নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের পুনরায় রপ্তানিতে দীর্ঘ অপেক্ষা
সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়ে বাংলাদেশ থেকে পান আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও পুনরায় পণ্যটির রপ্তানি শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র ও বাংলাদেশ ফ্রুট, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ) এর কর্মকর্তা ও রপ্তানিকারকদের দাবি, ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সালমোনেলা মুক্ত পান উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এখনো তা রপ্তানির অনুমতি পাওয়া যায়নি।
সেক্টর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি পণ্য রপ্তানি আয়ের ৬০ ভাগেরও বেশি আসে ইউরোপ থেকে। যে কারণে সেখানে পণ্য পাঠাতে হলে মানের বিষয়ে সবসময় খেয়াল রাখতে হয়। গুণগত মান ধরে রেখে পণ্য উৎপাদনে এখনো বাংলাদেশ খুব বেশি আগাতে পারেনি। যে কারণে কোন পণ্যের ওপর একবার নিষেধাজ্ঞা এলে সেটিকে নতুন করে আবার রপ্তানি পর্যন্ত নিয়ে যেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া মধ্যস্ততার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের দুর্বলতা রয়েছে বলে দাবি করেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানিকারকরা বলেন, ইউরোপের বাজারে রপ্তানি ধরে রাখতে হলে, জোন ভিত্তিক পণ্যের চাষাবাদ জরুরি। এছাড়া কৃষক ও পরিদর্শকের প্রশিক্ষণ, রপ্তানিকারকের প্রশিক্ষণ, কীটনাশকের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে জানা ও এর প্রয়োগ, সরকারি দপ্তর থেকে দ্রুত রপ্তানির সার্টিফিকেট পাওয়া, মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কৃষি কাজে ব্যবহার করা পানির পরীক্ষা, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, পণ্য উত্তোলনের পর দ্রুত রপ্তানির ব্যবস্থা করা, বিমানবন্দরের কাছাকাছি জায়গায় প্যাকিং করা জরুরী।
ল্যাবরেটরি নিয়েও রপ্তানিকারকদের যথেষ্ট ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কারণ কৃষি পণ্যের ব্যকটেরিয়াল বা কীটনাশকের রেসিডিউ এর যেসব পরীক্ষা করতে হয় সেগুলোর জন্য যথেষ্ট অ্যাক্রিডিটেডেড ল্যাব নেই। এজন্য ভোগান্তির পরিমাণ আরও বেশি।
বিএফভিএপিইএ এর উপদেষ্টা ও কৃষিবিদ মো. মনজুরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ক্রেতারা কীটনাশকের রেসিডিউ পণ্যে আছে কিনা তার ল্যাব পরীক্ষার রেজাল্ট চান। তথন আমাদের বারিতে (বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউ) যেতে হয়, পরীক্ষা করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে পণ্যেও মান কমে যায়।'
তিনি বলেন, 'আমাদের অনেক দিনের দাবি একটা অ্যাক্রিডেটেড ল্যাব করে দেওয়া যেখান থেকে আমরা সহজেই সব পণ্যের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে পারবো। এতে করে পণ্য পাঠানোর পর সমস্যা হওয়ার সুযোগ কম থাকে'।
জানা গেছে, কৃষিপণ্য রপ্তানির বেশিরভাগই হয় আকাশপথে। যা মূলত ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই পাঠানো হয়। কিন্তু পণ্যের সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ শ্যামপুরে অবস্থিত। ঢাকার রাস্তার যে অবস্থা তাতে পণ্য একবার এনে শ্যামপুরে রেখে, প্যাকিং করার পর কয়েক ঘন্টা সময় নিয়ে বিমানবন্দর নিয়ে যাওয়ারও বড় সমস্যা তৈরি হয়।
মো. মনজুরুল ইসলাম দাবি করেন, এই সুবিধাগুলো দিলে খুব দ্রুতই আমাদের রপ্তানি তিন চার গুণ বাড়ানো সম্ভব হবে।
