টিকা সংকটে ছয় দিনের টিকা কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে এলো বাংলাদেশ
সব প্রস্তুতি শেষ হলেও ভ্যাকসিন সংকটের কারণে সরকারের কোভিড-১৯ বিশেষ টিকাভিযান শুরুর মাত্র দুই দিন আগে হঠাৎ করেই এ কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনে সরকার। ৬ দিনের পরিবর্তে আপাতত শুধু ৭ আগস্ট ক্যাম্পেইন করে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এরপর এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট থেকে আবার এ বিশেষ অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এনিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেছেন, টিকা ও জনবল সংকট বিশেষ কর্মসূচি চালানোর ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। একটানা সপ্তাহব্যাপী ভ্যাকসিন দেওয়ার দক্ষ জনবল ও টিকা আমাদের নেই। যদি অনেক টিকা পাওয়া যায়, তাহলে অন্য কাজ বন্ধ রেখে হলেও টিকা দেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে এখন সিনোফার্মের ৪৮.৯৬ লাখ ও মর্ডানার ৪৪.৮৪ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন রয়েছে। বিশেষ টিকাভিযানে শহরে মর্ডানা ও গ্রামে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলের ১৩,৮০০ ওয়ার্ডে চারদিনে এক কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার ডোজ, সিটি করপোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ৬ দিনে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ ডোজ এবং পৌরসভার ১,০৫৪ টি ওয়ার্ডে ৪ দিনে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ২০০ ডোজ দেওয়া হবে বিশেষ টিকাভিযানে।
অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, আমাদের হাতে সব মিলিয়ে এক কোটির বেশি টিকা আছে। কিন্তু আমরা তো সব টিকা সবখানে দিতে পারছি না। মর্ডানার টিকা হাতে আছে, কিন্তু সংরক্ষণ জটিলতার কারণে এই টিকা গ্রাম পর্যায়ে দেওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, "এই প্ল্যান সব সময় ভাইব্রেন্ট। এই প্ল্যান সব সময় বাড়ানো-কমানো, অ্যাডিশন করা হবে। মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা আমলে নিয়ে প্ল্যান বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা হচ্ছে। কার কোথায় চ্যালেঞ্জ- তা জেনে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কারণ, কাজটা শুরু করে তো ফেরত আসা যাবেনা। সবকিছু যেন নিখুত হয়- সেজন্য প্ল্যানে পরিবর্তন করা হয়েছে।"
সিটি করপোরেশনে টিকাদানে জনবল চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে মহাপরিচালক বলেন, "শহরে নার্সদের দিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, সেখানে জনবলের সমস্যা নেই। গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন হেলথ সেন্টার ও স্বাস্থ্য সহকারীরা আছে। কিন্তু, সিটি করপোরেশনের টিকাদান চ্যালেঞ্জ। সিটি করপোরেশনে আরবান হেলথ স্ট্রাকচার নেই। তাই এখানে অতিরিক্ত লোকবল দিতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশনে এক্সট্রা সেন্টার করতে হাসপাতাল থেকেও কর্মী নিয়ে যেতে হচ্ছে।"
সরকারের বিশেষ কোভিড-১৯ টিকাভিযানের বিষয়ে শুক্রবার সকাল ১১টা প্রেস ব্রিফিং করে বিস্তারিত জানাবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৭ আগস্ট দেশের ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডে এক সেশনে দেওয়া হবে প্রথম ডোজ। শনিবার এক দিনে সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তিনটি কেন্দ্রে ২০০ জন করে ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। এরপর সাত দিন এই কর্মসূচি বন্ধ থাকবে। শনিবার শুধু বয়স্ক, অগ্রাধিকার পাওয়া প্রতিবন্ধী ও অসুস্থদের টিকা দেওয়া হবে। সেদিন ক্যাম্পেইনের আওতায় ৩২ লাখ মানুষ ভ্যাকসিন পাবেন।
৭ তারিখের ক্যাম্পেইনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও নিবন্ধন ছাড়া কাউকে টিকা দেওয়া হবেনা বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব:
