তাপস-খোকনের বাগযুদ্ধে আইনের শাসন উপেক্ষিত
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বে আবারও উঠে এসেছে দেশে আইনের শাসনের দুর্বলতা। আইন থাকা স্বত্ত্বেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
সোমবার সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ঢাকার হাকিম আদালতে দু'টি মানহানির মামলা করেন মেয়র তাপসের 'শুভাকাঙ্খীরা'।
মামলার বাদী এবং ম্যাজিস্ট্রেট উভয় পক্ষই বাংলাদেশের ফৌজদারী কার্যবিধি এড়িয়ে গেছেন। কার্যবিধির ধারা ১৯৮ অনুসারে খোকনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের এবং গ্রহণ দু'টোই ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ।
উল্লেখিত ধারা মোতাবেক শুধুমাত্র সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানহানির মামলা দায়ের করতে পারেন। একমাত্র মেয়র তাপসই মানহানির অভিযোগ এনে সরাসরি অভিযোগ দায়ের করতে পারতেন।
সুতরাং আইনানুসারে তৃতীয় পক্ষের মানহানির মামলা দায়ের করার কোনো সুযোগ নেই। সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দায়ের করার মামলার এই 'শুভাকাঙ্খী' বাদীরা তৃতীয় পক্ষ। তাদের অপমানিত হওয়ার যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনি আদালতের কাছে বিচার দাবি করারও নেই কোনো সুযোগ।
একইভাবে ম্যাজিস্ট্রেটেরও তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ বা রেকর্ড করার আইনগত অধিকার নেই। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি মামলা দায়ের করতে পারেন।
ফৌজধারি কার্যবিধির ধারা ১৯৮ তে স্পষ্ট করে বলা রয়েছে, "ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি এরূপ মহিলা হন, যাকে দেশের রীতিনীতি ও প্রথানুসারে জন সমক্ষে বের হতে বাধ্য করা উচিত নয়, অথবা উক্ত ব্যক্তির বয়স যদি আঠারো বৎসরের নীচে হয়, অথবা সে যদি আহাম্মক বা উম্মাদ হয়, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়ে অন্য কোন লোক তার পক্ষ হতে অভিযোগ করতে পারবেন।"
উপরের বিশেষ বিবেচনার কোনোটিই ম্যজিস্ট্রেট কিংবা তথাকথিত শুভাকাঙ্খীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
এখানে আরেকটি মজার বিষয় হলো বাদীদের একজন নিজেই আইনজীবী। মেয়র তাপস সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এই বক্তব্য দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মাঝেই বাদী আদালতে মামলা দায়ের করেন।
আইনি বাধা থাকার পরেও মানহানির মামলা করতে পারেন কিনা জানতে চেয়ে উক্ত আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন রাখেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একজন প্রতিনিধি। উত্তরে আইনজীবী জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
তবে এ ধরনের মামলা গ্রহণের ঘটনা এই প্রথম নয়। গত কয়েক বছর ধরেই কার্যবিধির তোয়াক্কা না করেই আদালতে মানহানির আবেদন গ্রহণের ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত অনেকেই বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মানহানির মামলা দায়ের করে আসছেন।
তবে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি অন্যরকম। এখানে মামলার বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষই ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত। সাবেক মেয়র খোকন ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। অন্যদিকে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে শেখ ফজলে নূর তাপস ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মামলার বাদীদের একজন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন শাখার সদস্য।
তবে সোমবারের মামলা দায়েরের ঘটনাটি এক বিশেষ বার্তা বহন করছে। আইনের শাসন দুর্বল থাকলে, যে কেউ তার ফাঁদে পড়তে পারে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাও তখন আর সাহায্য করবে না।
প্রতিটি ঘটনা একটি করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সেই সাথে অনিয়মের পুনরাবৃত্তির পথকেও করে তুলছে প্রশস্ত। সব মিলিয়ে আইনের শাসন কার্যত দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। পরিণামে শাসন ব্যবস্থায় রেখে যাচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব।
আইনের শাসন বিষয়ক সূচকে প্রতিবছর বাংলাদেশ দুর্বল অবস্থানে থাকছে। আইনের শাসন ও নীতির প্রতি আনুগত্য কমে যাওয়া এর অন্যতম একটি কারণ।
- মূল লেখা: Rule of law caught in spat
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা