কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল প্রকল্প প্রায় থমকে গেছে
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজের মেয়াদ দুই দফায় শেষ হলেও বাকি রয়েছে ৭০ শতাংশ কাজ। প্রথমবার কাজের মেয়াদ গত বছরের মে মাসে শেষ হলে মাত্র ১৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও কাজ হয় মাত্র ৩০ শতাংশ।
২০২২ সাল পর্যন্ত পুনরায় কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও গত ডিসেম্বর থেকে আরও ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর কাজের পরিমাণ এখনও ৩০ শতাংশেই আছে। অর্থাৎ, গত ছয়মাসে অগ্রগতি শূন্য।
সব মিলিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করা হলেও কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। ফলে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারতের কালিন্দি রেলনির্মাণ কোম্পানি সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পারবে কি না তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৯৬ সালের ৪ ডিসেম্বর চালু হয় কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটি। এটি ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরপর কুলাউড়া-শাহবাজপুর পর্যন্ত লাতুর ট্রেন নামে একটি ট্রেন চলাচল করত। তবে বাজেট স্বল্পতার কারণে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এক সময় ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে রেলপথটি।
লক্কর ঝক্কর রেল লাইনে ঘন ঘন রেল দুর্ঘটনা ও রেলপথটি চলাচল অনুপোযোগী কারণ দেখিয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ২০০২ সালের ৭ জুলাই বন্ধ করে দেওয়া হয় দীর্ঘ ১০৬ বছর চালু থাকা এ রেলপথটি।
বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রেলের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়। সড়কপথে ভাড়া বেশি হওয়ায় এলাকাবাসীর যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। বড়লেখা, মুড়াউল, জুড়ী, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলী, ও শাহবাজপুর এ ছয়টি রেল স্টেশন স্থবির হয়ে পড়ে। ট্রেন চালুর দাবিতে বিভিন্ন আন্দোলন করেন সাধারণ মানুষ, তারা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে সভা-সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।
পণ্য পরিবহণ এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে ২০১০ সালের পর ভারত এবং বাংলাদেশ বন্ধ লাইনটি চালুর উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের ২৬ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেকে) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
৬৭৮ কোটি ৫০ লাখ ৭৯ হাজার টাকার অনুমোদিত প্রকল্প পরবর্তীতে সংশোধন করে ৫৪৪ কোটি টাকা ধরা হয়। কাজের মধ্যে রয়েছে কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে শাহবাজপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার মেইন লাইন ও ৭ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার লুপ লাইন মিলে মোট ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ।
ব্রডগেজ ও মিটার গেজের দ্বৈত লাইন ছাড়া রয়েছে ছয়টি স্টেশন নির্মাণ এবং ৫৯টি সেতু কালভার্ট। প্রকল্প ব্যয়ের ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ এবং বাকি ৭৫ শতাংশ ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে সরকার। কাজের ঠিকাদারি পায় ভারতীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কালিন্দি রেল নির্মাণ কোম্পানি।
প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে ভারতের 'বালাজি রেল রোড সিস্টেমস' নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের আওতায় সেকশনটিতে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের মধ্যে মেইন লাইন ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার ও লুপ লাইন ৭ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। নতুন রেল ও পিসি স্লিপার দ্বারা ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল লাইনে পুনর্বাসন করা হবে।
ছয়টি (বি ক্লাস ৪টি ও ডি ক্লাস ২টি) স্টেশন ভবন এবং প্লাটফর্ম নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হবে। ৫৯টি রেল সেতুর এর মধ্যে মেজর ১৭টি ও মাইনর ৪২টি সেতু নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হবে। নন-ইন্টারলকড কালার লাইট সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে।
