কুমিল্লার ঘটনায় ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন
কুমিল্লায় পবিত্র কোরআনের অবমাননাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনার জের ধরে কুমিল্লা, ঢাকা বিভাগের নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জসহ ২২টি জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিজিবি'র পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের চাহিদার প্রেক্ষিতে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্গা পূজার নিরাপত্তা রক্ষার্থে দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাহিদা থাকলে রাজধানী ঢাকা-সহ অন্যান্য জেলায়ও বিজিবি মোতায়েন করা হবে বলে জানান বিজিবি'র ওই কর্মকর্তা।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, চন্দনাইশ ও পটিয়া উপজেলায় আট প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে হাটহাজারী ও বাঁশখালী উপজেলায় দুই প্লাটুন করে এবং অপর ৪ উপজেলায় ১ প্লাটুন করে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গতকাল (বুধবার) রাতে চাঁদপুরে সংঘর্ষে চারজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বুধবার রাতে জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন দুর্গাপূজা মণ্ডপে এ নিয়ে সংঘর্ষ হয় বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন হাজীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুনুর রশীদ।
চাঁদপুরে দুইটি পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, "সহিংসতায় চাঁদপুরে ৪ জন মারা যায়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চাঁদপুরে ৭২ জনকে আটক করা হয়েছে।"
মণ্ডপ পরিদর্শনের সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইকবাল হোসেন, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।
এদিকে, বুধবার রাতে কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে সংঘর্ষের জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন বলেন, 'জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফয়েজ আহমেদ নামে একজনকেও আমরা আটক করেছি। তিনি ওই ঘটনার ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওটি ধারণ করেছিলেন।'
এদিকে গাজীপুরের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে হামলার অভিযোগে শহরটি থেকে অন্তত ২০ জন সন্দেহভাজনকে আটক করেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ প্রসঙ্গে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, 'অপরাধীদের শনাক্ত করতে আমরা তদন্ত চালাচ্ছি। প্রচলিত আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
গাজীপুরের ডেপুটি কমিশনার এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন, 'জেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে আমরা ৯ প্লাটুন বিজিবি চেয়েছি। আমরা ইতোমধ্যেই পূজা মণ্ডপগুলোতে অতিরিক্ত আনসার সদস্য মোতায়েন করেছি।'
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে বুধবার মৌলভীবাজারের অন্তত সাতটি পূজা মণ্ডপে হামলার খবর পাওয়া গেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশেকুল হক বলেন, 'আমরা সবগুলো স্থান পরিদর্শন করছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাছাড়া পূজা মণ্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।'
দিনাজপুরে বিজিবি'র পাশাপাশি রংপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সও মোতায়েন হয়েছে।
বিজিবি দিনাজপুর সেক্টরের সহকারী পরিচালক মেজর শাহজাদ হোসেন জানান, ইতোমধ্যেই ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে, আরও ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের অপেক্ষায় রয়েছে।
দিনাজপুর পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, দিনাজপুরে এবার মোট ১,২৮১টি মন্দিরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বুধবারের ঘটনার পরপরই দিনাজপুর পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স ও রংপুর থেকে অতিরিক্ত রিজার্ভ ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।
কুমিল্লার ঘটনার জেরে বান্দরবানের লামায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। লামা থানার উপপরিদর্শক মো. জুম্মা বলেন, "বৃহস্পতিবার সকালে 'সর্বস্তরের তৌহিদী জনতা' ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিলের পর এক পর্যায়ে লামা বাজারে একটি মন্দির এবং কিছু ঘরবাড়ির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।"
'পরে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ১২-১৩ জন আহত হয়েছেন। তবে আহতদের এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। দুপক্ষের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে একজন এসআই-সহ তিন পুলিশ সদস্যও আহত হন,' বলেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
আহতদের উদ্ধার করে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পার্শ্ববর্তী জেলা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
জেলা পুলিশ সুপার জেরিন আক্তার জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে প্রত্যেক মন্দিরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশের পাশপাশি সেনা ও বিজিবি সদস্যরাও মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া জেলার সব এলাকায় আরও গভীর নজরদারি রাখা হচ্ছে।
এদিকে সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট (পিআইডি) বুধবার এ সংক্রান্ত একটি প্রেস নোট জারি করেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, 'কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার সংবাদটি সরকারের নজরে এসেছে এবং এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।'
এদিকে, ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোঃ ফরিদুল হক খান এক জরুরি বিবৃতিতে বলেছেন, 'কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। প্রত্যেকেরই ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখা উচিত।'
'দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে এবং যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে,' যোগ করেন প্রতিমন্ত্রী।