কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের ঈদ আনন্দ ম্লান
বেসরকারিভাবে পরিচালিত মানিকনগর আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ শাহজাহান। আর্থিকভাবে তিনি আজীবন স্বচ্ছল ছিলেন। জীবনে কখনো কোনো কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। ২০০৪ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই শিক্ষক স্কুলের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। মোঃ শাহজাহানের সঙ্গে শিশু শিক্ষায় নিয়োজিত আছেন আরও ১৫ জন শিক্ষক। প্রত্যেকেই স্কুল থেকে প্রাপ্ত বেতন দিয়ে সংসারের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন।
কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর গত বছরের মার্চ মাস থেকে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এই স্কুলটিও বন্ধ আছে। দীর্ঘদিনের স্কুল বন্ধ থাকাকালীন শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতনও পরিশোধ করা হয়নি।
কিন্ডারগার্টেনের এই প্রধান শিক্ষক স্কুলের একটি কক্ষে লুঙ্গি এবং শাড়ি বিক্রি করা শুরু করেন। নতুন ব্যবসায় তিনি দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি লোকসান গুনছেন।
"কঠিন পরিস্থিতিতে আছি। পরিবারের ব্যয়ভার এবং অন্যান্য খরচ সামলাতে পারছি না। আনন্দের বদলে এই ঈদ আমার জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছে। কেননা, আমি আমার ছেলেমেয়েদের জন্যও কোনো পোশাক কিনতে পারিনি। আমি আমার জীবনে কখনো এত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি," বলেন শাহজাহান।
শুধু শাহজাহানই নন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলটির মালিকপক্ষও তীব্র আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন। তারা শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছেন না। সমাধানের কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে অসংখ্য প্রাক-প্রাথমিক স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
বহু শিক্ষক তাদের পেশা পরিবর্তন করে কারিগর, বিক্রেতা কিংবা দিনমজুরের কাজ বেছে নিয়েছেন।
রোজ গার্ডেন হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন ফারজানান আখতার। বর্তমানে সংসারের খরচ চালাতে তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে মৃতদেহ ধোয়ার কাজ করেন। তিনি বলেন, "আমি এক বছর ধরে স্কুল খোলার অপেক্ষা করেছি। আমার সঞ্চিত অর্থ পুরোটাই খরচ করেছি। এখন আমি নিরুপায়। ঈদ-ঊল-ফিতরের মতো উৎসবেও পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানোর সামর্থ্য আমার নেই।"
দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিযুক্ত আছেন প্রায় ৮ লাখ শিক্ষক।
প্রাক-প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, ৮ লাখ শিক্ষকের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষক ইতোমধ্যে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শিক্ষকরা সত্যিই তীব্র আর্থিক সংকটের মাঝে আছেন।এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুড়িগ্রামে দুজন প্রধান শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। অনেকেই শোচনীয় অবস্থায় দিনযাপন করছেন।"
"সরকার আমাদের কোনো ধরনের সহায়তা করেনি, সেটি আমাদের দুর্ভাগ্য। খাতটিকে বাঁচাতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে পারে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্কুলগুলো প্রায় দুটি শিক্ষাবর্ষ হারিয়েছে। স্কুল পুনরায় কবে খুলবে সে বিষয়েও কোনো নিশ্চয়তা নেই,"
"কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সত্ত্বাধিকারীরা এই খাতে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ এভাবেই চলতে থাকলে অধিকাংশ বিনিয়োগ নষ্ট হবে," বলেন তিনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্কুলগুলো বেসরকারিভাবে পরিচালিত হত। এছাড়া অধিকাংশ স্কুলের অনুমোদন নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"বর্তমানে আমরা পাঠদানের ক্ষতি এবং ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে পর্যালোচনায় ব্যস্ত আছি। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই," বলেন তিনি।