নৌ যোগাযোগ উন্নয়নে বিশাল পরিসরে ড্রেজিং, যোগ হলো ২৩০০ কিলোমিটার জলপথ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশাল পরিসরে ড্রেজিং পরিচালনার ফলে বাংলাদেশের অসংখ্য নদীতে ফিরেছে নাব্যতা। আর এর মধ্য দিয়ে দেশের নদী ব্যবস্থাপনায় যোগ হয়েছে আরও ২৩০০ কিলোমিটার নৌপথ।
২০০৫ সালে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে জলপথের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র তিন হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট জলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৯০০ কিলোমিটার। এছাড়া, বর্ষার মৌসুমে পানি বেড়ে যাওয়ায় আরও দুই হাজার কিলোমিটার জলপথ যোগ হয় বলে জানান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
১৯৬০ সালে দেশে ১২ হাজার কিলোমিটার জলপথ থাকলেও প্রাকৃতিকভাবে জমা পলিমাটি, ফারাক্কা বাঁধের মত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নদীগুলো বিভিন্ন স্থানে বাধা পেয়ে সংকীর্ণ হতে থাকে।
কার্গো পরিবহনের জন্য জলপথকে সবথেকে সুলভ পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের একটি গবেষণা নিবন্ধ অনুযায়ী, এক টন মালামাল এক কিলোমিটার পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কপথ এবং রেলপথে যথাক্রমে যথাক্রমে সাড়ে ৪ টাকা এবং ২.৭৪ টাকা করে খরচ পড়লেও জলপথে এই খরচ মাত্র দশমিক ৯৯ টাকা। অর্থাৎ, জলপথে খরচ এক টাকারও কম।
পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধিতে সরকার ২০০৮ সালে হারিয়ে যাওয়া নৌপথ পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করে। গত এক দশকে ৩২টি ড্রেজার কিনে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, বেসরকারি খাতকেও নিজস্ব যন্ত্রাদি ব্যবহারের মাধ্যমে নদী উদ্ধারে সম্পৃক্ত করা হয়েছে বলে জানান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্যানুসারে, বাণিজ্যিক ব্যবহারে নতুন নদীপথগুলো চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত একটি নৌপথ ছাড়াও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক জলপথ আছে।
এর আগে, কয়েক বছরের মধ্যে দশ হাজার কিলোমিটার নদীপথের নাব্যতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। সরকারের ড্রেজিং মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক।
বর্তমানে দেশের ৫৩টি নদীতে ড্রেজিং প্রকল্প চলছে। এর মধ্যে ঢাকার চারপাশে চক্রাকার একটি নদীপথ নির্মাণ প্রকল্পও আছে।
এছাড়া, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত একটি প্রকল্প অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নৌ-সংযোগ স্থাপন পরিকল্পনাও এখন বাস্তবায়নের পথে।
দশ হাজার কিলোমিটার জলপথের পাশাপাশি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় মাগুরা থেকে খুলনা এবং মাগুরা থেকে বরিশালের জলপথ পুনরুদ্ধার প্রকল্পও হাতে নিয়েছে।
স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে প্রযুক্তির ব্যবহার
ড্রেজিংয়ের পিছে শত কোটি ডলার ব্যয় করা হলেও কাজের গুণগত মান এবং ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে আছে প্রশ্ন।
ঠিকাদাররা কাজ সম্পন্ন না করেই বিল আদায় করেন বলে অভিযোগ আছে। নদী থেকে কী পরিমাণ পলি উত্তোলন করা হয়েছে তা পরিমাপ করা কঠিন বলেই বিষয়টি নির্ধারণ করা সহজ নয়।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে, ভারতের দেওয়া ঋণচুক্তির (এলওসি) আওতায় আমরা ড্রেজিং নিয়ন্ত্রণে কম্পিটারাইজড পদ্ধতিতে নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করেছি।"
বাংলাদেশের নদীগুলো সারা বছর বিশাল পরিমাণ পলি বয়ে নিয়ে আসে বলে ড্রেজিং একটি চলমান প্রক্রিয়া।
