টিকা নিবন্ধনের ভোগান্তিতে প্রবাসীরা
অভিবাসী কর্মীরা, বিশেষত যারা সৌদি আরব এবং কুয়েত প্রবাসী, কোভিড-১৯ টিকার নিবন্ধনের জন্য তাদের অশেষ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
রোববার পর্যন্ত বিদেশগামী প্রায় ৮২ হাজার শ্রমিক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন, কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য জেলার কয়েকশত অভিবাসী 'আমি প্রবাসী' অ্যাপে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে সমস্যায় পড়েছেন।
এদিকে সৌদি আরব ও কুয়েতগামী যেসব কর্মী টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন তাদের একটি অংশ নিজের তথ্য ভুল দিয়েছেন। এতে করে সেসব কর্মীদের টিকা পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিকের চাপের কারণে অ্যাপটির সার্ভারে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাই নিবন্ধন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সন্দ্বীপের সৌদি প্রবাসী নুরুল আলম (৪০) ২০২০ সালের শেষ দিকে দেশে আসেন । ছয়মাসের ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে আকামাও বাতিল হয়ে গেছে তার। আড়াই লাখ টাকা ব্যয় করে নতুন আকামা নিয়েছেন সেটারও মেয়াদ শেষ দিকে। তাই হন্য হয়ে টিকার নিবন্ধন করাতে ৩ জুলাই জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে ছুটে এসেছিলেন তিনি।
আটদিন পর গতকাল নুরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চট্টগ্রাম শহরে আসতে হলে সাগর পাড়ি দিতে হয়। তাই 'আমি প্রবাসী' অ্যাপে আবেদন করেছিলাম।৭২ ঘন্টার মধ্যে মেসেজ দেওয়ার কথা থাকলেও ১২০ ঘন্টা পরেও কোনো মেসেজ পাইনি।"
"বিকল্প না পেয়ে এই দুর্দিনেও জনশক্তি অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কাগজ জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেও এক সপ্তাহ আগের কথা। আমি এখনো সুরক্ষা অ্যাপসে রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। যদি কখনো রেজিস্ট্রেশন হয়ও, তবে টিকা নিতে যেতে হবে ঢাকায়। প্রবাসীরা কি পাপ করেছে, যে তাদের এত ভোগান্তি পোহাতে হবে?," বলেন নুরুল আলম।
বিএমইটি'র মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম, এনডিসি বলেন, "আমাদের সার্ভারে একদিনে মোট ১৫০০০ নিবন্ধনের সক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রতিদিন এর চাইতে কয়েকগুণ বেশি বিদেশগামী কর্মী আবেদন করছেন। ফলে এটি একধরণের যান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করছে। অনেকে সার্ভারে ঢুকতে পারছেন না।"
"এ পর্যন্ত যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদের মধ্য থেকে সৌদি ও কুয়েতগামীদের ২০০০ জনকে প্রতিদিন ঢাকায় ফাইজারের টিকা দেয়া হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
যেসব বিদেশগামী কর্মী 'আমি প্রবাসী' অ্যাপে নিবন্ধন করতে গিয়ে ভুল করেছেন, তাদের বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দেখা হচ্ছে। সেসব বিদেশগামীদের পুনরায় একটি আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে বলা হয়েছে।
তবে অনেক বিদেশগামী কর্মী বলছেন, তাদের সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করতে গিয়ে ভুল হয়েছে। কেউ কেউ ভুলে তাদের টিকাদান কেন্দ্র নিজ উপজেলায় দিয়েছেন। কিন্তু তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ফাইজারের টিকা না পেলে কর্মস্থলে যেতে পারবেন না। এতে তারা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।
সরকারের সুরক্ষা অ্যাপটি কোভিড-১৯ টিকার নিবন্ধনের উদ্দেশ্যেই তৈরী করা এবং এটি আইসিটি বিভাগ দ্বারা পরিচালিত।
বিএমইটির ডাটাবেজে নিবন্ধিত কর্মীগণ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রাপ্তির লক্ষ্যে সুরক্ষা অ্যাপ বা www.surokkha.gov.bd এর মাধ্যমে জরুরিভাবে টিকা গ্রহণের জন্য নিবন্ধন করতে পারবে । সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন সফল হলে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে টিকাকেন্দ্র ও টিকার তারিখ জানা যাবে।
গভীর সংকটে চট্টগ্রামের অভিবাসীরা
এদিকে চট্টগ্রামের প্রবাসীরা কখন টিকা পাবেন তা বলতে পারছেন না খোদ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস বা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কেউই।
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস থেকে ডাটা পেলেই তা সুরক্ষা অ্যাপসে আপলোড করা হচ্ছে। এরপরেই প্রবাসীরা টিকা পাবেন। তাই প্রবাসীরা কখন টিকা পাবেন বিষয়টি জনশক্তি অফিসের উপর নির্ভর করছে। এছাড়া যারা সৌদি আরব ও কুয়েত যাবেন, তাদের ঢাকায় গিয়ে ফাইজারের টিকা নিতে হবে।"
"শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের সব এলাকার প্রবাসীদের ফাইজারের টিকা নিতে হলে ঢাকা যেতে হবে। কারণ টিকা সংরক্ষণে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। যা ঢাকার বাইরে আর কোথাও নেই," বলেন সিভিল সার্জন।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল আলম মজুমদার বলেন, "বিভিন্ন এলাকার প্রবাসীদের প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য দিন তারিখ ঠিক করে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তারা সবাই একসাথেই চলে আসছেন। তবুও আমরা কাউকেই ফিরিয়ে দিচ্ছি না। একসঙ্গে অনেকের ডাটা এন্ট্রি করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। আমাদের ডাটা এন্ট্রি শেষ হলেই, সুরক্ষা অ্যাপসে সেই ডাটা ইনপুট দেওয়া হবে। তাই নিবন্ধনকারীদের সবার ডাটা এন্ট্রি কবে শেষ হবে তা এখনি বলা যাচ্ছে না।"
সৌদি প্রবাসি বাঁশখালীর বাসিন্দা মো. সেলিম বলেন, "৫ তারিখে আমি ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে আবেদন সম্পন্ন করেছি। হাসপাতাল থেকে এখনো মেসেজ আসছে না।"
এদিকে প্রবাসীদের জন্য গত মঙ্গলবার থেকে ফাইজার টিকা দেওয়া শুরু হলেও তা নিতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজধানীতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে।
ফাইজারের টিকা নিতে ঢাকায় অবস্থান করা বোয়ালখালীর বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, "সুরক্ষায় নিবন্ধন করেই টিকার জন্য গত বৃহস্পতিবার আমি ঢাকা চলে আসি। এ জন্য লকডাউনে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু চারদিনেও এসএমএস না পাওয়ায় টিকা নিতে পারছিনা। এখন বুঝতে পারছিনা আমি ঢাকা থাকবো নাকি চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে এসএমএসের অপেক্ষা করবো?"
আনোয়ারার ওমান প্রবাসী সৈকত বড়ুয়া জানান, গত ২৪ এপ্রিল থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশিসহ ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকদের ওমানে প্রবেশে সম্পূর্ণরূপে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ কারণে কোভিশিল্ডের দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেও তিনি প্রবাসে ফিরতে পারছেন না।
ফটিকছড়ির কুয়েতপ্রবাসী মো. রুবেল পড়েছেন নতুন বিড়ম্বনায়। তিনি গণটিকার প্রথম দফায় অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ডের দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেন। কিন্তু সম্প্রতি কুয়েত সরকার সেদেশে প্রবেশের জন্য ফাইজারের টিকা বাধ্যতামূলক করেছে। এ কারণে এখন তার কুয়েত ফেরা পুরোপুরি অনিশ্চিত।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বলেন, "সঠিক তথ্য না জানায় প্রবাসীদের অনেকে টিকা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন। সৌদি ও কুয়েত প্রবাসীদের ঢাকার সাতটি হাসপাতালে টিকা দেওয়া হচ্ছে. অনেকে সুরক্ষা রেজিস্ট্রেশন করেই ঢাকার হাসপাতালে ভিড় করছেন। আমি প্রবাসী ভাইদের বলব তারা শুধুমাত্র এসএমএস পেলেই নির্ধারিত টিকাকেন্দ্রে এসে টিকা নেবেন।"