চট্টগ্রামে পরীর পাহাড়ে ৩৫০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ
চট্টগ্রামের পরীর পাহাড়ে সম্প্রতি প্রায় ৩৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে, আইনজীবীদের চেম্বার হিসেবে নির্মিত পাঁচ ভবনও রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনের কারণে যেকোনো সময় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকায় উচ্ছেদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এছাড়া, পরীর পাহাডে অবৈধভাবে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির আরও দুটি ভবন নির্মাণ চেষ্টাকে না করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে ওই পাহাড়ে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ না করার নির্দেশনা দেন তিনি।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, ১৯৭৭ সালে যেসব শর্তে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিকে ১২ দশমিক ৯০ শতক জমি দেওয়া হয়েছিল, তারা সেসব শর্ত ভঙ্গ করেছেন। এমনকি জেলা প্রশাসনের অনুমতি না নিয়েই গত ৪৪ বছরে পাঁচটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আবারও নতুন দুটি ভবন নির্মাণের চেষ্টা করছে।
জেলা প্রশাসন আরও জানিয়েছে, আইনজীবী সমিতিকে যে জমি লিজ দেওয়া হয়েছিল, বর্তমানে এর দশগুণ বেশি জমি দখল করে আছেন তারা। এমনকি গত ৪৪ বছরে এসব জমির খতিয়ান সৃজন করেনি তারা, দেয়নি করও।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরীর পাহাড়ে বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ছাড়াও বেশ কিছু সরকারি কার্যালয় রয়েছে। এই পাহাড়ে আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য ইতঃপূর্বে খাস জমি দখল করে পাহাড়ি ঢালে পাঁচটি ভবন নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও এখানে প্রায় সাড়ে তিনশ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তালিকা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।"
৬০০ বছরের ইতিহাস ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে পরীর পাহাড়
আজ থেকে ৫০ বছর আগেও পরীর পাহাড় থেকে কর্ণফুলী নদী, বঙ্গোপসাগর উপকূলসহ দেখতে পাওয়া যেত পুরো চট্টগ্রাম। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই ৬০০ বছর আগে এই পাহাড়ে আস্তানা গাড়ে মগ জলদস্যুরা।
পলাশী যুদ্ধের ১৯ বছর পর ১৭৭৬ সালে বৃটিশ কর্মকর্তা ফ্রান্সিস লো চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করেন। সে সময় বৃটিশদের প্রধান প্রশাসনিক ভবন ছিলো মাদ্রাসা পাহাড়ে (বর্তমানে যেখানে হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ)। ১২৭ বছর আগে ১৮৯৪ সালে বৃটিশরা নগরের কেন্দ্রে অবস্থিত পরীর পাহাড়ে প্রশাসনিক কার্যালয় স্থানান্তর করে। শুরু হয় আদালত ভবনের কার্যক্রম।
কিন্তু গত চল্লিশ বছরে অবৈধভাবে পাহাড়ের কোল ঘেষে একের পর এক গড়ে ওঠা প্রায় সাড়ে তিনশ স্থাপনায় ঢেকে গেছে পরীর পাহাড়ের সেই 'চোখ'। সম্প্রতি এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এ তালিকায় রয়েছে আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য 'অবৈধ' ভাবে গড়ে তোলা পাঁচটি ভবনও।
বর্তমানে, পরীর পাহাড়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন এবং আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশ কিছু সরকারি কার্যালয় রয়েছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে আইনজীবীদের চেম্বারের চাহিদা মেটাতে বিদ্যমান আইনজীবী ভবন (মূল ভবন) ও শাপলা ভবনের পাশে আরও দুটি নতুন ভবন করার উদ্যোগ নেয় সমিতি। কিন্ত্ সেই ভবন নির্মাণে আপত্তি তোলে জেলা প্রশাসন। ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ঘোষণা দিয়ে ২ আগস্ট গণমাধ্যমে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে জেলা প্রশাসন ।
ফাটল ধরেছে ভবনে, যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাহাড়ে প্রায় সাড়ে তিনশ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই আইনজীবি ভবনে দেওয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ইমারত বিধি না মেনে এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার কারণে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, "আগস্ট মাসে পরীর পাহাড়ের বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করে দেখা গেছে পাহাড়ের ঢালে যেভাবে একের পর এক ভবন গড়ে তোলা হয়েছে তাতে ভূমিকম্প, ভূমিধস ও অগ্নিকাণ্ডের মত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় হতে পারে।"
তবে আইনজীবী অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ পরিষদের মুখপাত্র মো. ইকবাল হোসেন বলেন, "পরীর পাহাড়ে আইনজীবীদের কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। যেসব অবৈধ স্থাপনা আছে তা জেলা প্রশাসনের অধীনে। এর আগে জেলা প্রশাসন এই জমি মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংককে লিজ দিয়েছিলেন। সে সময় আইনজীবী সমিতির পদক্ষেপে জেলা প্রশাসন সেই লিজ বাতিল করতে বাধ্য হয়।"
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর সায়
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান জানান, "জেলা প্রশাসনের জায়গায় অনুমোদন ছাড়াই নতুন করে দুটি ভবন নির্মাণ চেষ্টাকে 'না' করে দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হলে তিনি তাতে সায় দেন।"
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ওই প্রস্তাবে হয়, "পরীর পাহাড়ে জেলা প্রশাসনের নামে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ১১.৭২ একর জায়গা রয়েছে। পাহাড় শ্রেণির ওই জমিতে ইতোমধ্যে স্থাপিত সম্পূর্ণ অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল স্থাপনাসমূহ অপসারণ করা প্রয়োজন। ওই পাহাড়ে আবারও অবৈধভাবে খাস জমি দখল করে কেউ যেন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।"
জেলা প্রশাসক বলেন, "রোববার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখা থেকে আইন ও বিচার বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়ে জানানো হয়। এই 'অনুশাসন' অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানাতেও বলা হয়েছে।"
ঝুঁকিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিডিএ ভবন
পরীর পাহাড়ের পাহাড়ের ঢালের নিচের জমিতে পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ভবন ও চট্টগ্রাম নিউমার্কেট অবস্থিত। এসব ভবনের ঠিক মাথার ওপর পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে আইনজীবীদের পাঁচটি ভবন। এ কারণে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক কী পয়েন্ট ইন্সটেলশন (কেপিআই) ভুক্ত একটি স্থাপনা। নীতিমালা অনুসারে 'ক' শ্রেণির কেপিআই'র আশেপাশে কোনো ধরনের বহুতল স্থাপনা করা যাবে না। তাই আইনজীবীদের এসব অবৈধ ভবন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও কাজ করছে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান জানান, "আইনজীবীদের জন্য নির্মিত পাঁচটি ভবনের চারটির অনুমোদন থাকলেও একটির নেই। এছাড়া বাকি ভবনগুলো বিধি মেনে তৈরি হয়েছিল কি না তাও খতিয়ে দেখবে সিডিএ।
অনুমতি নেই বঙ্গবন্ধুর নামে স্থাপনার
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির তাদের দুটি ভবন নির্মাণে "বঙ্গবন্ধু ভবন" নাম দিয়ে পত্রিকা দরপত্র আহবান করেছে।
কিন্তু জেলা প্রশাসন বলছে, এটি আইনজীবীদের কৌশল। কারণ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো স্থাপনা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে লিখিত অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি এই অনুমতি না নিয়েই পত্রিকা দরপত্র আহ্বান করেছে।
জানতে চাইলে আইনজীবী সমিতির সভাপতি এনামুল হক বলেন, "অনুমতি না পেলে বঙ্গবন্ধুর নামে ভবন হবে না।"
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ চান আইনজীবীরা
আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাবেক সভাপতি ও নগর কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর কথার পর আর কারও কথা থাকতে পারে না। তবে আমরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেলে আইনজীবীদের ভবনগুলো কীসের ভিত্তিতে নির্মাণ হয়েছে তা জানাতে চাই। এই লক্ষ্যে আমরা সকল দলিল-দস্তাবেজ মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।"
সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন বলেন, "আমরা বৈধভাবে দলিলমূলে আছি। এ ভবনসমূহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুদানে এবং সমিতির নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত।"
আইনজীবি সমিতির সভাপতি এনামুল হক বলেন, "পরীর পাহাড়ে আইনজীবীদের ভবন নির্মাণের জায়গা ১৯৭৭ সালে সরকার থেকে লিজ নেওয়া। এটা নিয়ে আদালতের ডিগ্রিও আছে। সাবেক এডিসি ইলিয়াস সাহেব নিজে আমাদের এই জমি নির্ধারন করে দিয়েছেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) অনুমোদন নিয়ে গত ৪০ বছর ধরে ধাপে ধাপে এসব ভবন হয়েছে।"