"উদাহরণস্বরূপ, গত বছর বন্যার কারণে মাওয়া-পাটুরিয়া রুটটি চারবার বন্ধ হয়ে যায়। ১০ ফিট গভীরতা থেকে রাতারাতি তা দুই ফিট গভীরতায় নেমে আসে। ১০টি ড্রেজার একত্রে পলিমাটি উত্তোলনে লেগে যায়। কিন্তু, পলিগুলো বারবার ফিরে আসে," বলেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ।
কয়েক দশকের পলির আস্তরণ
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশের ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার ঠিক পরেই। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতায় এই উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল।
"তিনি লক্ষ্য করেন যে, ইতোমধ্যেই দেশের নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে। আর তাই তিনি সাতটি ড্রেজার কেনার ব্যবস্থা করেন," বলেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ।
জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার পর ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো দেশের জলপথ উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে মন্তব্য করেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকা পলির কারণে পানির প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে, নদীগুলো হারাতে থাকে নাব্যতা।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো পরিষ্কারের মতো প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হয়।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসলে সরকার কয়েক ধাপে ৩২টি ড্রেজার কিনে। পুরনো ড্রেজারগুলোসহ বর্তমানে বিআইডব্লিউটিসির কাছে মোট ৩৯টি ড্রেজার আছে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ আরও জানান, সরকার লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে আরও ৩৫টি ড্রেজার এবং বিভিন্ন আকৃতির সহায়ক জলযান সংযোজন করবে।
"এটা শুধু সরঞ্জাম কেনার বিষয় নয়। এর সাথে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিও জড়িত," বলেন তিনি।
এখন পর্যন্ত ২০টি ড্রেজার এবং সহায়ক জলযান পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রায় ১৬০০ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও মানুষ নিয়োগ দেওয়া হবে।
ড্রেজিংয়ের উপকারী ফলাফল
ড্রেজিংয়ের কারণে নদী পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের উল্লেখজনক বাস্তুগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিআইডব্লিউটিএ'র কর্মকর্তারা। এছাড়া, নৌ পরিবহন ব্যবস্থাও আগের চেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, নদীতে পানির প্রবাহ বাড়তে থাকায় কৃষকরা সহজেই জমিতে সেচের পানি দিতে পারেন। এছাড়া, প্রকৃতিও গাছপালা এবং পশুপাখি বান্ধব হয়ে উঠেছে।
ড্রেজিংয়ের কারণে বন্যা ও জলাবদ্ধতার ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে মাটির উর্বরতা এবং কার্বন নিষ্কাশন ক্ষমতা।
নদীর পানির মানোন্ননেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে ড্রেজিং।
এছাড়া, গোমতী নদী( নারায়নগঞ্জ- দাউদকান্দি রুট), শীতলক্ষ্যা (ডেমরা-ঘোড়াশাল-কটিয়াদি), মেঘনা (লাহারহাট-ভেদুরিয়া), সাহেবেরহাট চ্যানেল (সাহেবেরহাট-টুঙ্গিবাড়ি), আড়িয়াল খাঁ এবং সন্ধ্যা নদী (রামচর- মাদারিপুর), কালিগঙ্গা এবং ঘাঘর নদী (চাঁদপুর- হুলারহাট), তুরাগ (সদরঘাট- আশুলিয়া), আড়িয়াল খাঁ (ঢাকা- জাজিরা- মাদারিপুর- পেঁয়াজখালি), কুমার নদী (মাদারিপুর- গোপালগঞ্জ), মধুমতি নদী (বিলরুট), গোমতী, মধুমতি এবং শৈলদাহ নদী (দাউদকান্দি- হরিদাসপুর) ইত্যাদি নদীপথেও পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক ড্রেজিং পরিচালিত হয়।
- নিউজটি ইংরেজিতে পড়ুন: Massive dredging promises to boost river channel, adds 2,300km of waterways