নিওম প্রকল্পের জমি বাধামুক্ত করতে প্রয়োজনে সৌদি বাহিনীকে ‘হত্যার’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের প্রকল্প নিওম। প্রকল্পটির অধীনে ভবিষ্যতের সব স্থাপনা গড়ে তোলা হবে ধু ধু মরুভূমির বুকে। নিওমের প্রধান উপ-প্রকল্প হলো 'দ্য লাইন' নামক শহর। আর এটি নির্মাণে প্রয়োজনে সেনাদের প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। খবর বিবিসির
শত শত কোটি ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে এই শহর নির্মাণে। যা বাস্তবায়নে কাজ করছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। কিন্তু প্রকল্পের জন্য জমি খালি করতে মারাত্মক ওই নির্দেশ দেওয়া হয় বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন দেশটির সাবেক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
স্বেচ্ছা নির্বাসন নেওয়া সেনা কর্মকর্তা কর্নেল রাবিহ আল-এনেজি জানান, জমির জন্য স্থানীয় একটি গোত্রকে তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদের নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে। এর বিরোধীতা করায় একজনকে গুলি করেও হত্যা করা হয়।
এবিষয়ে জানতে বিবিসি যোগাযোগ করার পরে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে সৌদি সরকার ও নিওম প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
নিওম প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি ডলার। অবিশ্বাস্য এই অর্থে নিওমকে ইকো-রিজিয়ন বা পরিবেশবান্ধব অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য আছে। এটি বিন সালমানের ভিশন-২০৩০ এর অংশ, যার মাধ্যমে পর্যটন ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ করে অর্থনীতির জ্বালানি তেল-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার কৌশল নেওয়া হয়েছে।
নিওমের প্রধান প্রকল্প 'দ্য লাইন' হবে সরলরেখায় নির্মিত এক শহর। মাত্র ২০০ মিটার লম্বা এবং ১৭০ দীর্ঘ এই শহর হবে মোটরকার-মুক্ত। শহরের অধিবাসীরা চলাচল করবে আধুনিক গণপরিবহনে।
তবে ২০৩০ সাল নাগাদ শহরটির মাত্র ২.৪ কিলোমিটার নির্মাণ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দ্য লাইন কত বড়?
নিওম প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে কয়েক ডজন বৈশ্বিক কোম্পানি। এরমধ্যে বেশকিছু কোম্পানি হচ্ছে ব্রিটিশ।
প্রকল্পটির জন্য নির্ধারিত এলাকাকে উপযুক্ত 'খালি ক্যানভাস' হিসেবে বর্ণনা করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। জায়গাটি খালি করতে ৬ হাজার স্থানীয় অধিবাসীদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানায় সৌদি সরকার। তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একটি সৌদি মানবাধিকার গোষ্ঠী আলকাস্ত এর হিসাবে, প্রকৃত সংখ্যাটি আরো বেশিই হবে।
সৌদি কর্তৃপক্ষের গুঁড়িয়ে দেওয়া তিনটি গ্রাম – আল খুরাইবাহ, শার্মা এবং গায়াল এর কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিও বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। এতে দেখা যায়, জনপদগুলোর স্কুল, হাসপাতাল, বাড়িঘর সব যেন মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় শার্মা গ্রাম
গত বছর যুক্তরাজ্যে নির্বাসন নেন রাবিহ আল-এনেজি। তিনি জানান, আল-খুরাইবাহ গ্রামটি খালি করতে তাঁকে প্রয়োজনে হত্যা করার ওই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। দ্য লাইন প্রকল্প এলাকার সাড়ে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণের এই গ্রামটির বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিলেন হুয়াইতাত গোত্রের সদস্য। সৌদির তাবুক অঞ্চলে তারা বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন।
২০২০ সালের এপ্রিলে আলেনজিকে জানানো হয়, হুয়াইতাত গোত্রে 'অনেক বিদ্রোহী' আছে। "যারা (উচ্ছেদের) বিরোধিতা করেই চলেছে, তাদের হত্যা করতে হবে। এজন্য (নির্দেশ অমান্য করে) যারা বাড়িতে অবস্থান করবে– তাদের বিরুদ্ধে ঘাতক শক্তির ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।"
কিন্তু, এই নির্দেশ মানতে বাধ সাধে তার বিবেক। শারীরিক অসুস্থতার ওজর দিয়ে তিনি এই মিশন এড়ানোর চেষ্টাও করেন। পরে তাঁকে ছাড়াই এটি সম্পন্ন করা হয়।
উচ্ছেদের সময় সৌদি ভূমি নিবন্ধন কমিটি এক ব্যক্তির সম্পত্তির মূল্যায়ন করতে চায়। কিন্তু আবদুল রহিম আল-হুয়াইতি নামের ওই গ্রামবাসী তাতে রাজি হননি। এসময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে উচ্ছেদের বিরোধিতা করে সামাজিক মাধ্যমে বেশকিছু ভিডিও পোস্ট করেছিলেন তিনি।
ওই সময় এক বিবৃতি দিয়ে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী জানায়, আবদুল রহিম নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন, আত্মরক্ষায় তারাও পাল্টা গুলি করে। তবে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলেছে, শুধুমাত্র উচ্ছেদকাজে বাধা দেওয়ার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
কর্নেল রাবিহ আল-এনেজির বক্তব্যটি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। তবে সৌদি গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত সূত্রগুলো তার বক্তব্য সম্পর্কে বলেছে, উচ্ছেদের আদেশ যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, এর সাথে তার বক্তব্যের সামঞ্জস্য আছে। এই মিশন সম্পর্কে তারা সাধারণভাবে যেটা জানেন তার সাথেও এই বক্তব্য সাংঘর্ষিক নয়।
সূত্রগুলো মনে করে, কর্নেল পদমর্যাদার সিনিয়র অফিসার হওয়ায় – তাঁকে এই মিশন বাস্তবায়নের উপযুক্ত মনে করতেই পারে সৌদি সরকার।
জাতিসংঘ ও আলকাস্তের তথ্যমতে, উচ্ছেদের বিরোধিতা করায় আরো ৪৭ জন গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়, পরে যাদের বিচার করা হয়েছে সন্ত্রাস-বিষয়ক নানান অভিযোগে। এর মধ্যে ৪০ জন এখনো কারাগারে, পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আলকাস্ত আরও জানিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে আবদুল রহিম আল-হুয়াইতির হত্যার ঘটনায় যারা শোকপ্রকাশ করার কারণেও বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি দ্য লাইন নির্মাণের জন্য যাদের সরিয়ে নিতে হয়েছে, তাদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, আলকাস্ত বলেছে, যে পরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কমই দেওয়া হয় ক্ষতিগ্রস্তদের।
রাবিহ আল-এনেজি বলেন, " (নিওম) মোহাম্মদ বিন সালমানের আইডিয়াগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে। এজন্যই হুয়াইতাত গোত্রকে দমনে তিনি এত নিষ্ঠুরতা দেখান।"
নিওম স্কাই প্রকল্পের একজন সাবেক সিনিয়র নির্বাহী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অ্যান্ডি ওইয়ার্থ। ২০২০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে এ দায়িত্ব নিতে সৌদিতে যান। তবে সেখানে যাবার আগেই এই হত্যাকাণ্ডের কথা তিনি শুনেছিলেন।
অ্যান্ডি জানান, তিনি তার কর্মচারীদের এই উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে বারবার জিজ্ঞেস করেছেন, কিন্তু তাদের উত্তর তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
তিনি বলেন, "ঘটনাটা শুনেই মনে হয়েছে, সেখানকার মানুষের ওপর করা ভয়াবহ কিছু করা হয়েছে। নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য অন্যদের গলা বুটের তলায় মাড়িয়ে এগুনো কখনোই উচিত না।"
প্রকল্পের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এনিয়ে তার বনিবনাও হয়নি। এবং যোগদানের মাত্র এক বছর পরেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
লোনা পানি পরিশোধন করে সুপেয় পানি উৎপাদনকারী ব্রিটিশ একটি ডিস্যালিনেশন কোম্পানিও ছিল নিওমের এই প্রকল্পে। ২০২২ সালে কোম্পানিটি ১০ কোটি ডলার মূল্যের ওই প্রকল্প থেকে সরে আসে। সোলার ওয়াটার পিএলসি নামের ওই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যালকম অহ-ও প্রচুর সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, "উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পাওয়া ধনীরা হয়তো (দ্য লাইনের) সুফল পাবে, কিন্তু বাকিদের কী হবে?"
