করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি
করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া ও কুঁচে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে চীন। ফলে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার খামারে উৎপাদিত কাঁকড়া ও কুঁচে বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এ এলাকার উৎপাদিত কাঁকড়া ও কুঁচে নিয়ে বিপাকে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, উদ্ভুত পরিস্থিতি চলতে থাকলে কোনো কোনো ব্যবসায়ী অল্প দিনের মধ্যে দেওলিয়া হতে পারেন।
মৎস্যমাণ নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ১৯৭৭ সালে নাম ওঠে কাঁকড়ার। ওই বছর দেশ থেকে মাত্র দুই হাজার ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছিল। চলতি অর্থ বছরের (২০১৯-২০) প্রথম পাঁচ মাসে কাঁকড়ার রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৫৮০ কোটি টাকায়। অপরদিকে চলতি অর্থ বছরের একই সময় কুঁচে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। রপ্তানি হওয়া এসব কাঁকড়া ও কুঁচের ৮৫ ভাগের বেশি রপ্তানি হয় চীনে। কিন্তু চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত ২৫ জানুয়ারি থেকে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
খামারিরা জানান, খুলনা অঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার ছোটো-বড়ো খামারে কাঁকড়া ও কুঁচের চাষ হয়। স্বাভাবিক সময় প্রতিদিন এসব খামার থেকে ২৫ টন কাঁকড়া ও ১০ টন কুঁচে ঢাকার রপ্তানিকারকদের কাছে পাঠানো হয়। এখন এই কাঁকড়া ও কুঁচে খামারে মজুদ রয়েছে। ইতোমধ্যে খামারের ৮০ ভাগ কাঁকড়া ও কুঁচে মারা গেছে।
তারা হতাশার সুরে জানান, যে কাঁকড়া কেজি প্রতি ১৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হতো সেই কাঁকড়া এখন ৩০০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে না। ফলে খামারিরা কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারছে না।
মফিজুল ইসলাম নামে সাতক্ষীরার এক ব্যবসায়ী জানান, ‘‘করোনা ভাইরাসের কারণে বর্তমানে চীনে কোনো কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে না। ঢাকার রপ্তানিকারকরাও মজুদ কোনো মাল নিচ্ছে না। ফলে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’’
বাগেরহাটের মৎস্য খামারি জামাল শেখ জানান, ‘‘বিক্রি না হওয়া খামারগুলোতে কাঁকড়া ও কুঁচের স্তূপ তৈরি হয়েছে। ২৫ থেকে ৪১ দিনের মধ্যে কাঁকড়া আহরণ না করলে প্রকৃতির নিয়মে তা মারা যায়। ফলে এই অঞ্চলের খামারগুলোতে বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। এতে লোকসানে পড়ছেন খামারিরা।’’
বাগেরহাট কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকার কারণে আমাদের এ অঞ্চলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
‘‘এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু রপ্তানি বন্ধ ও খামারে পণ্য নষ্ট হওয়ায় কোনো ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে এই ব্যবসায় সম্পৃক্তরা পথে বসার উপক্রম হয়েছে।’’
বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় বিশ্বাস বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার ছোটো-বড়ো খামারে কাঁকড়া ও কুঁচে চাষ হয়। স্বাভাবিক সময় প্রতিদিন এসব খামার থেকে ২৫ টন কাঁকড়া ও ১০ টন কুঁচে রপ্তানিরকারকদের কাছে পাঠানো হয়। এখন সেগুলো খামারে স্তূপ হয়ে পড়েছে। আমরা এখন কর্মচারী ও বিক্রেতাদের টাকা দিতে পারছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
তিনি বলেন, ‘‘উৎপাদিত পণ্য নিয়ে চরমভাবে বিপাকে পড়েছে উপকূলীয় এলাকার খামারিরা। প্রতিদিন এ খাতে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় চার কোটি টাকা।’’
বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও রপ্তানিকারক মেহেদী হাসান বলেন, স্বাভাবিক সময় চীনে ২৫ থেকে ৩০ টন কাঁকড়া রপ্তানি হলেও চীনে নববর্ষের আগে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ টনে দাড়ায়। কিন্তু চীনে করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের পুরো রপ্তানি কার্যক্রম (শিপমেন্ট) বন্ধ রয়েছে। রপ্তানি বন্ধ থাকায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে হংকং, কোরিয়া ও তাইওয়ানের বাজারেরও। ইতোমধ্যে এখানের বাজারেও কাঁকড়া ও কুঁচের মূল্য কমে গেছে।
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে গত একমাসে আমাদের ১৫০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
খুলনা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘‘জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি নিয়ন্ত্রিত হয় ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে। আমাদের খুলনা কার্যালয়ে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। ফলে এ সম্পর্কিত ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।’’
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ লবস্টার চিংড়ি ও কাঁকড়া আমদানিকারক চীন। ২০১৯ সালে সারা বিশ্ব থেকে চীন মোট ১২ হাজার ৬০০ টন লবস্টার জাতীয় বড় চিংড়ি আমদানি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।