দেশি সুগন্ধি চালের জায়গা নিচ্ছে উফশী জাত
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা এবং সবসময় ভালো দাম থাকায় বেড়েছে সুগন্ধি ধানের চাষ। ধানের চাষাবাদ ও উৎপাদন বাড়লেও তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে পুরনো জাতগুলো। ফলন বেশি হওয়ার কারণে এ জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে উচ্চ ফলনশীল জাতের (উফশী) সুগন্ধি ধান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সূত্রে জানা গেছে, ফলন ভালো হওয়ায় এখন উফশী জাতে কৃষকদের নির্ভরতা বেড়েছে। আগে যেখানে প্রচলিত জাতগুলোর বিঘাপ্রতি ফলন হতো ৫-৮ মণ, এখন উফশীতে জাতভেদে বিঘাপ্রতি ফলন হয় ১২-২২ মণ।
জানা গেছে, ব্রি এখন পর্যন্ত মোট আটটি সরু এবং সুগন্ধি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হচ্ছে- আমন মওসুমে বিআর-৫ (দুলাভোগ), ব্রি ধান-৩৪, ব্রি ধান-৩৭, ব্রি ধান-৩৮, ব্রি ধান-৭০, ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-৮০ এবং বোরো মওসুমে চাষ উপযোগী ব্রি ধান-৫০, যা বাংলামতি নামে পরিচিত।
এর মধ্যে ব্রি ধান-৩৪ সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। ব্রি এই জাতটি অবমুক্ত করে ১৯৯৭ সালে। কিন্তু এর চাষ একটু একটু করে বাড়তে থাকে ২০১০ সালের পর থেকে। বর্তমানে সারাদেশে এই জাতটিই সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ব্রি'র গবেষকরা বলছেন, ব্রি ধান-৩৪ জাতের ধান চিনিগুড়ার মতো অথচ ফলন প্রায় দ্বিগুণ। বাজারে যে চিনিগুড়া চাল পাওয়া যায় তার প্রায় ৮০ ভাগ ব্রি ধান-৩৪। শুধু তা-ই নয়, এটি কালিজিরার মতো ছোট দানার। ফলনও কালিজিরার দ্বিগুণ। এ কারণে দ্রুত চিনিগুড়া, কালিজিরার যে পুরনো জাত তার জায়গায় কৃষক এখন ব্রি-৩৪ ধানের চাষ করেন।
দিনাজপুরের চেহেলগাজী এলাকার কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, একসময় কালিজিরা চাষ করতাম। তার চেয়ে এখন ব্রি-৩৪ চাষ করে দ্বিগুণ ফলন পাচ্ছি। এলাকার বেশিরভাগ কৃষকই এখন ব্রি-৩৪ ধান চাষ করছে।
এ ছাড়া ব্রি ধান-৭০ কাটারিভোগের মতো। এর বিঘাপ্রতি গড় ফলন প্রায় ১৭ মণ, যা কাটারিভোগের দ্বিগুণ এবং কাটারিভোগের চাইতে চালও কিছুটা লম্বা। ব্রি ধান-৮০-এর বিঘাপ্রতি গড় ফলন প্রায় ১৮ মণ এবং এটি থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় জাত জেসমিন ধানের মতো সুগন্ধযুক্ত এবং খেতেও বেশ সুস্বাদু বলে জানা গেছে।
ব্রি'র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সুগন্ধি ধানের উফশী জাতগুলোর ফলন পুরনো জাতগুলোর দ্বিগুণ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। যে কারণে কৃষকদের মধ্যে উফশী জাতগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। জাতগুলোর উন্নয়নের ব্রি নিয়মিত গবেষণা করে যাচ্ছে।
ডিএই থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ সুগন্ধি ধান চাষাবাদের উপযোগী। সারা দেশেই কম বেশি সুগন্ধি ধানের চাষ হয়। তবে ঠাণ্ডাপ্রবণ এলাকায় চালে সুগন্ধ বেশি হয়। বিশেষ করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ, শেরপুর জেলায় সুগন্ধি ধান বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এর বাইরে অবশ্য সারা দেশে সামান্য পরিমাণে সুগন্ধি ধানের চাষ হয়।
সুগন্ধি ধানে লাভবান কৃষক
দিনাজপুর সদর উপজেলার বোলতৈড় গ্রামের কৃষক সেলিম রেজা। গত বছর তিনি সাড়ে পাঁচ একর জমিতে ব্রি-৩৪ জাতের সুগন্ধি ধান আবাদ করেছিলেন।
তিনি জানান, মোটা ধান একরে উৎপাদন হয় প্রায় ৫০ মণ। ৯০০ টাকা মণ হিসেবে ৫০ মণ ধানের দাম হয় প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। সেখানে একই পরিমাণ জমিতে সুগন্ধি ধানের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ মণ। যা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার টাকা মণ হিসেবে। এ হিসেবে ৩৬ মণ ধানের দাম হয় প্রায় ৭২ হাজার টাকা।
আরও কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুগন্ধি ধান আবাদে জমি তৈরী, রোপন, কীটনাশক স্প্রে, কাটা ও মাড়াই করে ঘরে তোলা পর্যন্ত একর প্রতি জমিতে খরচ হয় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। কারণ এই ধানে স্প্রে একটু বেশি দেওয়া লাগে। আর মোটা ধান আবাদে একর প্রতি খরচ হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। চিকন ধান আবাদে কিছুটা খরচ বেশি থাকলেও লাভ বেশি।
উৎপাদন
সারাদেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে সুগন্ধি ধানের। সামগ্রিক ধান উৎপাদনের চিত্র কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে থাকলেও আলাদা করে সুগন্ধি ধানের আবাদের সর্বশেষ তথ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে।
তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পুরনো এক তথ্যে দেখা গেছে, মোট সুগন্ধি ধানের উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ৯০ হাজার ৫৫ টন। এর মধ্যে এক লাখ ২৪ হাজার ৩৮৭ টন ছিল শুধু ব্রি-৩৪, ব্রি-৫০, ব্রি-৬২, সম্পা কাটারি ও সোনামুখী ধান। এর আবার এক লাখ পাঁচ হাজার টনের বেশি উৎপাদন ছিল শুধু ব্রি-৩৪ ধানের।
এদিকে সুগন্ধি ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির একটা চিত্র পাওয়া যায় জেলাভিত্তিক তথ্য থেকে। সারা দেশের মধ্যে সুগন্ধি ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় দিনাজপুরে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দিনাজপুর অফিসের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সুগন্ধি ধানের আবাদ। একইসঙ্গে উচ্চফলনশীল জাতের ধান আবাদ করায় বেড়েছে উৎপাদনও।
জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে জেলায় সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়েছিল ৩৩ হাজার ৮৪ হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন হয়েছিল ৭১ হাজার ৪৬১ টন। এর ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, বেড়েছে জমির পরিমাণও।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবাদ হয়েছিল ৫৭ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে, যেখানে ধানের উৎপাদন হয়েছিল এক লাখ ৪০ হাজার ৩২৩ টন। এর পাঁচ বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়েছে এবং উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৪ টন। চলতি অর্থবছরেও আবাদের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়বে।
বর্তমান বাজার
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশে উৎপাদিত এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে আনা সুগন্ধি চাল রয়েছে। দেশি চালগুলোর ব্র্যান্ড অনুযায়ী কেজিপ্রতি ৮০-১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। খোলা ও প্যাকেটজাত দুই ধরনেই কিনতে পাওয়া যায় সুগন্ধি চাল। দেশি চাল প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেজিং করে বাজারে বিক্রি করছে এমন ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাণ, রাধুনি, কৃষাণ ইত্যাদি।
রপ্তানি বাজার
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি হয় না। তবে প্যাকেজিং করে নিয়মিত রপ্তানি হয় সুগন্ধি চাল। যদিও রপ্তানি বাজারটি এখনও অনেক ছোট।
বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে সুগন্ধি চালের ভালো চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত সুগন্ধি চাল ১৩৬টি দেশে রপ্তানি করছে। এ তালিকায় রয়েছে ইস্পাহানী, স্কয়ার, প্রাণসহ বিভিন্ন কোম্পানি। যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছে, সেখানেই মূলত রপ্তানির চাহিদা বেশি বলে জানা গেছে।
এফএওর ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবছর রপ্তানিকৃত সুগন্ধি চালের পরিমাণ প্রায় ৫৯৯৭ টন। তবে বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে সুগন্ধি চালের রপ্তানির পরিমাণ ১০ হাজার টন ছাড়িয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনটির সভাপতি মো. শাহ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রপ্তানির বাজারটা আরও বাড়ানো যেত। এদিকে আমাদের মনোযোগ কম। সরকারের কিছু প্রচারণা, উদ্যোগ এক্ষেত্রে দরকার। প্রণোদনা প্রদান করলে এই দ্রুত রপ্তানি বাড়বে।'
রপ্তানিকারকারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী। তাদের একটা বাজার ইতোমধ্যে তৈরি করা আছে।
এদিকে কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য বলছে, বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে। যাদের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টন সুগন্ধি চাল বিদেশে যায়।