তার মতে, ওই অঞ্চল সম্পর্কে ভালো বোঝাপড়া থাকায় স্থানীয় জনসংখ্যাকেও মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। "উচ্ছেদ না করে বরং উন্নতি বা নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য তাদেরই পরামর্শ নেওয়া উচিত।"
উচ্ছেদের শিকার গ্রামবাসীও ভয়ে এনিয়ে কথা বলতে চাননি। তাদের শঙ্কা বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে এভাবে সাক্ষাৎকার দিলে তাদের গ্রেপ্তারকৃত আত্মীয়দের আরো বিপদ হবে।
তবে সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ কর্মসূচির আওতায় সৌদি আরবের অন্যান্য এলাকা থেকে যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের সাথে কথা বলেছে বিবিসি। যেমন জেদ্দা সেন্ট্রাল প্রকল্পের জন্য ১০ লাখের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সৌদির দক্ষিণের এই শহরে প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে একটি অপেরা হাউস, ক্রীড়াঞ্চল, অত্যাধুনিক বিপণীকেন্দ্রসহ আবাসিক ভবন।
আজিজিয়া এলাকায় বড় হয়েছেন নাদের হেজাজি (ছদ্মনাম)। জেদ্দা সেন্ট্রাল প্রকল্পের জন্য মোট যে ৬৩টি মহল্লার বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা ভাঙা হয়েছে, তারমধ্যে আজিজিয়াও ছিল। ২০২১ সালে আজিজিয়ায় তার পৈত্রিক বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হয়, কিন্তু বাড়ি খালি করার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল এক মাসেরও কম সময় আগে।
এলাকাটিকে যেভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, তার ছবি দেখে রীতিমতো হতবাক হয়ে পড়েন হেজাজি। তিনি বলেন, ছবি দেখে মনে হয়েছে যেন এক যুদ্ধকবলিত অঞ্চল। "ওরা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, আমাদের পরিচয় ধবংসে যুদ্ধ করছে।"
সৌদি অধিকারকর্মীরা বিবিসিকে জানান, জেদ্দায় ওই আবাসিক এলাকাগুলো ভাঙার সময় গত বছর দুজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের একজন উচ্ছেদ অভিযানে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় ধব্বংস-বিরোধী গ্রাফিতি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করায়।
জেদ্দার দাহবান কারাগারে বন্দি একজনের আত্মীয় জানান, তিনি শুনেছেন আরো ১৫ জনকে ওই কারাগারে এজন্য বন্দি করে রাখা হয়েছে। ধবংস করার জন্য নির্দিষ্ট করা এলাকায় তারা একটি বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করাই ছিল তাদের অপরাধ। সৌদি আরবের কারাগারে গিয়ে প্রতিবেদনের জন্য খোঁজখবর করা বেশ কঠিন। এজন্য এসব তথ্য যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।
জেদ্দার মহল্লাগুলো থেকে উচ্ছেদ হওয়া ৩৫ জনের মধ্যে একটি জরিপ করেছে আলকাস্ত। এদের সকলেই বলেছেন, তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। এমনকী স্থানীয় আইন অনুসারে, যথেষ্ট সময় আগে তাদের সতর্কও করা হয়নি। অন্তত অর্ধেক ব্যক্তি জানান, গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে বাস করলেও এখনও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কর্নেল আল-এনেজি। তিনি জানান, সৌদির একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাঁকে বলেছেন, লন্ডনের সৌদি দূতাবাসে গিয়ে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটি বৈঠকে অংশ নিলে তাঁকে ৫০ লাখ ডলার দেওয়া হবে। আল-এনেজি এককথায় এই প্রস্তাবে না বলে দেন।
তার করা অভিযোগগুলো সম্পর্কে সৌদি সরকারকেও জানিয়েছে বিবিসি। কিন্তু, সেখান থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
নির্বাসনে থাকা সৌদি সরকারের সমালোচকদের ওপর হামলার ঘটনার নজির রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে যুক্তরাস্ত্র-ভিত্তিক সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যাকাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশেই তাঁকে হত্যা করা হয়। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স।
কথিত ভবিষ্যতের শহর নির্মাণের জন্য বলপ্রয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে উৎখাতের নির্দেশ অবজ্ঞা করা নিয়ে কোনো আক্ষেপ করেন না কর্নেল আল-এনেজি। এতে নির্বাসন জীবন কাটাতে হলেও তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই মনে করেন।
তার মতে, "নিওম নির্মাণের পথে কোনোকিছুকেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেবেন না মোহাম্মদ বিন সালমান। … তাই আমাকে নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যা করতে বলা হয়েছিল– সেই বিষয়টিই আমাকে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত করে।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