নাটোরের খাজুরা গ্রামে বৈদেশিক আয় ৮ কোটি টাকা
নাটোরের নলডাঙ্গা থানার খাজুরা গ্রামের আব্দুল মোমিন সরকার ২০০৪ সালে সৌদি আরবে যান। সেখানে গিয়ে প্রথম তিন বছর অন্যের অধীনে কাজ করেন। এরপর নিজেই রিয়াদের হারাস বিন গাছিম এলাকায় সোফাসেট, জানালা ও দরজার পর্দার ব্যবসা শুরু করেন, দোকান ভাড়া নিয়ে। ১৩ বছর পর ২০১৭ সালে তিনি সৌদি আরব থেকে চলে আসেন। বিদেশ খেটে তিনি ৬ বিঘা ধানী জমি, গাছপালাসহ ভিটেজমি ও নাটোর শহরে জমি কিনেছেন। বর্তমানে তার দুই থেকে তিন কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। নাটোরের শেরকুল বাজারে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করে সেখানে বসবাস করছেন। খাজুরা গ্রামেও তার বাড়ি রয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসাও করছেন তিনি।
খাজুরা বাজারে গত বুধবার (২৭ জানুয়ারি) কথা হয় আব্দুল মোমিন সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'গ্রামে বাপ দাদার ভিটে জমি ছিলো। কিন্তু নগদ অর্থ ছিলো না। আর বাবারা ছয় ভাই হওয়ায় জমিজমাও ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিলো। বিদেশ যাওয়ার পর আমি আর্থিকভাবে আরো সক্ষম হই। এরপর আমার মেজ ভাইকেও বিদেশে নিয়ে যাই। সে এখনো সৌদি আরবে রয়েছে। সেখানে সে-ও হোম ডেকোরেশনের ব্যবসা করছে'।
মোমিন সরকার বলেন, 'শুধু আমার মেজ ভাই না, আমার বাবাদের ছয় ভাইদের মধ্যে আমার বাবা ছাড়া বাকি পাঁচ ভাই, তাদের প্রত্যেকের দুইটি করে সন্তানসহ অন্য দাদাদের ছেলে ও তাদের সন্তানদের ধরে আমাদের গোষ্ঠী থেকেই ২৮ জন সৌদি আরবে রয়েছে'।
শুধু সরকার পরিবার থেকেই নয়, এক খাজুরা গ্রাম থেকেই হাজার খানেক মানুষ সৌদি আরবে রয়েছেন। খাজুরা গ্রামের এমন কোনো পরিবার নেই, যে পরিবার থেকে দুই একজন সৌদি আরবে যায়নি। সৌদি আরবে গিয়ে এদের বেশিরভাগই ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। আর্থিকভাবে সক্ষম হয়েছেন। গ্রামে ইটের পাকা বাড়ি করেছেন। খাজুরা গ্রামে এখন কোনো কাঁচা বাড়ি নেই। প্রবাসীদের বেশিরভাগই নাটোর শহরে জায়গাজমি কিনে বাড়ি করছেন। এলাকাবাসীর মতে, নাটোর জেলা শহরের বেশিরভাগ জায়গাজমি এখন খাজুরা গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের মানুষদের।
প্রবাসীদের অনেকে নাটোর শহরে মার্কেটও করেছেন। খাজুরা গ্রামের মানুষজন এখন এত স্বচ্ছল যে প্রত্যেকের বাড়িতেই রয়েছে মোটরসাইকেল। মাঠের জমিতে কাজ করতেও মোটরসাইকেল নিয়ে যায় তারা।
একই গ্রামের দিদারুল ইসলাম ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবে যান। এর দুইবছর পর তার ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমানকেও সৌদি আরবে নিয়ে যান। এখন তারা দুই ভাই-ই সপরিবারে সৌদি আরবের রিয়াদে বসবাস করেন। বিদেশে যাওয়ার আগে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। বিদেশে গিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। এখন খাজুরা বাজারে তাদের বড় দুইটা মার্কেট রয়েছে। বড় বড় ১০ টি পুকুর করেছেন। নাটোর শহরের নীচাবাজারে আদি নিমতলা মার্কেট ক্রয় করেছেন। এছাড়া নাটোর শহরে পাঁচতলা বাড়ি ক্রয় করেছেন। গ্রামেও বহুতল ভবন করেছেন।
দিদারুলের ছোট ভাই এরশাদ আলী জানান, ভাইদের সেখানে হোম ডেকোরেশনের ব্যবসা আছে। সোফাসেট ফিটিংস, জানালা ও দরজার পর্দার ব্যবসা রয়েছে। দোকান কিনে নিয়ে সেখানে তারা ব্যবসা করেন। দেশে পাকাপাকিভাবে ফিরে আসার এখনো কোনো পরিকল্পনা নেই।
তিনি বলেন, 'ফুপাত-মামাত ভাইবোন, ভাগনে, ভাস্তে ধরলে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের ৪০ জনই রয়েছে সৌদি আরবে'।
খাজুরা ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, খাজুরা ইউনিয়নে ২৬ হাজার ১৯৪ জন জনসংখ্যার মধ্যে মোট ৮৬৮ জন সৌদি প্রবাসী রয়েছেন। যাদের মধ্যে ৫০০ জন প্রবাসী খাজুরা গ্রাম থেকে। তবে এলাকাবাসী এই হিসাব মানতে নারাজ। তাদের ধারণা, খাজুরা ইউনিয়নে তিন থেকে চার হাজার সৌদি প্রবাসী রয়েছেন। আর খাজুরা ইউনিয়ন ছাড়া পার্শ্ববর্তী গোপালবাটি, বাঁকীওলমা, থলওলমা, কান্দিভিটা, বিশা, নারকেলবাড়িয়া, বিপ্রবোয়ালিয়া গ্রামের হিসেব ধরলে প্রবাসীর সংখ্যা ৬ হাজারের কম না।
এই বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর বেশিরভাগই প্রধানত হুন্ডির মাধ্যমেই দেশে টাকা পাঠান। খুব সহজে দ্রুত বাড়িতে টাকা পৌঁছে যায় বলে তারা এই কাজটি করে থাকেন বলে জানিয়েছেন। তবে অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমেও টাকা পাঠান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হুন্ডি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তার মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ টাকা সৌদি প্রবাসীরা পাঠান। হুন্ডির মাধ্যমে গ্রাহকরা দ্রুত সময়ে বাড়িতে বসেই টাকা পেয়ে যায়। এইজন্য এই পন্থাই অবলম্বন করে প্রবাসীরা। এছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে গ্রামের লোকজনকে ২০ কিলোমিটার দূরে নাটোর শহরে গিয়ে টাকা ব্যাংক থেকে উঠাতে হয়। সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে অনেকেই ব্যাংকের মাধ্যমেও টাকা পাঠান বলেও জানান তিনি।
তিনি জানান, খাজুরা গ্রামের ১০০০ প্রবাসীর মধ্যে ৬০০ জন তো গড়ে মাসে এক লাখ করে টাকা পাঠায়। সে হিসেবে শুধু খাজুরা গ্রাম থেকে যাওয়া প্রবাসীরাই মাসে ৬ থেকে ৮ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়। খাজুরা ইউনিয়নসহ আশেপাশের গ্রাম থেকে সৌদি আরবে থাকা প্রবাসীরা প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়।
জামিউল ইসলাম জামিল ২০০৭ সাল থেকে সৌদি আরবে থাকেন। পড়ালেখা শেষে চাকরিবাকরি না পেয়ে সৌদি আরবে চলে যান তিনি। এখন তার লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি। নাটোর শহরের বড়গাছায় গতবছর পাঁচ ভাই মিলে ৭৫ লাখ টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করেছেন। এখন সেখানে সাততলা ভবন করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। নাটোরে বাড়ি করার জন্য এক বছরের ছুটি নিয়ে দুই মাস আগে তিনি খাজুরা এসেছেন।
এই প্রতিবেদককে জামিউল ইসলাম জানান, দেশে থাকলে হয়তো চাকরিবাকরি করে কোনোরকমে দিন পার করতে হতে। এত জায়গাজমি কিনে বাড়ি করা সম্ভব হতো না। কিন্তু সৌদি আরবে যাওয়ার কারণে এত উপার্জন করা সম্ভব হয়েছে।
তবে এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। অনেকেই ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে গিয়ে থেকে গিয়েছেন। ফলে ভিসার মেয়াদ পার হওয়ায় তাদের আত্মগোপনে থেকে অন্যের অধীনে কাজ করতে হয়। অনেকে সৌদি আরবে গিয়ে টিকতে না পেরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকের সৌদি আরবে থাকার আকামা (বৈধ থাকার কাগজপত্র) না থাকায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে ধরা খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। অনেকে ভিটে জমি বিক্রি করে গিয়েও আর্থিকভাবে তেমন কিছুই করতে পারেন নি।
খাজুরা শ্রীপুর পশ্চিমপাড়ায় হযরত আলী চার বছর ছিলো সৌদি আরবে। ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে গিয়ে আর বৈধ কাগজপত্র করতে পারেন নি। পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে ২০ দিন জেল খেটে দেশে ফিরে আসছেন মাসখানেক আগে। তিনি ভিটেজমি বিক্রি করে গিয়ে কিছুই করতে পারেনি। এখন নিঃস্ব অবস্থায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করছেন তিনি।
একই গ্রামের আলামিনও ভিটেজমি বিক্রি করে চার বছর আগে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। শুরু থেকেই তিনিও কোনো বৈধ কাগজপত্র করতে পারেননি। কাগজপত্র ছাড়াই তিনি আত্মগোপনে থেকে চাকরি করেছেন। কিন্তু করোনা আসার পরে তাকে চাকরি খুঁজতে একস্থান থেকে আরেকস্থানে যেতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এখন দুই মাস ধরে তিনি সৌদি আরবে জেল খাটছেন তিনি।
আমিরুল ইসলাম সৌদি আরবে গিয়ে কিছুই করতে না পেরে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। এখন তিনি খাজুরা বাজারে খুচরা কাঁচাবাজারের ব্যবসা করছেন।
জনাব আলীও দুই দফা সৌদি আরবে গিয়েছেন। সম্প্রতি এক মাস হচ্ছে তিনি পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরেছেন।
তিনি বলেন, এখন সৌদি আরবের পরিবেশ খুব একটা ভালো না। ব্যবসা-বাণিজ্য করাটাও কঠিন হয়ে গেছে। প্রতিবছর আকামা করতে হয়। তখন মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে খাজুরা গ্রাম। গ্রামটির একপাশে চলনবিলের শাখা হালতির বিল রয়েছে। আরেকপাশে আত্রাই নদীর শাখা নদী। বর্ষাকালে গ্রামটির চারপাশে থৈ থৈ পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি হলেও নব্বইয়ের দশক থেকে দুই একজন করে সৌদি আরবে যেতে শুরু করেন। এর ফলে এলাকার মানুষের বিরাট ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। অনেকেই কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটিপতিতে পরিণত হন।