কর্মসূচি শুরুর আগেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় কৌশলগত পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল- বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "করোনা মহামারির শুরু থেকে পরিকল্পনায় ম্যাচিউরিটির পরিচয় দেয়নি সরকার। গণটিকা একটি বড় কর্মকান্ড এর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার দরকার আছে। এক সপ্তাহে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার, সে হিসেবে পরের মাসেও সেই এক কোটি ডোজ টিকা দিতে হবে। তার মানে এখন যে পরিমাণ টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- তার এক মাস পর আবার সেই পরিমাণ টিকা হাতে থাকতে হবে। সেটা কিন্তু হাতে নেই।"
তিনি আরও বলেন, "সরকারের এখন একদিন ক্যাম্পেইন করে টিকা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। টিকা দেওয়ার পর ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ভিত্তিতে আগামী মাসের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। সেকেন্ড ডোজ ভ্যাকসিন স্টোরে রাখার পর ক্যাম্পেইন শুরু করা উচিৎ।"
জেলা পর্যায়ে টিকাকরণ পরিকল্পনা পরিবর্তন:
সাতক্ষীরায় পৌঁছেছে সিনোফার্মার ৫১ হাজার ২০০ ডোজ টিকা। গণটিকা কর্মসূচীর পরীক্ষামূলক প্রচারণা করা হবে আগামী ৭ আগষ্ট। তবে ৭-১২ আগষ্ট পর্যন্ত ইউনিয়ন পর্যায়ে যে গণটিকার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল- সেটির দিনক্ষণ পিছিয়ে ১৪-১৯ আগষ্ট করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে মুঠোফোন বার্তার মাধ্যমে সিভিল সার্জনকে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত জানান, "জেলার ৭৮টি ইউনিয়নে পরীক্ষামূলক প্রচারণা হিসেবে ৭ আগষ্ট প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ৬০০ ডোজ করে টিকা দেওয়া হবে। জেলায় ৫১ হাজার ২০০ করোনা ভ্যাকসিনের সিনোফার্মার টিকা সাতক্ষীরায় এসেছে। পরবর্তীতে আরও আসবে। প্রত্যেকটি টিকা ক্যাম্পে ছয়জন প্রশিক্ষিত ভ্যাস্কিনেটর ও স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন নয় জন। গণটিকার কার্যক্রমে জনবলের স্বল্পতা নেই তবে টিকার স্বল্পতা রয়েছে।"
টিকার স্বল্পতার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গণটিকাদান ক্যাম্পেইন সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। প্রচারণার মাধ্যমে আগে পৌনে দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও, এখন মাত্র ৬১ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এজন্য জেলার ৯৮টি ইউনিয়নে হচ্ছে অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র। কেন্দ্র সুপারভাইজার ও টিকাদানকর্মীদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিশেষ টিকাভিযানের জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। কিন্ত্ তিনদিনের ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য চাহিদা অনুযায়ী টিকা মজুদ নেই। সেজন্য কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। একদিনের কর্মসূচিতে আমরা ৬১ হাজার মানুষকে টিকা দেব। তবে আমাদের কাছে মজুদ আছে ৪৩ হাজার ডোজ টিকা। আজ (বৃহস্পতিবার) আরও ৪৫ হাজার ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে। আশা করছি, কোনো সমস্যা হবেনা। পরবর্তীতে টিকাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ১৪ আগস্ট থেকে ক্যাম্পেইন আবার শুরু হতে পারে।"
আগামী শনিবার নোয়াখালী সদর ও চৌমুহনী পৌরসভা ছাড়াও ৯১টি ইউনিয়নে টিকাদান কর্মসূচি চলবে। টিকাদান চলবে ২৯১টি বুথে।
নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জানান, "৭ তারিখের কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে আমরা পরবর্তী কাজ শুরু করবো। আগামীতে টিকা দান কর্মসূচি সফল করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক কেন্দ্র প্রস্তুত, জনবলও রয়েছে। কোন কিছুর সংকট নেই। আমরা নির্দেশ পাওয়ার পর টিকাদান শুরু করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।"