ঢাকার বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন
৮ মে দেশে করোনাভাইরাসের 'ডেল্টা' ভ্যারিয়েন্ট, যা ভারতীয় ধরন নামে পরিচিত- শনাক্ত হয়। চার সপ্তাহের কম সময়ে ভারতীয় ধরন দশটি জেলায় পাওয়া গেছে। এরইমধ্যে এই ধরনের 'কমিউনিটি ট্রান্সমিশন' হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অধিক সংক্রামক এই ধরনের কারণে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে।
গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার বৌলতলী ইউনিয়নের তেলিভিটা গ্রামে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে গত ২১ মে এক ব্যক্তি মারা যান। পরে ওই পরিবারের আরও তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন।
ওই ব্যক্তির (পুরুষ) সংস্পর্শে আসা ওই গ্রামের ১৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪৫ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য ১১ জনের নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। এর মধ্যে সাতজনের দেহে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে।
গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বৌলতলী, সাহাপুর ও সাতপাড় ইউনিয়ন এলাকার মানুষ বৈধ ও অবৈধ পথে ভারত যাতায়াত করে। জেলার অন্যান্য এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম থাকলেও ওই তিন জেলায় সংক্রমণ বেড়েছে। সংক্রমণ মোকাবেলায় ওই তিন ইউনিয়নে ২৮ মে থেকে সাতদিনের কঠোর লকডাউন পালন করা হচ্ছে।
লকডাউন সত্ত্বেও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার বেড়েছে। শুক্রবার রাতে রাজশাহীর দুইটি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
এতে দেখা গেছে, আগের দিনের চেয়ে শুক্রবার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে রাজশাহীতে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৪৯.৪৩%, যা বৃহস্পতিবার ছিল ২৬%। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ দিন শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬১.৮৭%, বৃহস্পতিবার যা ৫৩. ৯৪% ছিলো।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল জেলার কোভিড রোগীদের একমাত্র হাসপাতাল যেখানে ২১৭টি জেনারেল বেড এবং ১৫টি আইসিইউ বেড রয়েছে। শনিবার, হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে ২২৪ রোগী ছিলেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, 'রোগীর চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে। রোগী বেড়ে যাওয়ায় আরো ১৬টি অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরইমধ্যে কোভিড ওয়ার্ডে চিকিৎসক সংকট দেখা দেয়ায় রাজশাহী মেডিকেলে ১৫ জন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে সিভিল সার্জন অফিস'।
রাজশাহীতে আইসিইউ ও অক্সিজেনের জন্য রোগীদের হাহাকার বাড়ছে।
গত ২৪ মে থেকে ১৩ দিনে রামেকে কোভিড পজেটিভ ও উপসর্গ নিয়ে ১০১ জন মারা গেছেন। যার মধ্যে ৬০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।
শনিবার সাতক্ষীরায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার ছিল ৪৭.৩৪%. করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরায় শনিবার (৫ জুন) সকাল থেকে সাত দিনের বিশেষ 'লকডাউন' শুরু হয়েছে।
খুলনায় করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ও করোনা শনাক্তের হার বাড়ছে। গত সাত দিনে (৩০ মে-৫ জুন) খুলনায় সংক্রমণ হার ছিল ২৫%, এর আগের সপ্তাহে যা ২০% ছিলো।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালিত বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সের ফলাফল থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের করোনভাইরাস সংক্রমণের ৮০% ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের।
সংক্রমিতদের মধ্যে ১৪ জন ব্যক্তির ভারতে যাওয়ার সাম্প্রতিক কোনও ভ্রমণ ইতিহাস নেই বা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া কোন রোগীর সংস্পর্শেও তারা আসেননি।
দেশের উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের কমপক্ষে আটটি জেলায় ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির শঙ্কার মধ্যেই এই অনুসন্ধানের কথা প্রকাশিত হয়। রাজশাহীতে শনিবার সকাল পর্যন্ত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ১২ জন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা শহর ও ঢাকার নবাবগঞ্জের নমুনা সিকোয়েন্সিং করেও ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পেয়েছে আইইডিসিআর।
জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, 'সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আবার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। অবৈধ পথে যারা ভারত থেকে আসছে তাদের কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। সীমান্তে বিজিবির টহল আরো বাড়াতে হবে। সংক্রমণ মোকাবেলায় এরইমধ্যে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় লকডাউন দেয়া হয়েছে। কিন্তু মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানা ও বেশি বেশি টেস্টের বিকল্প নেই। এছাড়া সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর হাসপাতালগুলোতে জেনারেল ও আইসিইউ বেড বাড়াতে হবে'।
ডিজিএইচএসের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, 'সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ রোধে লকডাউন ঘোষণাসহ বিভিন্ন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জেলাগুলোর হাসপাতালে বেড বাড়ানো, অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগত সচেতনতার বিকল্প নেই। শতভাগ মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখলে সংক্রমণ বড়তেই থাকে, তখন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ বাড়ে'।