পান রপ্তানির বিষয়ে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ল্যাবরেটরী টেষ্ট, জোনভিত্তিক পণ্য উৎপাদন, কৃষক নির্বাচন, কৃষক ও রপ্তানিকারকের প্রশিক্ষণ, সয়েল টেস্ট, ইরিগেশন ওয়াটার টেষ্ট, উৎপাদন পরিস্থিতি মনিটরিং, ফিল্ড ইন্সপেকশন এন্ড মনিটরিং, সার্টিফিকেশনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট ২২ ধরনের শর্ত পূরণ করা হয়েছে। সব আপডেট তাদেরকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো পান রপ্তানি অনুমতি পায়নি বাংলাদেশ।
বিএফভিএপিইএ সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বারবার তাগাদা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে রপ্তানি শুরু হতে এত বছর লাগছে। এছাড়া পুনরায় রপ্তানির জন্য যেসব শর্ত পূরণ করার কথা বলা হয়েছিল সেগুলোও অনেক সময় সাপেক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সামছুল আলম বলেন, 'পান রপ্তানি উন্মুক্ত করতে প্রতিনিয়তই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আমরা তাগাদা দিচ্ছি। ওরাও অনুমতি দিবে, দিচ্ছে করে সময়ক্ষেপন করছে।'
জানা গেছে, সমস্যা সমাধান করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে কিছু নির্দেশনা প্রদান করে। এই নির্দেশনাগুলো পূরণ হয়েছে কি না তা জানাতে চাইলে তাদের দেয়া ২২ দফা শর্ত পূরণের বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়। তথ্যগুলো জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ গত বছরের ৩১ আগষ্ট চিঠি দেয়া হয়।
কৃষিপণ্যের রপ্তানিকারক নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটা নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। সেগুলো মেনে পণ্য পাঠাতে না পারলেই সমস্যা হয়। এর জন্য আমাদের আরও অনেক প্রস্তুতির দরকার। যে কারণে কোন পণ্যের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এলে সেটার ওপর আবার অনুমতি পেতে অনেক কাজ করতে হয়।'
তিনি বলেন, 'পানের একটি বড় বাজার ছিল ইউরোপে। যেটা আমরা হারিয়েছি এবং এ বাজার ফিরে পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে'।
জানা গেছে, এর প্রভাব ব্যাপকভাবেই পড়েছে কৃষিপণ্যের মোট রপ্তানিতে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১২-১৩ সালে পান রপ্তানি হয়েছিল ৩৮.১ মিলিয়ন ইউএস ডলার। যা পরের বছর নেমে আসে ২৯.৪৮ মিলিয়ন ডলারে। এর পর থেকে প্রতি বছর যেটুকু করে রপ্তানি হয়েছে তার সবটুকুই মধ্যপ্রাচ্যে। তবে এর পরিমান খুবই সামান্য। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে পান রপ্তানি নেমে এসেছে ১.৯৮ মিলিয়ন ডলারে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের মোট রপ্তানি ছিল ২০৯.২৯ মিলিয়ন ডলার। যা পরের বছর নেমে আসে ১৪১ মিলিয়ন ডলারে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ সালে রপ্তানি হয়েছে ১৬৪.৫ মিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য। বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইউরোপে, এরপরের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিভিন্ন পণ্যের ওপর বেশিরভাগ সময় নিষেধাজ্ঞা আসে ইউরোপের দেশগুলো থেকে। কারণ এই দেশগুলো প্রতিনিয়ত পণ্য পরীক্ষা করে। পণ্যের মানে সামান্য পরিমাণ সমস্যা পেলেই আমদানি বন্ধ করে দেয়। কোন ছাড় দেয় না।
এর আগে বাংলাদেশ থেকে সীডলেস লেবুর আমদানি বন্ধ করে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। লেবুতে ক্যাঙ্কার নামক ব্যাকটেরিয়া এবং কিছু ফাংগাল ডিজিস এর উপস্থিতি পাওয়ায় বাংলাদেশের সীডলেস লেবুর ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। যা দূর করে দীর্ঘ ৭ বছর পর পুনরায় শুরু হয়েছে এই লেবুর রপ্তানি।
জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কীটনাশকের প্রভাব, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমন রয়েছে কি না তা বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করে থাকে।