জামদানি, বেনারসি ও কাতান শাড়ির দাম পাচ্ছেন না তাঁতীরা
গাজীপুরের টঙ্গীর গুটিয়া এলাকায় হাতে গোনা কয়েক ঘরে কর্মরত তাঁত শিল্পীদের নিপুণ হাতের কর্মকুশলতায় তৈরি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের বড় চিহ্ন জামদানি, বেনারসি শাড়ি। তবে সুতার দাম বৃদ্ধি, ভারতের শাড়ির অবাধ প্রবেশের কারণে বর্তমানে হুমকির মুখে এই শিল্প। সরকারি প্রণোদনা ও কারিগরি সহযোগিতা না পেলে অচিরেই গুটিয়া থেকে এই তাঁতশিল্প হারিয়ে যাবে চিরতরে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের শাড়ির অবাধ প্রবেশ ও বিক্রির কারণে তাঁতশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে- স্বীকার করে বিসিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ শিল্প রক্ষায় এ খাতে আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা তাদের বিবেচনায় রয়েছে।
জামদানি, বেনারসি শাড়ি বুননে মাত্র তিনশ ঘর তাঁতি এখনো টিকে আছেন গাজীপুরের গুটিয়া এলাকায়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গীর সাতাইশ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ছায়া সুনিবিড় সবুজ এলাকায় গুটিয়া। এলাকায় প্রবেশ মুখে পা দিতেই কানে ভেসে আসে ঐতিহ্যমণ্ডিত তাঁত যন্ত্রের খট-খটা-খট শব্দ। এক সময় এ এলাকায় অন্তত ২ শতাধিক কারখানায় ১২শ'র বেশি তাঁতকল ছিল। সে সময় জামদানি শাড়ির বাণিজ্যটাও ছিল রমরমা। কিন্তু ভারতের শাড়ির অবাধ প্রবেশ, শিল্পায়ন, সুতার দাম বৃদ্ধি এবং শ্রমিক সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় এ শিল্প এখন বন্ধের মুখে।
তবু জামদানি ঐতিহ্যের শেষ স্মারক হিসেবে এই এলাকাতেই উৎপাদিত হচ্ছে জামদানি, কাতান ও বেনারসি শাড়ি।
শ্রম মজুরি নিয়ে তাঁতশিল্পীদের আক্ষেপ থাকলেও তাদের শ্রম, ঘাম ও নিপুণ কর্মকুশলতায় সৃষ্ট শাড়ি জামদানি, বেনারসি ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁত কারিগররা বলছেন, সারা সপ্তাহে মাত্র ৩-৪টি শাড়ি তৈরি করতে পারেন তারা। এতে যে আয় হয়, তা নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন।
এই এলাকায় বেনারসি কারিগর হিসেবে কাজ করছেন শেরপুরের মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, 'ভারতের যে শাড়িগুলো আসে, সেগুলো না এলে দেশে জামদানি, বেনারসির চাহিদা থাকত। আগের তুলনায় এসব শাড়ির চাহিদা এখন তেমন নেই। এ কারণে আমরা তেমন মজুরি পাই না। মাসে যে পরিমাণ মজুরি পাই, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না।'
গুটিয়া এলাকায় গত ৩০ বছর ধরে তাঁতের কাজ করছেন জানা মিয়া। কারখানার পাশেই ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে তার বসবাস। তিনি বলেন, 'আগে জামদানি, বেনারসি বুনে বেশ সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেছে। বাজারে চাহিদা ভালো ছিল। এখন বাজার মন্দা, মহাজন সুবিধা করতে পারছেন না। ফলে এই এলাকার অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কমে গেছে তাঁতির সংখ্যা। এই অবস্থায় বর্তমানে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে আমাদের।'
আরেক কারিগর দুলাল মিয়া জানান, প্রতি পিস শাড়িতে তিনি ৭০০ টাকা মজুরি পান। একটি শাড়ি তৈরিতে মজুরিসহ খরচ হয় ১২০০-১৬০০ টাকা। মানভেদে এসব শাড়ি বাজারে বিক্রি হয় ১৬০০-২৩০০ টাকা। সুতার মূল্য বৃদ্ধি এবং ক্রমাগত লোকসানের কারণে প্রতিবেশীরা বেনারসি ও জামদানি তাঁত বন্ধ করে দিচ্ছেন। সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতাই করা হয় না। সরকারি পর্যায়ের কেউ কোনোদিন খোঁজও নেয় না। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই হয়তো অবশিষ্ট তিন ঘর তাঁতও বন্ধ হয়ে যাবে।
সুতার দাম বেশি এবং ভারত থেকে নানাভাবে আসা শাড়ি এখন অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে। বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না জামদানি ও বেনারসি শাড়ি। চলতে না পেরে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে; অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন আদি পেশা।
এ বিষয়ে কারখানা মালিক আব্দুল কাদের জানান, তার কারখানায় সপ্তাহে ৩০-৪০টি বেনারসি, কাতান শাড়ি তৈরি হয়। এসব শাড়ি রাজধানীর মিরপুরসহ সারা দেশে বিক্রি হয়। তবে জামদানি, বেনারসি ও কাতান শাড়ির চাহিদা আগের তুলনায় কমে গেছে। 'সুতা খারাপ থাকলেও ভারতের শাড়ির দাম কম থাকায় জনসাধারণ ওই শাড়িই কিনছে বেশি। আর আমাদের সুতা ভালো এবং অপেক্ষাকৃত দাম বেশি হওয়ায় বাজারে মন্দাভাব রয়েছে বেনারসি ও কাতান শাড়ির। ফলে আমরা উচিত মূল্য পাচ্ছি না। এ খাতে সরকার যদি সাহায্য করে, তাহলেই তাঁতশিল্প টিকে থাকবে,' বলেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রয়োজনীয় বাজার মূল্য না পেলেও শুধু ঐতিহ্যপ্রীতি ও পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া তাঁতশিল্পের কারণেই কয়েকজন মালিক এখনো তাঁতকল চালু রেখেছেন।
ভারতের শাড়ির অবাধ প্রবেশ ও বিক্রির কারণে দেশীয় তাঁতশিল্প টিকতে পারছে না- স্বীকার করে গাজীপুর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের (বিসিক) সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জহুরা ফাতেমা বলেন, 'বিসিকের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে। সেসব প্রশিক্ষণের আওতায় তাঁত কারিগরদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বিসিক নিজস্ব কর্মসূচির আওতায় এবং কর্মসংস্থান ব্যাংকের সহায়তায় আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। তাঁতশিল্পে জড়িতদের তাদের চাহিদা মাফিক আমরা আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করব।'