বন্ধ হবার দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০১৮ সালের আগস্টেও ১০ তারিখ থেকে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। কাজের মেয়াদ ধরা হয় দুই বছর। ২০২০ সালের মে মাসে শেষ হয় কাজের মেয়াদ। তবে, মেয়াদ শেষ হলেও কাজ হয় মাত্র ১৭ শতাংশ।
এরপর পুনরায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এই সময়ে মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর আবারও কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি হলেও এখনো কাজ আটকে আছে ৩০ শতাংশে। যে গতিতে কাজ চলছে তাতে আগামী পাঁচ বছরে কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান স্থানীয়রা।
সম্প্রতি (কঠোর লকডাউনের পূর্বে) কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলওয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এত বড় প্রকল্প কিন্তু কাজ পুরো বন্ধ, সাইটে কোনো কর্মকর্তা বা শ্রমিকের কেউ নেই।
তবে একজন কর্মকর্তাকে পাওয়া গেলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। পরে নাম পদবি প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, "করোনার কারণে কাজের গতি কমেছে। একেবারে বন্ধ হয়েছে তা যেমন বলতে পারছি না, আবার চাহিদা মাফিক কাজ হচ্ছে তাও বলতে পারছি না। গত কয়েকমাসে কাজের পরিমাণ ৩০ শতাংশে আটকে আছে।"
"তবে এর মধ্যে আমরা বেশ কিছু কাজ করেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: পুরোনো রেল লাইন অপসারণ করে এক্সেভেটর দিয়ে রেলপথটি মাটি ভরাট করে উঁচু ও প্রশস্তকরণের কাজ এবং পুরাতন রেল ব্রীজ ভেঙ্গে সেগুলো পুনঃনির্মাণ কাজ। এছাড়া, জুড়ী অংশে দখলকৃত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে রেল কর্তৃপক্ষ। শাহবাজপুর, বড়লেখা, মুড়াউল , দক্ষিণভাগ স্টেশনের পুরাতন ভবন ও প্লাটফর্মসহ সকল স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে নতুন ভবন, প্লাটফর্ম ও স্থাপনের কাজ এখনো শুরু হয়নি।"
তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালিন্দি রেলনির্মাণের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ বা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি। তারা জানালেন কাজের অগ্রগতিসহ সার্বিক বিষয় প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন।
এ প্রকল্পটি নিয়ে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা প্রসঙ্গে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় জুন ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত মোট ব্যয় হয়েছে একশ ১২ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে সরকারের তহবিলের ১২ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা এবং ঋণ থেকে ৯৯ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৬১ কোটি টাকা।
প্রকল্পের কাজ তদারকি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কুলাউড়া-শ্রীমঙ্গল এবং সিলেটের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী জুয়েল হোসাইন বলেন, "করোনার প্রথম ঢেউয়ে লকডাউনে কয়েকমাস কাজ বন্ধ ছিল। বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার কাজের গতি কমে গেছে। একেবারে কাজ বন্ধ হয়নি আবার স্বাভাবিক গতিতে কাজ হচ্ছে তাও বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশ কাজ শেষ শেষ হয়েছে। কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২২ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এই সময়ের ভেতরে কাজ শেষ হয়ে যাবে।"
তবে এই কর্মকর্তা গত বছরের ডিসেম্বরেও প্রতিবেদককে ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথা বলেছিলেন। গত ছয় মাসে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, "বর্তমানে কাজ হচ্ছে না বললেই চলে, স্থবির অবস্থা"।
তবে কাজের মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, "এখনো তেমন কিছু হয়নি, প্রকল্প ব্যয় বাড়েনি। ভবিষ্যতে বাড়বে কি না বা কী হবে তা নিয়ে ধারণা নেই। তবে প্রকল্প যদি একই থাকে বা নতুন কিছু যুক্ত না হয়, তবে ব্যয় বাড়ার সম্ভাবনা নাই।"
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সুলতান আলী বলেন, "বিভিন্ন কারণে সময়মত কাজ শেষ করা যায়নি। তবে কাজের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সময়ের ভেতরে শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।"
পরিকল্পনা কমিশনের মতে, এ লাইন চালু হলে ভারত বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও পর্যটনের প্রসার ঘটবে।
লাইন দিয়ে কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত পাঁচটি ট্রেন চলাচল করবে। লোকাল ট্রেন ছাড়াও আন্তঃনগর ট্রেন চলবে। একইসঙ্গে ভারতীয় ট্রেনও এই পথে চলাচল করবে।