ক্ষমতা ভাগাভাগির পর ‘বিরোধ মিটেছে’ জাতীয় পার্টিতে
নেতৃত্ব নিয়ে জাতীয় পার্টিতে চলমান টানাপড়েনের সমাপ্তি আপাতত হয়েছে। দলীয় চেয়ারম্যানের পদ ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ ভাগাভাগির পর ঠিক হয়েছে এরশাদের মৃত্যুতে খালি হওয়া রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে দলটির প্রার্থীও।
শনিবার রাতে বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাবে রওশন এরশাদপন্থী ও জিএম কাদেরপন্থী নেতাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সমঝোতার পর রোববার সংবাদ সম্মেলন করে নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানান দলটির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলটির চেয়াম্যান হবেন এরশাদের ভাই জিএম কাদের এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ।
আর রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির হয়ে লাঙল প্রতীক নিয়ে লড়বেন এরশাদের ছেলে রাহগীর আল মাহী সাদ (সাদ এরশাদ)।
রোববার (৮ আগস্ট) জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব রাঙ্গাঁ বলেন, “প্রথমে আমাদের যে বিষয়টি ছিল, সেটি হল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব কে পালন করবেন। এটা নিয়ে একটি বিতর্ক ছিল। সেটি কাল সমাধান হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নির্দেশিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের সাহেব। বেগম রওশন এরশাদ, যিনি আমাদের চেয়ারম্যানের পত্নী, তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করবেন।”
সে সময় রাঙ্গাঁ জানিয়েছিলেন, রংপুর-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থীর বিষয়ে দলের মহাসচিব ও চেয়ারম্যান একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন।
তবে বিকেলেই চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের ১৪ জ্যেষ্ঠ নেতাকে নিয়ে আলোচনার পর রাঙ্গাঁ জানালেন, সাদ এরশাদই হচ্ছেন রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী।
ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে টানাপড়েনের ফলে দলটিতে যে ভাঙনের উপক্রম হয়েছিল তা আপাতত থামল।
যেভাবে দ্বন্দ্বের শুরু জাতীয় পার্টিতে
জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে এরশাদের ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং এরশাদপত্নী রওশনের দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। তবে এরশাদ জীবিত থাকাকালীন তিনি সবকিছু সামলে রাখায় এই দ্বন্দ্ব ততটা সামনে আসেনি। এরশাদ মারা যাওয়ার দু’মাস না পেরোতেই পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। স্পষ্ট হয়েছে এই দু’নেতাকে কেন্দ্র করে দলের দুটি বলয়।
ঘটনার সূত্রপাত গত মঙ্গলবারে। সেদিন (৩ সেপ্টেম্বর) জি এম কাদের নিজেকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেন। এর একদিন পর বুধবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদের নামে স্পিকারের কাছে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয় যাতে বলা হয়, জি এম কাদেরের ওই চিঠি যেন গ্রহণ না করা হয়।
চিঠি পাঠানোর ব্যাখ্যায় জিএম কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ভাই এরশাদ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন, তিনিও সেভাবেই নিয়েছেন।
“বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়ন প্রশ্নে জোর করে কিছু করা হয়নি। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
তবে একই দিন রওশন এরশাদের বাড়িতে বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক ছাড়া স্পিকারকে দেওয়া কাদেরের চিঠিটির ‘কোনো দাম নেই’ তাদের কাছে।
তিনি বলেন, “জি এম কাদের পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক না করেই লুকিয়ে এই চিঠি দিয়ে থাকলেও আমি ও আমরা সে বিষয়ে কিছু জানি না। আমি তো এক নগণ্য এমপি। আমাকে তো নোটিস বা ফোন দেওয়া হয়নি। যে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে শুনছি, সেটি প্রপার না।”
চুন্নুর এই অভিযোগের জবাবে কাদের বলেছিলেন, “আমরা ফোনে সংসদ সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছি। তারা সম্মতি দিয়েছে। লিখিত দিতে বলা হলে ১৫ জন সম্মতিপত্র দিয়েছে। ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন সম্মতি দিলে আর কিছু লাগে না। তাই অন্যদেরকে বলা হয়নি। এখন আরও অনেকে দিতে চাচ্ছে। প্রয়োজন নেই বলে নেওয়া হচ্ছে না।”
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অসুস্থ থাকা অবস্থায় গত এপ্রিলে তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেন।
১৪ জুলাই এরশাদ মারা যাওয়ার চারদিন পর, ১৮ জুলাই বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন।
তবে সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না দলের কো-চেয়ারম্যান ও এরশাদের স্ত্রী রওশন। রওশন অভিযোগ করেছিলেন, কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার আগে তার সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। আর জাতীয় পার্টির ‘ঘরোয়া বিবাদ’ দেবর-ভাবিই মিটিয়ে ফেলবেন বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন কাদের।
তবে সেই আশায় গুড়েবালি দিয়ে বৃহস্পতিবার পার্টির একাংশ সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) সকালে রওশন এরশাদের বাসায় এই সংবাদ সম্মেলনে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঘোষণা দেন, “রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থায়ী চেয়ারম্যান ঠিক করব।”
তিনি জানান, এরশাদের ভাই জি এম কাদেরকে ‘সম্মান দিয়ে’ দলের কো-চেয়ারম্যানের পদটি দেবেন রওশন।
এরপরই দলের বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে যারা চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেছেন, দলের ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী’ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন কাদের।
তার তিনদিন পর রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) পদ ভাগাভাগির ঘোষণার মাধ্যমে এই সংকটের আপাত সমাধান হল।
জাতীয় পার্টির অতীত
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসনের পর, ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এরশাদ।
এর মধ্যেই জেনারেল এরশাদ তার সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। যার পরিক্রমায় ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তবে সে নির্বাচন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ১৯৮৭ সালে দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে এরশাদ সংসদ ভেঙে দিয়ে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ ফের নির্বাচন দেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান সব বিরোধী দলই এ নির্বাচন বর্জন করে।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এরশাদের পতন হলে গ্রেপ্তার হন তিনি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। এর মধ্যেই ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৫ টি আসন পায় দলটি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩২টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয় জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে এসে নেতৃত্বের কোন্দলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়। দলটি তখন এরশাদ গ্রুপ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গ্রুপ ও নাজিউর রহমান মঞ্জু গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়।
২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে জোট গঠন নিয়ে নানা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত টানা তিনবারের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হন।
১৪ এপ্রিল জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান। এরপর থেকেই দলটিতে নেতৃত্ব নিয়ে তৈরি হয় নতুন সংকট।