর্থবিভাগ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বাজেট) মো. নুরুন্নবী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউট কমাতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও লার্নিং লস রিকভারি করতে আগামী বাজেটে আমরা ২৯,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছি। এর মধ্যে ১২৮ কোটি টাকা কোভিড-১৯ এর কারণে লার্নিং লস রিকভারিতে ব্যয় করা হবে।
তিনি বলেন, 'দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যাতে ড্রপ আউটের শিকার না হয়, সেজন্য আমরা মিড-ডে মিল চালু করবো এবং শিক্ষার্থীদের মাসিক উপবৃত্তির বিদ্যমান ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হবে'।
'কোভিড পরিস্থিতির কারণে আমরা এবছর কোন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছি না। আমাদের মূল কাজ হবে ড্রপ আউট কমানো ও লার্নিং লস রিকভারি করা। বিভিন্ন প্রকল্পে আমাদের অব্যায়িত অর্থ রয়েছে, প্রয়োজনে সেখান থেকে অর্থ স্থানান্তর করে এ কাজে ব্যয় করা হবে', যোগ করেন তিনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় লার্নিং লস রিকভারি করতে আগামী অর্থবছর ৪৩,৬৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ৩৬,৪৩১ কোটি টাকা প্রাথমিক ব্যয় সীমা পাওয়ার পর আরও ৭২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে অর্থসচিব মো. আব্দুর রউফ তালুকদারকে ডিও লেটার পাঠিয়েছেন শিক্ষা সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (বাজেট) ফজলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'কোভিডজনিত কারণে শিক্ষার্থীদের লার্নিং লস রিকভারি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়া, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্রডব্রান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি স্কুল ও কলেজে ভবন নির্মাণসহ শিক্ষক নিয়োগে বাড়তি বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। এজন্যই অর্থমন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত ৭২৫০ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে'।
এ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ৩০ লাখ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনার জন্য আগামী অর্থবছর পৌনে তিন লাখ শিক্ষককে আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া, ৬২৫০টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ এবং ১৫০০ বেসরকারি কলেজ ও ৩০০ সরকারি কলেজে একাডেমিক ভবন নির্মাণ, সম্প্রসারণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম চালু করা ও আইসিটি ল্যাব স্থাপনসহ শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।
৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন একাডেমি ভবন নির্মাণসহ আইসিটি সামগ্রী সরবরাহ ও বৈজ্ঞানিক ল্যাব স্থাপনের পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া, নতুন অর্থবছরে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৪৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২৩৫ কোটি টাকা উপবৃত্তি বিতরণের লক্ষ্য রয়েছে মন্ত্রণালয়টির। নতুন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির পরিকল্পনাও রয়েছে এ বিভাগের।
অর্থ মন্ত্রণালয় নির্ধারিত ব্যয়সীমায় লার্নিং রিকভারি কিংবা উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য খুবই অপর্যাপ্ত জানিয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মনিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বাড়তি বরাদ্দের জন্য অর্থবিভাগে চিঠি পাঠিয়েছি'।
শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, 'করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা। একবছর ধরে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালুর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং শিক্ষার্থী ঝরে পড়া যাতে বাড়তে না পারে, সেজন্য স্কুল খোলার সময় থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের এক বছর ধরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা বাড়তি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এজন্য আগামী বাজেটে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে তাতে বরাদ্দ দিতে হবে'।
শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমানো ও লার্নিং লসেস রিকভার করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা খাতগুলোকে নানা প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু শিক্ষাখাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই আগামী বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই'।
তিনি বলেন, 'এটি ইতিবাচক যে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমাতে মিড-ডে মিল চালু, উপবৃত্তির টাকা বাড়ানোসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। তবে বাজেট বরাদ্দের অর্থ সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে কি-না, তা মনিটর করতে এনজিও প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে হবে'।
'অনেক শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবার থেকে স্কুলে আসে, যারা বন্ধের সময় পড়াশোনা করতে পারেনি। তাদের জন্য স্কুলে স্পেশাল কোচিং এবং টিউটোরিং দরকার হবে। এজন্য প্রতিটি স্কুলকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে', যোগ করেন তিনি।
মনজুর আহমেদ বলেন, 'সেকেন্ডারি লেবেলে মূল চ্যালেঞ্জ হলো লার্নিং লস রিকভারি করা। এজন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে বিশেষ প্রকল্প নেওয়া উচিত। না হলে সেকেন্ডারি লেবেলে শিক্ষার ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে'।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত চালু করতে না পারলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া আরও বেড়ে যাবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় জরুরি'।
তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল-কলেজে স্যানিটাইজার, মাস্ক সরবরাহ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে হবে এবং বরাদ্দের অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, সেজন্য স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এছাড়া, অনলাইন ক্লাস ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনায় জোর দেওয়া উচিত'।
'কোভিড পরিস্থিতিতে শুধু অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখলেই হবে না। অনেক শিক্ষার্থীই এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তাই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ চালুর ব্যবস্থা করতে হবে', বলেন ড. জাহিদ হোসেন।