পৌর বর্জ্যের শেষ গন্তব্য কাপ্তাই হ্রদ
রাঙামাটি পৌর শহরের প্রতিদিনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শহরের প্রবেশ মুখ মানিকছড়ি বেতার কেন্দ্র এলাকায়। বর্জ্য ফেলার স্থানটি রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হওয়ায় ময়লার গন্ধ শুকেই জেলায় প্রবেশ করতে হচ্ছে লাখো মানুষকে। শুধু তা-ই নয়, পৌর শহরের শত শত টন বর্জ্যরে শেষ গন্তব্য হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদে। এতে একদিকে হ্রদ দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে ভরাট হচ্ছে হ্রদের তলদেশ- স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন হাজারো মানুষ।
রাঙামাটি পৌরসভার তথ্যমতে, শহর থেকে প্রতিদিন ৩০/৩৫ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে মানিকছড়ি বেতার কেন্দ্র এলাকায় ফেলে পৌরসভার পরিছন্নকর্মীরা। এ বর্জ্য বর্ষাকালে নদীতে ভেসে উলুছড়ি, ভেদভেদি সেনানিবাস এলাকা হয়ে পড়ছে কাপ্তাই হ্রদে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ডাম্পিং পয়েন্ট এলাকার বাসিন্দারা।
বেতার কেন্দ্র এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন (৪০) বলেন, পুরো রাঙামাটি পৌর শহরের বর্জ্য এখানে ফেলা হচ্ছে। এ বর্জ্য বর্ষায় বৃষ্টি হলে পানিতে ভেসে হ্রদে চলে যাচ্ছে। এখানে বর্জ্য ফেলার কারণে আশপাশ এলাকায় দুর্গন্ধে থাকা যায় না। কাকসহ বিভিন্ন পশুপাখিরা আবর্জনা স্তুপ থেকে ময়লা নিয়ে বাসা বাড়ির আঙিনায় ফেলে রাখছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমাদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাঙামাটি শহরের সমস্ত বর্জ্য পৌরসভার ট্রাকে করে এনে মানিকছড়ির বেতার কেন্দ্র এলাকায় পাহাড়ের নিচে ফেলা হচ্ছে। এ বর্জ্য সেখানে থাকা ছড়া (ছোট নদী) দিয়ে আনসার ক্যাম্প, উলুছড়ি, সেনানিবাস এলাকা, কাটাছড়ি হয়ে কাপ্তাই হ্রদে পড়ছে। বিভিন্ন প্লাস্টিক ও পলিথিন ছড়া দিয়ে ভেসে আসায় উলুছড়ার জমিগুলো চাষ অযোগ্য হয়েছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে পানির স্রোতে সব ময়লা আবর্জনার শেষ গন্তব্য হয়ে ওঠে কাপ্তাই হ্রদ। এ বর্জ্যের পাশাপাশি গৃহস্থলীর বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। যা কাপ্তাই হ্রদের পানিকে দূষিত করছে।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাপ্তাই হ্রদের পানি উত্তোলন করে তা পুরো পৌরসভায় সরবরাহ করে। হ্রদের কিছু কিছু এলাকায় দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
'জেলা সচেতন কমিটির' সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, রাঙামাটি পৌর শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে হচ্ছে না। যে স্থানে ময়লা ফেলা হচ্ছে এ ময়লা চলে যাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদে। প্রধান সড়কে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে শহরে ঢোকার সময় প্রত্যেককে দুর্গন্ধের বাজে অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে। এটি জেলাবাসীর জন্য লজ্জার ব্যাপার।
''এত সুন্দর শহর। অথচ আবর্জনার গন্ধ নিয়ে প্রত্যেককে শহরে প্রবেশ করতে হচ্ছে। পৌরসভার একাধিক মেয়র পরিবর্তন হলেও কেউই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। মানুষজন নেই এমন জায়গা নির্বাচন করে পৌর শহরের বর্জ্য ফেলা দরকার'', যোগ করেন তিনি।
চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ছোটবেলায় আমরা এ পানি খেলেও এখন তা অসম্ভব। শরীরে পানি লাগলে চর্মরোগ হচ্ছে। রাঙামাটি পৌরসভার বর্জ্যগুলো যেন পরিবেশ দূষণ না করে সেজন্য পৌরসভাকে আরেকটু দায়িত্বশীল হতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, হ্রদের পানিতে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। রাঙামাটি সাবেক সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা বলেন, জেলা শহরের মানুষ কাপ্তাই হ্রদের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু পানি যে হারে দূষিত হচ্ছে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। হাসপাতালে প্রায় সময় ডায়রিয়া, কলেরা রোগী ভর্তি হচ্ছে। এ দূষণ হেপাটাইটিস-বি সহ নানান পানিবাহিত রোগ ছড়াচ্ছে।
রাঙামাটি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আপ্রু মারমা বলেন, পৌরসভার বর্জ্যগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন প্লাস্টিক, পলিথিন থাকায় চাষের জমির ক্ষতি হচ্ছে। জমি চাষ করাও ঝুঁকিপুর্ণ হয়েছে। কৃষকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন। এ ছাড়া জমির উর্বরতাও নষ্ট হচ্ছে।
শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি পৌরসভা। নিরাপদ স্থানে বর্জ্য ফেলার জায়গাও নির্ধারণ করতে পারেনি এ কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সাল থেকে হ্রদে বর্জ্য পড়ার হার বেড়েছে বলে স্বীকার করেন রাঙামাটি পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী।
তিনি বলেন, পৌর শহরের ময়লাগুলো ফেলার জন্য বিকল্প কোনো জায়গা না পাওয়ায় ওখানে ফেলতে হচ্ছে। তবে নতুন জায়গা খোঁজা হচ্ছে। নতুন জায়গা পাওয়া গেলে ডাম্পিং স্থান সেখানে স্থানান্তর করা হবে। বর্তমানে যেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সেই বর্জ্য যেন কাপ্তাই হ্রদে না পড়ে সেজন্য একটি দেওয়াল নির্মাণের কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।