ধান কাটা নিয়ে উৎকণ্ঠায় হাওরের কৃষক
ক'দিন আগেও যেখানে ছিল সবুজের সমারোহ, এখন সেখানে সোনা রঙের হাতছানি। ফসলের ভারে নুয়ে পড়ছে হাওরের রাশি রাশি ধানগাছ। দোল খাচ্ছে বসন্তের বাউরি বাতাসে। আর মাত্র সপ্তাহ খানেক পরেই এসব ধান নিয়ে কৃষকদের আনন্দযজ্ঞ শুরু হওয়ার কথা।
কিন্তু কষ্টার্জিত ধানগুলো গোলায় তোলার স্বপ্ন যারা দেখছেন, তারা রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ধান কাটা-মাড়াইয়ের শ্রমিক সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছেন তারা। আর এ সঙ্কট তাদের উৎকণ্ঠার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর নেত্রকোনার ১০ উপজেলার এক লাখ ৮৪ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা, আটপাড়া উপজেলার হাওরাঞ্চলে রয়েছে ৪০ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমি।
গত কয়েক বছরের বন্যার অভিজ্ঞতার কারণে কৃষকরা হাওরের বেশিরভাগ জমিতে আগাম জাতের বোরো ধান আবাদ করেছেন। উদ্দেশ্য একটাই- পাহাড়ি ঢল আসার আগেই যেন নির্বিঘ্নে ধান কেটে ঘরে তোলা যায়। এসব আগাম জাতের ধান ইতোমধ্যে পাকতে শুরু করেছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, আর মাত্র সপ্তাহখানেক পরই আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হবে। দুই সপ্তাহ পর পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে হাওরের বৈশাখি নবান্ন। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত টানা চলবে ধান কাটা-মাড়াই। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবারও বাম্পার ফলন পাবেন- এমনটাই আশা করছেন হাজার হাজার কৃষক।
কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ করে আসা 'করোনা দুর্যোগ' তাদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ এ দুর্যোগকালীন সময়ে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যাবে কি-না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
কৃষকরা জানান, হাওরাঞ্চলের সমস্ত ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয় মাত্র একমাসের মধ্যে। ওই সময় স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে চাহিদা পূরণ হয় না। এজন্য বরাবরই ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এ বছর করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক আসতে পারবেন কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
খালিয়াজুরীর পুরানহাটি গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বাইরের জেলা থেকে শ্রমিকরা না এলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ধান কাটা সম্ভব হবে না।
জগন্নাথপুরের কৃষক আঞ্জু মিয়া বলেন, যোগাযোগের অচলাবস্থার কারণে বাইরের শ্রমিকদের সঙ্গে এখনো চুক্তি করতে পারিনি।
বল্লী গ্রামের কৃষক রহিছ উদ্দিন বলেন, আর কয়েকদিন পরেই বৃষ্টিবাদল এবং নদ-নদীতে পাহাড়ি ঢল আসতে শুরু করবে। তাই সময়মতো ধান কাটতে না পারলে আমাদের আগাম বন্যার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে।
খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান শ্রমিক সঙ্কটের কথা স্বীকার করে বলেন, লকডাউনের কারণে বাইরের জেলার শ্রমিকরা যেন রাস্তাঘাটে বাধার মুখে না পড়েন, সেজন্য শ্রমিক দলগুলোকে নিজ নিজ এলাকার কৃষি অফিস থেকে একটি করে সার্টিফিকেট নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কৃষি বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম জানান, কৃষকদের এমন উদ্বেগ সম্পর্কে আমরা অবগত। এ পরিস্থিতিতে আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে ধান কাটা-মাড়াইয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের কাছে ৮২টি পুরনো হারভেস্টার মেশিন রয়েছে, যা দিয়ে সহজেই ধান কাটা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নতুন করে আরও ৪২টি হারভেস্টার মেশিন বিতরণ করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে সমন্বয় সাধন করে এসব যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিতে কৃষি বিভাগের কর্মকতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, এক লাখ ৮৪ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমির বিপরীতে মাত্র ১২৪টি যন্ত্র খুবই অপ্রতুল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান জানান, এ বছর জেলায় ১১ লাখ ১৯ হাজার ৫৬১ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৫০ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন।