আর কটা দিন বৃষ্টি না হোক: রোদের জন্য প্রার্থনা হাওরের কৃষকদের
তীব্র খরতাপে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ যখন বৃষ্টির জন্য হাপিত্যেশ করছে, সিলেটের হাওরাঞ্চলে তখন এর উল্টো চিত্র। আর ক'টা দিন বৃষ্টি না হওয়ার প্রার্থনা হাওরের কৃষকদের। কারণ, হাওরে এখন ধান কাটার ধুম চলছে। ফলনও হয়েছে ভালো। আর সপ্তাহখানেক রোদ হাসলেই ধান কাটা শেষ হবে। আর যদি ভারি বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে অকাল বন্যায় তলিয়ে যাবে ফসল। লোকসানে পড়বেন কৃষকরা। তাই তাদের এমন চাওয়া।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী ৩ মে থেকে সিলেট অঞ্চলে ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টি ও ঢলের কারণে অকাল বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেটের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ সজিব বলেন, 'সিলেট অঞ্চলে ৩ মে থেকে ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সিলেটের উজানে মেঘালয়েও এই সময়ে বৃষ্টি হতে পারে। ফলে ঢলও নামতে পারে।'
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ৩ মের আগেই ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা করছেন। তবে কৃষকরা বলছেন, শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটা শেষ করতে দেরি হচ্ছে তাদের।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের কৃষক হেলাল মিয়া। ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাচ্ছেন না তিনি। হেলাল মিয়া বলেন, 'ধান কাটার শ্রমিকের আকাল (অভাব) পড়েছে এখানে। দৈনিক হাজার টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। এদিকে কয়দিন ধরে খুব গরম পড়েছে। গরমে ধান কাটতে খুব কষ্ট হয়। তবুও এখন বৃষ্টি চাই না। আর ক'টা দিন রোদ থাকলেই ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'মাঝখানে একদিন শিলাবৃষ্টিতে অনেক ধান নষ্ট হয়েছে। তারপরও এবার ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু এখন শেষ সময়ে এসে বৃষ্টি বা বন্যা হলে ফসল ঘরে তুলতে পারব না। বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।'
হাওরের প্রধান ফসল বোরো ধান। বছরে একবারই ধান হয় এখানে। বছরের প্রায় আট মাসই পানির নিচে থাকে হাওর এলাকা। শুষ্ক মৌসুমে পানি নামলে বোরোর আবাদ করা হয়। বৈশাখে এই ফসল ঘরে তোলা হয়। এ ধান থেকেই আসে হাওরপাড়ের মানুষের খাদ্যের জোগান। প্রায় বছরই অকাল বন্যা কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে ধান তলিয়ে যায়। তবে এবার তেমন বৃষ্টি হয়নি, ঢলও নামেনি। তাই অনেকটা নির্বিঘ্নেই ধান ঘরে তুলতে পেরে খুশি কষকরা। তারা চান আরও ক'টা দিন এমন থাকুক।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কুবাজপুর গ্রামের কৃষক অরুনোদয় দাস বলেন, 'এ বছর ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। ভালো ফলন হয়েছে। ধান কাটাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। আরও সপ্তাহখানেক সময় পেলে সব ধান গোলায় তুলতে পারব।'
জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল বশিরুল ইসলামের বলেন, 'আমাদের উপজেলার প্রায় ৮০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাকি ধান দ্রুত কাটা শেষ করতে কৃষকদের আহ্বান জানিয়েছি। প্রকৃতি কখন রূপ বদলায়, তা বলা যায় না।'
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। এবার ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।
সুনামগঞ্জে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতি বছর প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ৪০টি হাওরে বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ করে থাকে। এবার ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় করে জেলার ১২টি উপজেলায় ৭৩৫টি প্রকল্পে ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবার বাঁধ ভেঙে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা যায়, তীব্র রোদ উপক্ষো করে কৃষকরা ধান কাটছেন। কেউ কেউ কাটা ধান বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার হাওরেই ধান বাছাই ও শুকানোর কাজ চলছে।
জামালগঞ্জের সাচনা এলাকায় ফসল শুকানোর কাজ করছিলেন কৃষাণী রোসনা বেগম। তিনি বলেন, 'রোদ আর গরমের ভয়ে এখন ঘরে বসে থাকলে সারাবছর না খেয়ে থাকতে হবে। আর এই একটা মাস কষ্ট করলে সারাবছর আরাম করা যাবে। আমরা এখন বৃষ্টি চাই না। আরও কয়েকটা দিন রোদ পেলে ধান কাটা ও শুকানো শেষ হয়ে যাবে। তখন বৃষ্টি হলেও চিন্তা নেই।'
সিলেটের একটি কলেজের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী অসীম দাস। তাহিরপুরের শ্রীপুরে তার বাড়ি। ছুটিতে বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্যদের সাথে তিনিও ধান কাটায় যোগ দিয়েছেন।
অসীম বলেন, 'কলেজ ছুটি না থাকলেও প্রতি বছর এই সময়ে ধান কাটতে বাড়ি আসি। বাবা-কাকাদের সাথে ধান কাটায় সহযোগিতা করি। বৈশাখ মাসটা হাওরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে এখানকার সব নারী-পুরুষ ব্যস্ত থাকেন। চাকরি ও লেখাপড়ার জন্য হাওরের যেসব মানুষ দূরে থাকেন, তারাও এই সময়ে গ্রামে এসে ধান কাটায় অংশ নেন।
তাহিরপুর উপজেলার ভাটি তাহিরপুর গ্রামের কৃষক কলমদর আলী বলেন, 'এবার ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথম দিকে ধান কাটার যন্ত্রেরও সংকট ছিল। এখন যন্ত্র পাওয়া গেলেও যন্ত্রের মালিকেরা কৃষকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিচ্ছেন। গত বছর যেখানে ৩০ শতক ধান কাটা-মাড়াইয়ে এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দিলেই হতো, সেখানে এবার ডিজেলের দাম বাড়ায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা নিচ্ছেন তারা।'
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, 'প্রায় ৮০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। আগামী ৪-৫ মের মধ্যে হাওরের ধান কাটা মোটামুটি শেষ হয়ে যাবে। ধান কাটায় কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।'
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, 'হাওরের কৃষকদের ফসলের যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য এবার শুরু থেকেই আমরা মাঠে আছি। কৃষকদের ফসল তোলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের পাশে আছি। ফসল ভালো হওয়ায় এবার কৃষকেরা খুশি।