গবেষণা নয়, ডাকসু নির্বাচনের জন্যই রাব্বানীকে নিয়ম ভেঙে এমফিল-এ ভর্তির সুযোগ!
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেবার সুযোগ করে দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষ আনুকুল্য দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মার্চে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের কিছু দিন আগে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব দিতে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু নিয়ম ভঙ্গ করেছেন বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবার পূবশর্ত হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া।
রাব্বানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আইন বিভাগে পড়াশোনা করেছেন একসময়। ২০০৭-২০০৮ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১১ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি।
এর আট বছর পর, এ বছরের শুরুতে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের এমফিলের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হোন তিনি।
এই ভর্তিপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তিনি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমানের আনুকূল্য পেয়েছিলেন।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেকটি থিসিস প্রস্তাবনা পাঁচটি ধাপে অনুমোদিত হবার পরই প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল গবেষক হিসেবে ভর্তির সুযোগ পান।
এই প্রক্রিয়ার শুরু নির্দিষ্ট বিভাগের সকল শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত অ্যাকাডেমিক কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে। এরপর তা সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনের সভাপতিত্বে সকল বিভাগের চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপকদের সমন্বয়ে অনুষদ সভায় উত্থাপিত হয়।
সেখানে পাশ হলে প্রস্তাবনাটি বোর্ড অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজে পাঠানো হয়। এই বোর্ডে উপাচার্যের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকরা থাকেন।
এরপর তা পাঠানো হয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে। উপাচার্যের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, সকল বিভাগের চেয়ারম্যান, ডিন, পরিচালক এবং অধ্যাপকরা এই কাউন্সিলের সদস্য।
কাউন্সিলে প্রস্তাবনাটি পাশ হলে তা পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে।
এই পাঁচটি ধাপের মধ্যে থিসিস প্রস্তাবনাটির খুঁটিনাটি যাচাইয়ে প্রধান ভূমিকা রাখে অনুষদ সভা।
রাব্বানীকে ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে অনুষদ সভা এবং বোর্ড অব অ্যাডভান্স স্টাডিজের বৈঠক—এ দুটি ধাপ এড়িয়ে যান অপরাধ বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া।
রাব্বানীর ভর্তির ক্ষেত্রে যাবতীয় অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "ভর্তিপ্রক্রিয়ার নিয়ম-কানুনে ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। সবকিছুই নিয়মের মধ্যে করা হয়েছে।"
তবে অধ্যাপক জিয়া বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির বৈঠকে রাব্বানীর থিসিস প্রস্তাবনাটির অনুমোদন দেওয়া হলেও অনুষদ সভায় তা পাঠানো হয়নি।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যায় যুক্তি তুলে ধরেন এভাবে: "সময়-স্বল্পতার কারণে আমরা থিসিস প্রস্তাবনাটি অনুষদ সভায় জমা দিতে পারিনি। হ্যাঁ, এটা নিয়মের লঙ্ঘন; তবে অবৈধ নয়।"
তিনি আরও বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম বহু ঘটনা আছে যেখানে অনুষদ সভার অনুমতি ছাড়াই থিসিস প্রস্তাবনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।"
ওদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সূত্রগুলো বলছে, বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের বৈঠকের সময় এবং আলোচ্য বিষয়সূচি বৈঠকের আগের দিনই চূড়ান্ত হয়।
জানুয়ারি মাসে বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের যে বৈঠক হয়েছে সেখানে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কোনো এমফিল প্রস্তাবনা ছিল না। ওই বৈঠকের দুদিন পর বিকাল ৩টায় একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক শুরু হলে উপাচার্য একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে ডেকে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাঠানো তথ্য বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে যোগ করে নিতে বলেন।
সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র বলছে, এরপর ওই কর্মকর্তা অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাঠানো পাতাটি প্রিন্ট করে নেন। সেখানে এমফিল ভর্তিচ্ছু হিসেবে গোলাম রাব্বানী এবং আরও তিন জনের নাম লেখা ছিল।
এরপর উপাচার্য বৈঠকে প্রস্তাবনাটি পাশ করে দেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার জামাল আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এই ডকুমেন্ট আসে। আমাদেরকে বলা হয়, এটার এক কপি প্রিন্ট দিয়ে তা সভার আলোচ্যসুচির সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। যেভাবে বলা হয়েছিল, আমরা সেভাবেই করেছি।"
পুরো ঘটনা যেভাবে ঘটেছে
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ২০১৮-১৯ সেশনে এমফিল ভর্তিচ্ছুকদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
১০ অক্টোবর ছিল দরখাস্ত জমা দেবার শেষ তারিখ।
যেসব আবেদন জমা পড়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে চূড়ান্তভাবে কয়েকটি বেছে নেবার জন্য এ বছরের জানুয়ারিতে বিভিন্ন অনুষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত একটি বিভাগ। এ অনুষদের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৬ জানুয়ারি। তবে সে সভায় অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো এমফিল প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, বোর্ড অব এডভান্সড স্টাডিজের সভা অনুষ্ঠিত হয় ২২ জানুয়ারি। আর ২৪ জানুয়ারি একাডেমিক কাউন্সিলের সভা বসে।
এরই মধ্যে, ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় ১১ মার্চ।
নির্বাচনে গোলাম রাব্বানীর প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান রাব্বানীর থিসিস প্রস্তাবনাটির অনুমোদন দেন।
ফলে রাব্বানী ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কাঙ্ক্ষিত ছাত্রত্বের অধিকারী হোন।
বিষয়টি নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড টিম সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, গোলাম রাব্বানীর থিসিস প্রস্তাবনাটি অনুষদের সভায় উত্থাপিত হযনি।
তিনি জানান, "অনুষদ সভায় উত্থাপিত না হলে কোনো থিসিস প্রস্তাবনারই অনুমোদন পাবার কথা নয়। কিন্তু আমি জানি না কীভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছেন।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামাদ (প্রশাসন) জানান, অনুষদ সভায় যে কোনো থিসিস প্রস্তাবনার অনুমোদন নিতেই হবে।
"বিশ্বাস করতে পারছি না যে, যে থিসিস প্রস্তাবনা অনুষদ সভায় অনুমোদিত হয়নি সেটি কীভাবে সিন্ডিকেটের সভায় অনুমোদন পেল। এ ধরনের অভিযোগ থাকলে তা নিয়ে অবশ্যই দ্রুত তদন্ত করা উচিত।"
কয়েক বার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রাব্বানীকে পাওয়া যায়নি।