ধুঁকছে মৃৎশিল্প
মৃৎশিল্পের সোনালি দিন গত হয়েছে অনেক আগেই।
বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে মাটির তৈরি বাসনপত্র, রান্নার সরঞ্জামাদি, মাটির ব্যাংক এসব তৈজসপত্র বিক্রি করছেন- ৯০'র দশকেও গ্রাম-বাংলার অতি-সাধারণ দৃশ্য ছিল এটি। বর্তমানে এমন দৃশ্য আর দেখা যায় না বললেই চলে।
মাটির তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, মূলধনের অভাব, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা এবং স্বল্প আয়ের কারণে; অনেক কুমোর বর্তমানে জীবিকা অর্জনের অন্য পথ বেছে নেওয়ায় দিন দিন কমে যাচ্ছে কুমোর পাড়ার সংখ্যা।
বর্তমানে শুধু কুমিল্লা, পটুয়াখালি, ঢাকা, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায় কুমোর পাড়ার দেখা মেলে।
"আমাদের পূর্ব-পুরুষরা শত শত বছর ধরে এ পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। আমি আমার বাবার কাছ থেকেই একাজ শিখেছি এবং আমি এখনো একাজই করে যাচ্ছি," বলছিলেন ঢাকার ধামরাই উপজেলার কাকরান গ্রামের ৫০ বছর বয়সী মৃৎশিল্পী বিমল পাল।
"তবে আমরা চাইনা আমাদের সন্তানরা এ ধারা বজায় রাখুক। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম আয়ও সম্ভব হয়না এখন। আমার ছেলে এখন গ্রামের বাইরে স্বর্ণকার হিসেবে কাজ করছে," তিনি বলছিলেন।
কাকরান গ্রামে ইতোপূর্বে ১৫০টি পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে এ সংখ্যা ২৫-৩০ জনে এসে ঠেকেছে, জানান বিমল পাল।
বহু শতাব্দী প্রাচীন এ খাতের বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পেরে অনেকেই তাদের পূর্ব-পুরুষের পেশা ছেড়ে দিচ্ছে, অনেকে জীবিকার সন্ধানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত মার্কিন লেখক হেনরি গ্লাসির লেখা 'দ্য পটার্স আর্ট' বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে মৃৎশিল্প গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজের শিক্ষক ড. দিলরুবা শারমিন জানান, বাংলাদেশের প্রায় ৬৮০টি গ্রামে মাটির তৈজসপত্র তৈরি হতো এবং প্রায় ৫ লাখ মানুষ একাজে নিয়োজিত ছিলেন।
"গত দুই দশকে সংখ্যাটি অনেক কমে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা কুমোর বৃত্তিতে নিয়োজিত ৩৫০টির বেশি গ্রাম খুঁজে পাইনি," বলেন তিনি।
"মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত বেশিরভাগ মানুষই সুবিধাবঞ্চিত ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই তাদের। তবে তারা এ হস্তশিল্পের কাজে দক্ষ জনশক্তি," শারমিন যোগ করেন।
মৃৎশিল্পের ধারাটিতে জনশক্তির চার ধরনের শ্রেণিবিভাগ আছে- দক্ষ কুমোর, মজুরিভুক্ত শ্রমিক, স্বনির্ভর কুমোর ও খন্ডকালীন কুমোর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত জনশক্তির ৬০ শতাংশ পুরুষ ও ৪০ শতাংশ নারী। অর্থাৎ, লিঙ্গ-বৈষম্য এখানে প্রকট নয়।
ধামরাইয়ের কাকরান কুমোর পাড়া, বগুড়ার আরিয়া পাড়া ও ঢাকার রায়ের বাজার কুমোর পাড়ায় গবেষণাটি চালানো হয়।
সীমিত লাভ
"সাধারণত ফেব্রুয়ারি-অক্টোবর ব্যবসার মৌসুম, লভ্যাংশও অত্যন্ত কম। কোভিড-১৯ মহামারীর আগে আমার আমার মাসিক বিক্রি হতো প্রায় এক লাখ টাকা, মুনাফা ১৫ হাজারের বেশি হতো না। এই আয় পুরো বছর জুড়ে পরিবারের খরচ বহন করার জন্য যথেষ্ট নয়," বলছিলেন বিমল পাল।
কাকরান পাড়ায় আগে বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈজসপত্র বানানো হতো, চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন শুধু দইয়ের সরা (দই বানাতে ব্যবহৃত পাত্র) বানানো হয়।
"একটি দইয়ের সরার উৎপাদন খরচ প্রায় ৮ টাকা, বিক্রয় মূল্য প্রায় ১২ টাকা। তবে শীতকালে দইয়ের চাহিদা কমে গেলে আমাদের ব্যবসায়েও তার প্রভাব পড়ে," বলেন তিনি।
কাঁচামালের দামও এক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলেও জানান তিনি।
লোহা ও প্লাস্টিকের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে লোহা ও প্লাস্টিকের পণ্যের ভীড়ে ছিটকে পড়েছেন এদেশের কুমোররা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দেবাশীষ পাল বলেন, "চুল্লি, চাকা আর মাটি মিশ্রণ যন্ত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ার অভাবে পিছিয়ে পড়েছেন আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীরা। আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণেরও অভাব আছে।"
পণ্যে বৈচিত্র্যের অভাব
মাটির তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে গেলেও অনেকেই, বিশেষত শহুরে জনগোষ্ঠী ঘর সাজাতে মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র পছন্দ করেন। নান্দনিক শিল্পমূল্যের পণ্য তৈরি করেই অনেক মৃৎশিল্পী ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "মৃৎশিল্পের পণ্যের আলাদা নান্দনিক শিল্পমূল্য আছে, একারণে অনেকেই এসব পণ্য পছন্দ করেন। এগুলো পরিবেশবান্ধব হওয়ায় পণ্যের বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধি এশিল্পের টিকে থাকার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।"
ড. দিলরুবা শারমিন বলেন, "একটা সময় ছিল যখন শুধু চারুকলা, শিশু একাডেমির রাস্তার ধারেই মৃৎশিল্পের পণ্য বিক্রি হতো। কিন্তু এখন এসব পণ্যের বাজার বড় হয়েছে; গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে আড়ং, বিবিয়ানা, যাত্রা ও আইডিয়া ক্রাফটের মতো ব্র্যান্ডগুলো মৃৎশিল্পের পণ্য বিক্রি করছে।"
মহামারীর প্রভাব
মহামারীর প্রভাব পড়েছে মৃৎশিল্পীদের ব্যবসায়ও। মহামারীর সময়ে ব্যবসার অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন মৃৎশিল্পী দম্পতি রবি পাল ও রচনা রানি।
"কলমদানি, ফুলদানির মতো শখের পণ্য উৎপাদন করি আমরা। মহামারীর আগে আমরা সাধারণত এক মৌসুমে নয় বদা (৫ হাজার তৈজসপত্রে এক বদা) পণ্য বিক্রি করতাম। কিন্তু, মহামারীর কারণে গত মৌসুমে মাত্র এক বদা বিক্রি করতে পেরেছি," বলছিলেন রবি।
"সাধারণত বিভিন্ন মেলায় ও পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবের সময় আমাদের পণ্য বিক্রি হতো। কিন্তু মহামারীর পর বেশিরভাগ মেলাই হয়নি গত বছর, আমাদের ব্যবসায়ও এর প্রভাব পড়েছে। আমার প্রায় ২ লাখ টাকার ধার জমেছে, পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যই টাকাগুলো ধার করতে হয়," জানান তিনি।
সরকার কী করছে?
মৃৎশিল্প মূলত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসসিআইসি) কর্মকর্তারা জানান, নতুন উদ্যোক্তা সহ বাকিদের ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
"মৃৎশিল্পসহ মোট ১৩টি শিল্পখাতের জন্য আমরা ছয়টি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করেছি। ১৮-৩৫ বছর বয়সী নতুন উদ্যোক্তারা কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। অন্য বয়সসীমার উদ্যোক্তারা বিএসসিআইসি থেকে ঋণ নিতে পারবেন," বলেন বিএসসিআইসির নকশা কেন্দ্রের মহা-ব্যবস্থাপক জেসমিন নাহার।
"ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীদের আধুনিকায়নের আওতায় নিয়ে আসার জন্য এখন পর্যন্ত আমাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে কাজের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এমন পরিকল্পনা করা হতে পারে।"