কোথায় যাবেন আছিয়া বেওয়া
বাঁধের রাস্তায় সারাজীবন কাটিয়েছেন আছিয়া বেওয়া (৬০)। বাবা মৃত মান্দু মিয়া ছিলেন দিনমজুর। নদী ভাঙনে জমি-জায়গা হারিয়ে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাঁধে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা জরিনা বেওয়া (৮০) কাজ নিলেন অন্যের বাড়িতে। এছাড়া বাঁধের রাস্তার গোবর কুড়িয়ে সেই গোবর দিয়ে ঘুঁটে (গোবর শুকিয়ে বানানো জ্বালানি) বানিয়ে তা বিক্রি করে চলতো তাদের সংসার।
বিয়েও হয়েছিল আছিয়ার। তবে বেশি দিন স্বামী সংসারে থাকতে পারেননি। স্বামীর ছিল আরও দুই স্ত্রী। বিয়ের কয়েকবছর পর মারা যান স্বামী খেজমত। ততোদিনে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন আছিয়া। তারা আবারও ফিরে যান বাঁধে। আছিয়ার মেয়ে সাহেরাও ছোটবেলা থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।
সারাদেশে বাঁধের উপর গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর একটি নোটিশ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কুড়িগ্রামের ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ার চর এলাকা থেকে চিলমারী পর্যন্ত ৫২.৭ কিলোমিটার বাঁধের ওপর অবৈধভাবে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। তাদেরকেও সরে যেতে গত ২৩ ডিসেম্বর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তা দুই দফা বাড়ানো হয়। সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর সময় না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বাঁধের বাড়ি-ঘর খুলে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন বাঁধ এলাকার মানুষরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান চাইলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। ফলে ৪০ হাজার মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে।
একই এলাকায় আলেয়া বেওয়া (৬০)। কিছুদিন আগে ঠেলাগাড়ি চালক স্বামী মন্তাজকে হারিয়েছেন। স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই পড়েছেন বাড়ি হারানোর শোকে। আলেয়া বেওয়া জানান, ফেকামারীর চরে ছিল তার বাড়ি। ধরলার ভাঙনে ১২ বার তার বাড়ি সরাতে হয়েছে এচর থেকে সেচরে। সবশেষে স্বামী মন্তাজ বাঁধের পাড় ঘেষে পাঁচ শতক জমি কিনে ঘর তুলে থাকতে শুরু করেছিলেন। এই জমি যে খাস জমি ছিল তা তিনি জানতেন না। সম্প্রতি আলেয়া বাড়ি ভাঙার নোটিশ পেয়েছেন। কিন্তু ঘর খুলে নিয়ে বসে আছেন তিনি। কিন্তু কোথায় যাবেন জানেন না।
আশরাফ আলী (৪০) ও তার স্ত্রী আফরোজা (৩৭)। দুজনেই এতিম। অন্যের বাড়িতে বড় হয়েছেন। নিজের পরিবার ছিল না, ছিলনা বাড়িঘরও। বাঁধের রাস্তায় ঘর তুলে সংসার পেতেছিলেন। তাদের ঘরে আইরিন (১৩) ও আরিফ (৬) নামে দুই সন্তান রয়েছে। এলাকায় তেমন কাজ না থাকায় নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানায় গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। ঘর ভাঙার খবর পেয়ে সম্প্রতি তারা ফিরে এসেছেন। বাধ থেকে ঘর খুলে নিয়ে রাস্তার পাশেই বসে আছেন। এর পরের ঠিকানা কোথায় হবে তারা জানেন না।
ভরসার মোড় এলাকায় বাঁধের রাস্তায় ২২ বছর ধরে বসবাস করছেন মৃত কাশেম আলীর ছেলে কাঠমিস্ত্রি লিটন। এর আগে কদমতলার চরে তার বাড়ি তিন বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। জমিজমা হারিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন বাঁধে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাদের ছিল স্বচ্ছল সংসার। ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করছে। মেয়ের বয়স ১৭ হওয়ায় আগেই তার বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছিলেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাড়ি ভাঙার নোটিশ পেয়ে তারা জমি কেনার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। কিন্তু জমি কিনতে পারেননি।
লিটন বলেন, ‘‘ঘর ভেঙে বসে আছি। কিন্তু কোথাও যেতে পারছি না। হঠাৎ করে জমির দামও বেড়ে গেছে। আমরাও তো এই দেশের নাগরিক। আমরাও ভোট দেই। কিন্তু আমাদের কথা কেউ ভাবে না।’’
কথা হয় মৃত কাশেম উদ্দিনের ছেলে রাজমিস্ত্রি মহির আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘আমার বাড়ি ছয় বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। এখনও কিছু জমি থাকায় আমাকে বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয়নি। যারা বাঁধে আশ্রিত ছিল, তাদের কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। যাদের বাড়িঘর ভাঙা হয়েছে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। সরকারের উচিত ছিল, এই মানুষগুলোর থাকার ব্যবস্থা করে তারপর উচ্ছেদ নোটিশ দেওয়া।’’
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কুড়িগ্রামের ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ার চর এলাকা থেকে চিলমারী পর্যন্ত ৫২.৭ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কারসহ পূণঃনির্মান করা হবে। বাঁধের উপরিস্তরের প্রস্থ্য করা হবে ছয় মিটার। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত নির্মিত এসব বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে অনেক মানুষ। তারা বাঁধ কেটে বা বাঁধের উপরেও ঘর করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে। বাঁধবাসীরা কোথাও কোথাও এভাবে বাড়িঘর নির্মান করেছে যে বাঁধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বন্যায় পানির তোড়ে ভেঙে যায় এসব এলাকা। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। তাই বাঁধে আশ্রিতদের সরে যাওয়ার কয়েক দফা নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চারটি পয়েন্টে বুলডোজার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কেউ সরে যেতে না চাইলে তাদের স্থাপনা ভেঙে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে অধিকাংশ লোকজন সরে যাচ্ছে। এই বাঁধে প্রায় আট হাজার পরিবারের ৪০ হাজারের মতো মানুষ বাস করতো।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভিন জানান, কুড়িগ্রামে বন্যার ভয়বহতা প্রতি বছর বাড়ছে। তাই বাঁধগুলো সংস্কার খুব জরুরি। পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যায়ক্রমে সবগুলো বাঁধ সংস্কার করবে। বাঁধে আশ্রিত মানুষগুলোকে জনস্বার্থেই সরে যেতে হবে। এতো বিশাল সংখ্যক মানুষকে সরকারিভারে আশ্রয় দিয়ে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আপাতত সম্ভব নয়। তবে পর্যায়ক্রমে তাদের জন্য খাসজমি-আবাসনসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি সহায়তার আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে।